এখন অনেক বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে বাচ্চাদের টিফিনের টাইম টেবিলও দিয়ে দেওয়া হয়। রোজ তা মিলিয়ে টিফিন আনতে হয়। ছবি: সংগৃহীত
সোমবার উপমা, মঙ্গলবার আলুর পরোটা আর রায়তা, বুধবার ভেজ স্যান্ডউইচ আর ফল, বৃহস্পতিবার নুডল্স। শুক্রবার বাড়িতে তৈরি ভেজ রোল আর দই কিংবা মিষ্টি।
এ কোনও খ্যাতনামীর ডায়েট চার্ট নয়। বাচ্চাদের স্কুলের টাইম টেবিল। তবে পড়াশোনার নয়, টিফিনের। স্কুলের নতুন ক্লাসের পড়াশোনা শুরু করার সময়ে যেমন কবে কোন বই আনতে হবে, সেই টাইম টেবিল ধরিয়ে দেওয়া বাচ্চাদের, এখন অনেক বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে বাচ্চাদের টিফিনের টাইম টেবিলও দিয়ে দেওয়া হয়। রোজ তা মিলিয়ে টিফিন আনতে হয়।
পাঁচ-ছয় বছর আগেই মায়েরা এই নির্দেশিকা হাতে পেলে হয়তো মুখ বেঁকিয়ে ফেলে দিতেন। সন্তানকে কী খাওয়ানো হবে, কী হবে না, কী খেলে সে ভাল থাকবে তা দেখার দায়িত্ব এখনও মূলত মায়েরই। অন্য কেউ সে দায়িত্ব নেবে, সে কথা মায়েরা ভাবতে পারতেন না। কিন্তু এখন আর মায়েরা এই নতুন ব্যবস্থায় খুব বেশি বিচলিত হন না। জীবনের সব ক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনই স্কুলগুলিতেও বাচ্চাদের সামগ্রিক বিকাশের জন্য পুষ্টিকর সুষম খাবার জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব হঠাৎ স্কুল কেন নিচ্ছে? মায়েদের উপর কি ভরসা উঠে গেল?
বাইপাসের ধারে এক ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এ বিষয়ে জানালেন, অনেক ভেবেচিন্তেই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বললেন ‘‘বেশ কিছু বছর ধরে আমরা দেখছিলাম বাচ্চারা টিফিনের বেশির ভাগ ইনস্ট্যান্ট নুড্লস কিংবা চিপস আনছে। সকলে না হলেও বেশ অনেকে। যাঁরা সাধারণ বাড়ির খাবার আনছে তারাও পাশের জনের টিফিনে কেক-প্যাস্ট্রি দেখে সেই দিকেই ঝুঁকছে। তাতে বাচ্চাদের খাবার খাওয়ার ধরন পুরো বদলে যাচ্ছিল। খেলার মাঠেও দেখা যেত খুব একটা এনার্জি পেত না তারা। সব দিক বিবেচনা করেই একটা ধরাবাঁধা নিয়ম তৈরি করে দিই আমরা। যাতে বাবা-মায়েরাও সেই শৃঙ্খলা মেনে বাচ্চাদের পুষ্টিকর টিফিন দেওয়ার অভ্যাস তৈরি করেন।’’
জীবনের সব ক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনই স্কুলগুলিতেও বাচ্চাদের সামগ্রিক বিকাশের জন্য পুষ্টিকর সুষম খাবার জায়গা করে নিয়েছে।
একই কথা বললেন মধ্য কলকাতার এক বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকও। তাঁর কথায়, ‘‘একই রকম টিফিনের নিয়ম কিন্তু এক দিক থেকে ভালই। বাচ্চারা যেমন একই ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসে, তেমনই একই রকম টিফিন আনবে। এতে কারও মনে কোনও রকম ক্ষোভ থাকবে না যে, বন্ধু সব সময়ে আমার চেয়ে ভাল টিফিন আনে। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাসও তৈরি হবে সকলের মধ্যে।’’
কিন্তু টিফিন বেঁধে দেওয়ার নিয়ম কি শুধুই সাম্য তৈরির জন্য? না কি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনও কারণ? সল্টলেকের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষিকা বললেন, ‘‘এখন বেশির ভাগ বাড়িতেই মায়েরা রোজ অফিস যান। তাঁরা অফিসের চাপে প্রত্যেক দিন বাচ্চাদের রকমারি টিফিন তৈরি করে দিতে পারেন না। তাঁদের জন্য টিফিনে একটা লাড্ডু আর একটি চিপ্সের প্যাকেট দিয়ে দেওয়াটা অনেক বেশি সুবিধার। কিন্তু এ ভাবে দিনের পর দিন জাঙ্ক ফুড খেলে তো বাচ্চাদের শরীরে তার প্রভাব পড়বে। সেই কারণেই অনেক স্কুল এমন নিয়ম বেঁধে দেয়।’’
বাচ্চাদের খাবার খাওয়ার ধরন পুরো বদলে যাচ্ছিল। খেলার মাঠেও দেখা যেত খুব একটা এনার্জি পাচ্ছে না তারা।
রোজ অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রভাব যে ইতিমধ্যেই বাচ্চাদের উপর পড়া শুরু করে দিয়েছে তা জানালেন পুষ্টিবিদ এবং যাপন সহায়ক অনন্যা ভৌমিক। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় ১০ বছর হল আমি কাজ করছি। আগে আমার ক্লায়েন্টদের ১০ জনের মধ্যে এক জন বাচ্চা থাকত হয়তো। এখন সেই সংখ্যাটা বেড়ে তিন থেকে চার হয়ে গিয়েছে। চাইল্ড ওবেসিটিও ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে গিয়েছে। কোভিডের পর বিশেষ করে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। গোটা লকডাউনে তারা বাড়িতে বসে যা ইচ্ছা খেয়েছে। এবং সেই তুলনায় কোনও এক্সারসাইজও করেনি। তাই গত দু-আড়াই বছরে স্থূলতার সমস্যা অনেক বেশি ছেয়ে গিয়েছে। সব সময়ে মায়েরা অস্বাস্থ্যকর খাবার টিফিনে দিচ্ছে তা নয়। এমন অনেক বাচ্চা আমার কাছে আসে যাদের মায়েরা হয়তো বলছেন, সারা দিনে বাচ্চাকে সবই সিদ্ধ খাবার দেওয়া হয়। তা-ও তারা মোটা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বাচ্চাদের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে দেখেছি তারা বেশির ভাগ খাবার বাড়ির বাইরেই খায়। টিফিনে তাকে যতই সিদ্ধ খাবার দেওয়া হোক, তারই পাশে বসে হয়তো আরেক জন পিৎজা খাচ্ছে। তখন সে-ও পিৎজা খাওয়ার দিকেই ঝুঁকবে। তাই সকলের এক রকম রুটিন করে টিফিন বেঁধে দেওয়াটা এক দিক থেকে সুবিধাজনক।’’
যে মায়েরা বাড়ি এবং অফিস সামলে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, আঙুল কি তা হলে তাঁদের দিকেই উঠছে? সল্টলেকের পাঁচ লম্বর সেক্টরে কর্মরত এক আইটিকর্মী তানিয়া অধিকারী এ বিষয়ে বললেন, ‘‘আমার বাচ্চার বয়স আড়াই বছর। তাকে এক নামী-দামি প্রি স্কুলে দিয়েছি। সেখানে এক দিন রাগির ইডলি, এক দিন স্যালাড, এক দিন মুগ ডালের পরোটা— এ সব রকমারি খাবারের তালিকা দেওয়া হয়েছে। আমার বানিয়ে দিতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আড়াই বছরের বাচ্চার কি এ সব খেতে ভাল লাগে? তাকে তো তার মতো খাবার দিতে হবে। কত বাচ্চার কত খাবারে অ্যালার্জি থাকে, পছন্দ-অপছন্দ থাকে। সব কিছু না জেনে এ সব নিয়ম চাপিয়ে দিলে আদতে কতটা লাভ হবে?’’
এক এক রকম পরিবারের একেক রকম খাদ্যাভ্যাস। কাউকে হঠাৎ করে তা বদলে ফেলতে বাধ্য করা কি উচিত?
তানিয়ার সঙ্গে এক মত শ্রুতি রেড্ডিও। শ্রুতি এবং তাঁর স্বামী দু’জনেরই বড় হওয়া কর্নাটকে। কর্মসূত্রে তাঁদের এখন কলকাতায় বাস। তাঁদের সাত বছরের মেয়ে নয়নতারা সদ্য স্কুল যাওয়া শুরু করেছে। গত দু’বছর বাড়ি থেকে অনলাইনেই ক্লাস করত সে। তাই বাড়িতে রোজ দুপুরে ভাত, সম্বর, কার্ড রাইস আর কোনও এক ধরনের তরকারি খেয়েই অভ্যস্ত সে। হঠাৎ স্কুলে গিয়ে নানা রকম খাবার খেতে তার বেশ অসুবিধাই হয়। বেশির ভাগ দিন না খেয়েই টিফিন ফিরিয়ে আনে নয়নতারা। শ্রুতির কথায়, ‘‘এক এক রকম পরিবারের একেক রকম খাদ্যাভ্যাস। কাউকে হঠাৎ করে তা বদলে ফেলতে বাধ্য করা অন্যায়। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সত্যিই জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে এত রকম মানুষের বাস। তাদের খাবারদাবারও আলাদা। অন্তত সেই পার্থক্যগুলো মাথায় রাখা উচিত স্কুলগুলোর।’’