Fashion

Sabyasachi Mukherjee: ৫০০ টাকার শাড়ি এইচএনএম-এ ১০ হাজারে বেচছেন সব্যসাচী? বেশ করছেন!

বিশ্ব ফ্যাশনে এইচএনএম অতি পরিচিত নাম। তার সঙ্গে হাত মেলানোর পর থেকেই দেশজুড়ে হইহই ফেলে দিয়েছেন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

পৃথা বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২১ ১১:৩৩
Share:

এইচএনএম’এ সব্যসাচীর পোশাক। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

সব্যসাচীর মুখোপাধ্যায়ের পোশাক পাওয়া যাবে এইচএনএম-এ! প্রচারে বলা হয়েছিল, ১২ অগস্ট থেকে অনলাইনে অর্ডার করা যাবে সেই পোশাক! যাঁরা কোনও দিন সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’-এর লোগো দেওয়া রুমালও কিনতে পারতেন না, তাঁরাই হঠাৎ সুযোগ পেয়ে গেলেন দীপিকা-অনুষ্কা হওয়ার। হাতের মুঠোয় (থুড়ি, মাউসের ক্লিকে) চলে এল স্বপ্নপূরণের রাস্তা।

কিন্তু শেষমেষ হল স্বপ্ন পূর্ণ হল কি? ১২ অগস্ট দেখা গেল প্রত্যেকটি সাইটে সব্যসাচীর পসরার সব পোশাক নিমেষে উধাও! নিজের মাপের জামা বেছে কার্টে ফেলতে না ফেলতে সব ‘সোল্ড আউট’! ব্যাস চারদিক তোলপাড়!

কথায় আছে আঙুর ফল টক। অতএব, নেটমাধ্যম ছেয়ে গেল সব্যসাচীর এইচএনএম-এর পোশাকের মিমে। কেউ বলছে ৫০০ টাকার শাড়ি বাঙালির ঘরে ঘরে পড়ে থাকে, তারই দাম ১০ হাজার টাকা! কেউ বলছে বাস কন়ডাক্টর কিংবা নিরাপত্তারক্ষীর ইউনিফর্মের মতো ছেলেদের পোশাক। এত দাম দিয়ে কেউ কেনই বা কিনবে (হাজার হাজার মানুষ যে হামলে পড়ে ইতিমধ্যেই কিনে ফেলেছেন, সেটা অন্য কথা)!

Advertisement

সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়

তার পর এলেন নেটমাধ্যমের ‘প্রভাবী’-রা। তাঁরা হঠাৎ সব্যসাচী কেন এইচএনএম-এর মতো এক ব্র্যান্ডের সঙ্গে হাত মেলালেন, তা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ জুড়লেন। এই ব্র্যান্ড পরিবেশবান্ধব নয়, শ্রমিক শোষণের সঙ্গে যুক্ত, জামাকাপ়ড় বার বার বদলে ফেলার ইন্ধন জোগায় (যার পোশাকি নাম ‘ফাস্ট ফ্যাশন’) ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন এমন ঘৃণ্য নামের সঙ্গে যোগ দিলেন আমাদের প্রিয় ডিজাইনার, তা নিয়ে নানা কাটাছেঁড়া চলতে থাকল। মজার কথা, এই প্রভাবীরাই কিন্তু ২০১৫ সালে এইচএনএম-এর বাইরে লাইন দিয়ে সস্তার নিম্নমানের উল-মেশানো কোট কিনেছিলেন। যখন ফরাসি লাক্সারি ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘বালমা’ হাত মিলিয়েছিল।

প্রভাবীদের পর এলেন কারিগরদের হয়ে কথা বলার জন্য বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের অভিযোগেরও লম্বা তালিকা। কেন ভারতীয় কারিগররা এই পোশাক বানায়নি, কেন তাদের আর্থিক অনটনের ভার সব্যসাচী নেননি, কেন জিআই ট্যাগ মারা সাঙ্গানের এলাকার ডিজাইন ব্যবহার করার পর সেখানকার কারিগররা তাদের হকের টাকা পায়নি, কেন হাতে আঁকা ডিজাইন ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছাপা হয়েছে— আরও নানা অভিযোগ জানিয়ে খোলা চিঠি লিখে ফেললেন তাঁরা।

Advertisement

কারিগরদের অধিকার চেয়ে বিশিষ্টজনেদের খোলা চিঠি।

একজন ভারতীয় (বাঙালিও বটে) ডিজাইনার তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি খাটিয়ে সাফল্যের চূড়ায় বসে রয়েছেন, তাঁকে ঘিরে নানা অভিযোগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গোলমেলে বিষয় হল, কখন এই অভিযোগগুলি উঠছে। এইচএনএম-এর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন সব্যসাচী, সেই খবর জানা গিয়েছিল গত বছরেই। এই এক বছরে ব্র্যান্ডের চরিত্র পাল্টে যায়নি। এইচএনএম বরাবরই ‘স্ট্রিট ফ্যাশন’। সস্তায় জামাকাপড় কেনো এবং মরসুম বদলাতেই পোশাকও বদলে ফেলো। ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ যাকে বলে। কিন্তু সব্যসাচীর পোশাকগুলি ‘সোল্ড আউট’ হওয়ার পরই হঠাৎ এই হাহাকারের শুরু হল কেন, তা ভেবে দেখার বিষয়।

বিশিষ্টজনদের খোলা চিঠির উত্তর সব্যসাচী অবশ্য ইতিমধ্যেই দিয়েছেন ইনস্টাগ্রামে। তিনি মনে করেছেন, তাঁর হাত ধরে ভারতীয় নকশা, শিল্প এবং হাতের কাজের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে গোটা দুনিয়ায়। কিংবা এই পোশাকগুলির মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ভারত মানেই যে শুধু সস্তার শ্রমিক নয়, এখানকার ডিজাইনই আসল— সে সব বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি এ-ও আশা করেছেন যে, তাঁর এই পোশাকের ডিজিটাল নকশাগুলি দেখে বিশ্বের মানুষ আসল শিল্পের খোঁজ করবেন।

সব্যসাচীর উত্তর।

তাঁর আশা কতটা পূরণ হবে, সেই নিয়ে তর্কে না গিয়ে আসল বিষয়ে আসা যাক। যে কোনও ডিজাইনারই এইচএনএম-এর মতো কোনও প্রস্তাব লুফে নেবেন। অতিমারিতে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। সেখানে যদি বাড়তি আয়ের এমন সুবর্ণ সুযোগ থাকে, তা হলে তা ফিরিয়ে দেওয়াটাই বোকামো। এর আগে সব্যসাচী যে সব ব্র্যান্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, সবই ছিল লাক্সারি ব্র্যান্ড। কোনওটা ‘ক্রিশচিয়ান লুবতিঁ’, কোনওটা আবার ‘পটারি বার্ন’। এই ব্র্যান্ডগুলি হাতে গোনা মানুষই কিনতে পারেন। সেখানে এইচএনএম-এর বিস্তার তুলনায় অনেক গুণ বেশি। যে কোনও ডিজাইনারই চাইবেন, তাঁর পোশাক আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে (অবশ্যই নিজের ব্যবসার ক্ষতি না করে)। ‘সব্যসাচী’ ব্র্যান্ডের বাকি পোশাকের ক্ষেত্রে কারিগররা কী ভাবে টাকা পান, লাভের কতটা তাঁদের পকেটে যায়, ডিজাইনারের গোটা বিজনেস মডেল আদপে কেমন, কেউ কি সেগুলি পরিষ্কার ভাবে জানেন? তা হলে হঠাৎ এই সময়ই এত হট্টগোল কেন!

সব্যসাচীর পোশাকে দীপিকা পাড়ুকোন এবং অনুষ্কার শর্মার কনে সাজ।

ভারতীয় কারিগরি, ভারতীয় হাতে তৈরি পোশাক মানেই কিন্তু পরিবেশবান্ধব নয়। সব্যসাচী কখনওই বলেননি, তাঁর ব্র্যান্ড পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কাজ করে। তাই এইচএনএম কতটা পরিবেশবান্ধব হল কি হল না, তাতে তাঁর কিছু যাওয়া-আসার কথা নয়। এর পর আসা যাক ডিজিটাল প্রিন্ট এবং হাতের কাজকে ‘মাস প্রোডাকশনে’ রূপান্তরিত করার অভিযোগে। গোটা ভারতে খুব কম ডিজাইনারই রয়েছেন, যাঁরা নিজের ‘কুতিঁয়র’ পোশাকেরও লাইন প্রোডাকশন শুরু করতে পেরেছেন। বিদেশে অবশ্য এই ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম নাম ‘স্যালভাটোরে ফেরাগামো’। যারা হাতে তৈরি জুতোরও লাইন প্রোডাকশনের উপায় বার করে ফেলেছে।

সব্যসাচী তাঁর লেহঙ্গা বা শাড়ির ক্ষেত্রে তা পেরেছেন। এবং বহু আগেই পেরেছিলেন। বহু বছর ধরেই তিনি প্রত্যেক মরসুমে একই রকম পোশাকের নতুন পসরা নিয়ে আসেন। নকশাগুলি কিন্তু এক। প্রিন্টও এক। সকলে অবশ্য বলবেন ‘সিগনেচার স্টাইল’। আসলে সব্যসাচী যত বড় ডিজাইনার, তার চেয়েও বড় ব্যবসায়ী। একই পোশাক কী ভাবে বহু দিন ধরে বিক্রি করতে হয়, তা বোঝেন তিনি। অবশ্য অন্য কিছু করার তেমন প্রয়োজনও পড়েনি। অনুষ্কা শর্মা বিয়েতে যে লেহঙ্গা পরেছিলেন, হুবহু সেই লেহঙ্গার চাহিদা চার বছর পরও তুঙ্গে। দীপিকা পাড়ুকোনের প্রিন্টেড ফ্লোরাল শাড়ি দেখে যিনি সব্যসাচীর শাড়ি কিনতে যান, তার একটি ফুলও এদিকে-ওদিক হলে চলবে না।

সব্যসাচীর এইচএনএম’এর কাফতানে আলিয়া ভট্টের সাজ।

সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় ফ্যাশন মহলে এক ঈর্ষণীয় নাম। চন্দননগরের ছেলে যখন সদ্য এনআইএফটি পাশ করে ২০০২ সালে ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’-এর মঞ্চে সা়ড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তখন সকলে প্রচুর বাহবা দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু কেউ ভাবতে পারেননি, এক দিন এই ছেলেই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সংজ্ঞা নিজের মতো করে তৈরি করবেন। সব্যসাচী বরাবরই তাঁর লক্ষ্যে স্থির। নিজের কাজ মন দিয়ে করেন। কাউকে তোয়াক্কা করেন না। যে আমলে সকলেই বলিউডে ডিজাইন করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন, সেই সময়ে তিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নিজের লেবেলে মনোযোগ দিয়েছেন। যে মঞ্চে কার শো-স্টপার কত বড় খ্যাতনামী, তা নিয়ে একটা চাপা লড়াই চলতে থাকে। সেখানে সব্যসাচী জোর গলায় বলেছেন, তিনি মডেল ছাড়া অন্য কোনও বলিউড অভিনেত্রীকে শো-স্টপার করবেন না। রানওয়ে সাজান নিজে, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি নিজে দেখেন। খুঁতখুঁতে ‘পারফেকশনিস্ট’ হওয়ার বদনাম থাকা সত্ত্বেও নিজের ব্যবসায় কোনও রকম ক্ষতি হতে দেন না। বিয়ের বাজারে সব্যসাচীর লেহঙ্গার যা চাহিদা, তার ধারেকাছে আর অন্য কোনও ডিজাইনার ঘেঁষতেও পারবেন না। তাই হঠাৎ তাঁর নাম শুধু ভারতীয় বা এনআরআই বিয়ের বাজারে সীমিত না থেকে বিশ্বজুড়ে শৌখিনীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে, তা কি চুপচাপ মেনে নেওয়া যায়? অগত্যা চেনা পথে হাঁটা— অনলাইন ট্রোলিং।

১০ হাজার টাকার শাড়ি নিয়ে ক্ষোভ নেটমাধ্যমে।

যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ— এইচএনএম-এর পসরায় একটি শাড়ি রেখেছেন সব্যসাচী। বিশ্ব ফ্যাশনে সেটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক বলে মনে করেছিলেন ডিজাইনার। নেটাগরিকরা অবশ্য বলেছেন, ‘বাঙালির ঘরে ঘরে এই শাড়ি রয়েছে। কাচার পর নরম হয় যায়। শেষে রান্নাঘরের ন্যাতা হয়। ৫০০ টাকার শাড়ি আমি কেন ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিনব?’

প্রশ্নটা কেন কিনবেন তা নয়, আসলে প্রশ্ন হল—কে কিনতে বলেছে? পোশাকের দাম কম রাখার দায় কোনও ডিজাইনারেরই নেই। কারও সামর্থ্য না থাকলে, কিনতে ইচ্ছে না করলে কিনবেন না। কেউ তো কাউকে বাধ্য করেননি। সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের পোশাক পরে বিয়ে হবে, এমন স্বপ্ন বহু মেয়ে (অবশ্যই উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমাদের পাশের বাড়ির নয়) দেখে থাকেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অত লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বিয়ের লেহঙ্গা কিনতে পারেন না বলে দু’-তিন লক্ষ নিয়ে দিল্লির চাঁদনি চকে সব্যসাচীর ‘ফার্স্ট কপি’ খুঁজতে দৌড়োন। কিন্তু এইচএনএম-এর সঙ্গে হাত মেলানোর পর ‘অরিজিন্যাল সব্যসাচী’ কিনতে পারছে আমার-আপনার পাশের বাড়ির মেয়েটিও। কয়েক হাজার টাকা খরচ করে সে যদি নিজেকে দীপিকা কিংবা অনুষ্কার সঙ্গে মেলাতে পারে, তা হলে তার একটা বাড়তি মূল্য তো হবেই। তাই যতই দাম রাখুন সব্যসাচী, বেশ করেছেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement