Micro Retirement

কেউ নিচ্ছেন ৩ মাসের অবসর, কেউ ২ বছরের, আবার ফিরছেন কাজে! নতুন যুগের নয়া প্রথা

ইচ্ছামতো অবসর মানেই বিদেশি ব্যাপার, এমন অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু এখন তেমন হয় কলকাতা শহরেও।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৬
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি। কখনও কাজ, কখনও অবসর।

Advertisement

অবসর অবশ্য ঘণ্টায় মাপা নয়। মাস, বছরে মাপা। অর্থাৎ, হাতে স্থায়ী চাকরি থাকলেও তা ছেড়ে দেওয়া। নিজের মতো সময় কাটানো। ঘুরে বেড়ানো। তার পরে আবার কাজে ফেরা।

এখন এমনও হয়! ৬০ বা ৬৫ বছরে পা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন না আর অনেকেই। অবসর ইচ্ছামতো নেন। ইচ্ছা হলে আবার নতুন করে কাজে যোগ দেন। নতুন যুগের নয়া নীতি এমন ক্ষণিকের অবসর।

Advertisement

ইচ্ছামতো অবসর মানেই বিদেশি ব্যাপার। এমন অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু এখন তেমন হয় কলকাতা শহরেও।

এক সময়ে বাঙালিদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল, চাকরি পেলে ছাড়তে নেই। সেখানে সারা জীবন কাজ করে বৃদ্ধ হয়ে অবসর নিতে হয়। সেই অভ্যাস বহু দিন হল বদলেছে। এখন যাঁদের বয়স ৪০-৫০ বছরের আশপাশে, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দফতরে কাজ করে ফেলেছেন তাঁদের অনেকেই। ৩-৪ বছর অন্তর কাজের জায়গা বদলানো খুব বড় আলোচনার বিষয় আর নেই। তবে একেবারে কাজ ছেড়েই দেওয়া আবার সে প্রজন্ম বিশেষ বোঝে না। ক্ষণিকের অবসর নিয়ে বছর দুই বা তিনেক বাদে আবার নতুন উদ্যমে চাকরি খোঁজা এবং পাওয়া যে সম্ভব, বাঙালিকে তা শেখাচ্ছে নতুন প্রজন্ম।

এত দিন ধরা হত, অবসরের নির্দিষ্ট সময় আছে। কোনও কাজে ৫৮ বছর। কোনও কাজে ৬০ বা ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরি থাকে এ দেশে। কিন্তু সময়ের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো অবসরও হয়। আবার তাঁরা কেউ কেউ কাজে ফেরেন। এমন করছেন অনেকে। তাকেই বলা হচ্ছে ক্ষণিকের অবসরযাপন।

আগে যে এমন একেবারে হত না, তা নয়। তবে অতিমারির পর থেকে আরও বদল এসেছে সমাজভাবনায়। কাজ ও অবসরের নিয়মেও সে সঙ্গে বদল আসছে বেশি। যেমন সে সময় থেকে বহু অফিসেই বাড়ি বসে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাতে জীবনধারাতেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। ফলে এখন যখন ধীরে ধীরে কাজের জায়গায় ফিরতে হচ্ছে, রোজ অফিসে গিয়ে কাজ করার নিয়ম ফিরে আসছে, তাতে অসুবিধায় পড়ছেন বিশেষ করে কমবয়সিরা। কারণ, তাঁরা হয়তো যত দিন কাজ করেছেন, তার মধ্যে বেশিটাই বাড়ি থেকে। যেমন পুণেতে কর্মরতা, বছর ২৯-এর দেবপ্রিয়া সেনগুপ্তের কথাই ধরা যাক। একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করছেন বছর পাঁচেক ধরে। এখনও সপ্তাহে এক দিন করে অফিস যেতে হয়। বাকি ৫ দিন বাড়ি থেকে কাজ। বিয়ের পর সে নিয়মেই সংসার সাজিয়েছেন। এ বার যদি রোজ অফিসে ডাক পড়ে, ভাবনা শুরু হবে তাঁর। সঞ্চয় করে প্রয়োজনে অবসর নিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন তিনি। তার জন্য যদি কিছু দিন সময় লাগে, তখন যদি উপার্জন না থাকে, অবসরে থাকতে হয়, তবুও আপত্তি নেই তা মেনে নিতে।

করোনাকালের অনিশ্চয়তা অনেককেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা সবে কর্মজীবন শুরু করছেন, তাঁরা প্রথম থেকেই দেখে নিয়েছেন যে, প্রায় সব কাজেই স্থায়িত্বের অভাব। কারণ, সে সময়ে সব ক্ষেত্রে কাজ হারানোর সংখ্যা ছিল অনেক। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই উচ্চাকাঙ্খা ছেড়ে মানসিক শান্তির দিকে জোর দেওয়ায় মন দিয়েছেন।

কিন্তু সকলের আর্থিক পরিস্থিতি কি সমান? তা-ও কী ভাবে স্বেচ্ছায় ক্ষণিকের অবসর নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে?

করোনার সময়টি যেমন অনিশ্চয়তা দেখিয়েছে, তেমন অনেককে দেখিয়েছে যে, সব মিলিয়ে কাজের জায়গায় বিকল্প বেড়েছে। একটা কাজ না থাকলে অন্য কিছু যে জোগাড় হতে পারে, তা শিখেছেন কেউ কেউ। এমনই বক্তব্য নতুন প্রজন্মের অনেকের। ফলে বিবিধ চেষ্টা করার ইচ্ছাও বেড়েছে। ঠিক যেমন কলেজের ক্যাম্পাসিং থেকে পাওয়া সাংবাদিকতার চাকরি পাঁচ বছরের মাথায় হুট করে ছেড়ে দিলেন বছর ২৬-এর ঋদ্ধিমান দত্ত। নিন্দকেরা বলবেন, এই বয়সেই এত ক্লান্তি? করবেটা কী ছেলে? এই মুহূর্তে উত্তর প্রস্তুত নেই তাঁর মুখেও। কারণ, ঋদ্ধিমান কেবল নিজের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। কিছু দিন বিশ্রাম চান। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এত দিন যা করেছেন, সারা জীবন সে কাজটাই করতে চান? জানতে হলে সময় দিতে হবে। হয়তো আর মিডিয়া নয়, পড়াশোনা করবেন, সরকারি চাকরি খুঁজবেন। অথবা আবার মিডিয়াতেই ফিরবেন। কিন্তু না জেনে-বুঝে দৌড়তে চান না আর।’’ তবে ঋদ্ধিমানের মনে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তাও ভিড় করে রয়েছে। খুব বেশি দিন ঠায় বসে থাকতে যে পারবেন না, তা জানেন। তাই পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হতে চাইছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

ইতিমধ্যে নিজের পথ খুঁজেও পেয়েছেন বছর ৩০-এর ক্রুতিকা নাগানন্দা। স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়ার পরে স্থপতি হিসাবে কাজ করছিলেন একটি সংস্থায়। কিন্তু মনে হয়েছিল সমাজের জন্য কিছু করতে চান। তাই স্থপতির কাজটি ছেড়ে দেন। বছরখানেক অবসরের পর পরিবেশ নিয়ে লেখাপড়া করতে চলে যান বিদেশে। এখন একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তিনি।

নতুন যুগে দাঁড়িয়ে এমন অনেক জিনিস মানুষ পেয়েছে, যা আগে ছিল না। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক কাঠামো বদলানোর ফল হিসাবেও খানিক পরিবর্তন এসেছে কাজের ধরনধারণে। চাকরি ছেড়ে দিলেও তাঁরা জানেন, কিছু না হোক, ডিজিটাল মাধ্যমকে অবলম্বন করেও রোজগার করা যায়। প্রযুক্তিকে দূরে ঠেলে না দিয়ে, শখপূরণ করেছেন হিন্দমোটরের প্রত্যয় চক্রবর্তী (৩০)। আইনের ফার্মে দু’বছর চাকরি করার পর আরও দেড় বছর মতো অধ্যাপক হিসাবে একটি কলেজে কর্মরত ছিলেন। তার পর সব ছেড়ে দেন। নিজেকে সময় দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন। প্রায় এক বছর। এখন এক বন্ধুর সঙ্গে অডিয়ো স্টোরির চ্যানেল তৈরি করেছেন।

তবে এমন অবসর যে শুধুই কম বয়সে নেওয়া হচ্ছে, তেমন নয়। ৪০ অথবা ৫০ পেরিয়েও ক্ষণিকের অবসর নিয়ে নিজের জীবনকে অন্য ভাবে যাপন করছেন কেউ কেউ। বছর ৪০-এর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রচনা রায় গত ১৮ বছর ধরে বাঁধাধরা চাকরিজীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি সুযোগ দেওয়া হয় ক্ষণিকের অবসরের, সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কি নিতে পারবেন তিনি? রচনা বলছেন, ‘‘আমি বা আমার বন্ধুবান্ধবের জন্য ক্ষণিকের অবসর নিয়ে নেওয়াটা বোধহয় ততটাও সহজ নয়। কারণ, আমরা যে সময়ে বড় হয়েছি, তখন এত সুযোগসুবিধা ছিল না। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে এত প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না কর্মজীবন। আমরা অতটাও পারদর্শী ছিলাম না সে সব বিষয়ে। এমনকি এখনও কর্মক্ষেত্র ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার নিয়ে ছোটদের থেকে কম পটু। ফলে এখন এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলে হাজার চিন্তা মাথায় ঘুরবে। মনে হবে, আদৌ পারব কি না, আমাদের জন্য উপযুক্ত কাজ আর আছে কি না, বা যদি হোঁচট খাই, তা হলে ফের উঠে দাঁড়ানোর সময়টা আছে কিনা, কতটা শিখে উঠতে পারব, কারণ সব বয়সের জন্য সব কাজ এখনও সহজলভ্য নয়।’’ তাঁদের বয়সের কেউ কি ভ্লগিং বা ব্লগিংকে পেশা কি বানাননি? বানিয়েছেন। চাকরি ছেড়ে অবসরও নিয়েছেন। কিন্তু অনেকের পক্ষে তা আয়ত্ত করে নেওয়া সহজ নয়। তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আমরা যে প্রজন্মের মানুষ, আমাদের উপর নানা ধরনের দায়িত্ব চলে এসেছে। আগের প্রজন্ম আমাদের উপর নির্ভরশীল এখন। আমাদের পরের প্রজন্মও চলে এসেছে। তাদের বড় করে তোলার দায়িত্ব আছে। যাঁদের সঙ্গীরা অথবা বাবা-মায়ের আর্থিক জমি শক্ত, তাঁদের ক্ষেত্রটা আলাদা৷’’

অবসর কি কেবল ৯-৫টার চাকরির ক্ষেত্রেই দরকার? শিল্পীদেরও কি মানসিক ক্লান্তি আসে না? ধারাবাহিকে অভিনয় করা তো প্রায় সরকারি চাকরির মতোই। রোজের অফিস (পড়ুন সেট) যাওয়া, কাজ (পড়ুন অভিনয়) করা, বাড়ি ফেরা, আবার এক রুটিন। অভিনেত্রী দিতিপ্রিয়া রায়ের বয়স প্রায় ২২। খুব কম বয়স থেকে রোজগার করে সংসার চালানোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। প্রথম ধারাবাহিক ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’তে অভিনয় করতে করতে মেকআপ রুমেই বসেই দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতি চলত। তবে ২০২১ সালে ধারাবাহিক শেষ হওয়ার পর কর্মবিরতি নিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে অন্য কাজে ঢোকেননি। আনন্দবাজার ডট কম-কে দিতিপ্রিয়া বলছেন, ‘‘এমন বহু বার হয়েছে, বিরতি নিয়ে ঘুরতে গিয়েছি অনেক দিনের জন্য অথবা নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। যেমন ফরাসি ভাষা শেখা শুরু করেছিলাম।’’ কিছু দিন বিরতি নিয়ে তার পর আবার নতুন ধারাবাহিক শুরু করি। অবসর কাটিয়ে আবার কাজ শুরু হয় তাঁর। এবং সেই বিরতির সময়টা খুব প্রয়োজন বলে মনে করেন অভিনেত্রী।

তবে শিল্পজগতের ফ্রিলান্সারদের বিষয়টা সব ক্ষেত্রে সমান নয়। অনেকেরই ভয়, একটা কাজ ফিরিয়ে দিলে পরের কাজটা আসবে তো? ফলে আদৌ কতটা অবসর নেওয়ার অবকাশ রয়েছে, তা তর্কসাপেক্ষ। গতি কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি দৌড় চালিয়ে যেতে চান কেউ কেউ। যেখানে অবসরের প্রয়োজন পড়বে না, দৌড়েও আনন্দ অসীম। যেমন ধরে নেওয়া যাক টলিউডের আরও দুই শিল্পী ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় এবং অরিত্র দত্ত বণিক। আনন্দবাজার ডট কম-কে ঋতব্রতর স্পষ্ট উত্তর, যেই কাজটি ভালবাসেন, তার থেকে দূরে থাকতে চান না তিনি। খুব তাড়াতাড়ি অভিনয়ে ক্লান্তি আসবে বলে মনে হয় না তাঁর। অরিত্র আবার বলছেন, ‘‘পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলির সঙ্গে তুলনা করলে, নতুন প্রজন্মের মধ্যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। পারিবারিক দায়বদ্ধতা বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন খানিকটা হলেও এখন কম। যেমন আমার বাবা তাঁর বাবার মতোই সারা জীবন একটি চাকরি করে চলেছেন। সেই ৬০-এর পরে গিয়ে অবসর নেবেন। কিন্তু আমি হয়তো সেটা করব না। নানা ধরনের কাজ করতে করতে ৪০-৪৫ বছর বয়সের পর আর রোজগারের তাগিদে দৌড়ব না। কারণ, আমার প্রজন্মের বাকিদের মতো অনেক কম বয়স থেকে সঞ্চয় নিয়ে ভাবা শুরু করেছি আমিও।’’

অরিত্রের সঙ্গে একমত ৪০ না পেরোনো অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, নিজের সঞ্চয় ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক বেশি সচেতন এখনকার প্রজন্ম। ফলে হঠাৎ এক দিন চাকরি না থাকলে কী করবেন, তা তাঁরা আগে থেকে ভাবেন। ফলে ক্ষণিকের অবসর নিতেও ততটা ভয় পান না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement