Coronavirus

অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডির কাজ কী?

এরা আসলে কী? শরীরে এরা কাজই বা করে কী ভাবে? কিছু অসুখে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে দেন চিকিৎসকরা। সেই টেস্ট কেন করা হয়, জেনে নিন বিশদেকিছু অসুখে চিকিৎসকরা অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি টেস্ট করার পরামর্শও দিচ্ছেন। এই পরীক্ষারই বা প্রয়োজন কোথায়? জানব একে একে।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share:

গত কয়েক মাস ধরে ‘নিউ নর্মাল’ আলোচনায় ঢুকে পড়েছে ‘অ্যান্টিজেন’, ‘অ্যান্টিবডি’, ‘ইমিউনিটি’র মতো শব্দগুলো। প্রত্যেক দিনের খবরেই তা নজর কাড়ছে। করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় এই প্রত্যেকটি শব্দই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এদের কি আমরা সম্পূর্ণ ভাবে চিনি? অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি আসলে কী? কিছু অসুখে চিকিৎসকরা অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি টেস্ট করার পরামর্শও দিচ্ছেন। এই পরীক্ষারই বা প্রয়োজন কোথায়? জানব একে একে।

Advertisement

অ্যান্টিজেন কী?

Advertisement

এটিকে ফরেন প্রোটিন বা নন-সেল্ফ প্রোটিন বলা যেতে পারে। আগে বুঝতে হবে, কোনগুলো সেল্ফ আর কোনগুলো নন-সেল্ফ। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘শরীরে হাড়ের প্রোটিন, চামড়ার প্রোটিন সবই আলাদা। সন্তান যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখন থেকেই তার শরীর চিনতে শুরু করে কোনটা তার নিজের আর কোনটা নয়। এ বার নিজের শরীরের বাইরের প্রোটিন (সে হতে পারে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, প্যারাসাইটস) শরীরে প্রবেশ করলেই শরীর রিঅ্যাক্ট করে। কারণ সেটা তো নন-সেল্ফ প্রোটিন। শরীর তাকে চেনে না। এই প্রোটিনকেই শরীর অ্যান্টিজেন হিসেবে গণ্য করে।’’

ভাইরাস নিজে থেকে কিন্তু মাল্টিপ্লাই হতে পারে না। হোস্ট অর্থাৎ আক্রান্তের শরীরের বাইরে সে বংশবিস্তার করতে পারে না। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরে ওর জেনেটিক মেটিরিয়াল আমাদের কোষে ঢুকিয়ে দেয়। তার পর আমাদের কোষের প্রোটিন তৈরির মেশিনারি কাজে লাগিয়ে ও নিজস্ব কপি তৈরি করতে শুরু করে। এটাই ভাইরাসের জীবনচক্র। এই ভাইরাসের প্রোটিনকে শরীর অ্যান্টিজেন হিসেবে গণ্য করে। করোনার যেমন স্পাইক প্রোটিন।’’

অ্যান্টিবডি কী?

অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করার জন্য পাঁচ রকমের প্রোটিন আমাদের শরীরে তৈরি হয়ে থাকে। এদের বলা হয় ইমিউনোগ্লোবিউলিনস (আইজি), যাকে এক কথায় অ্যান্টিবডি বলা হয়। ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘প্রত্যেক দিনই একাধিক ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়ার সংস্পর্শে আমরা আসি। এই ইমিউনোগ্লোবিউলিনস তাদের প্রতিরোধ করে। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত, আইজিএ, আইজিডি, আইজিই, আইজিজি এবং আইজিএম। আমাদের শরীরে কোনও অ্যান্টিজেন প্রবেশ করলেই শরীর সতর্ক হয়ে যায়। তখন সেই অ্যান্টিজেন ধ্বংস করতে প্রথমেই যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাকে বলে আইজিএম। কিন্তু তার আয়ু কম। তাই সেটা কপি করে অন্য একটি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যাকে বলে আইজিজি। এই প্রোটিন কিন্তু অনেক দিন ধরে শরীরে সেই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ বার আমাদের শরীরের চোখ, নাক, শ্বাসনালির মতো অংশে অর্থাৎ যেখানে সিক্রেশন হয়, সেখানে আর একটি অ্যান্টিবডি থাকে, আইজিএ। শরীরকে চার দিক থেকে কিন্তু এই ইমিউনোগ্লোবিউলিনস পাহারা দিয়ে রাখে।’’ এ ছাড়া আরও দু’টি অ্যান্টিবডি থাকে আইজিই ও আইজিডি। কোনও কিছু থেকে অ্যালার্জি হলে বা পোকায় কামড়ালে দেখবেন সে জায়গাটা ফুলে লাল হয়ে যায়। যেমন, মশা কামড়ালে সেখানটা লাল হয়ে যায়। কারণ মশার লালারস থেকেও অ্যান্টিজেন প্রবেশ করে। তখন সেখানে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে তাকে বাধা দেয়, এটি হল আইজিই। আইজিডি অন্যান্য আইজির কার্যকারিতায় সাহায্য করে।

অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডির বিক্রিয়া

কোভিড-১৯কে উদাহরণ হিসেবে নিলে, করোনার স্পাইক প্রোটিন শরীরে ঢুকলে শরীরও অ্যান্টি-স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করে দেয়। ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘অ্যান্টিজেনের প্রবেশের পরে শরীর যখন অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তখন তাকে বলে অ্যাক্টিভ ইমিউনিটি। যখন শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না, তখন বাইরে থেকে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে সরাসরি অ্যান্টিবডি দেওয়া হয়। একে বলে প্যাসিভ ইমিউনিটি। মায়ের গর্ভে শিশুও মায়ের শরীর থেকে অ্যান্টিবডি গ্রহণ করে, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু এটি প্যাসিভ ইমিউনিটি। আমাদের দেহের ইমিউনতন্ত্র জীবাণু থেকে ভ্যাকসিনের তফাত করতে পারে না। তাই ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে আমাদের দেহ আক্রান্ত ব্যক্তির ন্যায়ই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। ভ্যাকসিন প্রয়োগে অ্যান্টিবডি প্রাপ্তির সুবিধে হল, তাকে আক্রান্ত হয়ে রোগভোগ করতে হল না। কোভিডের মতো মারণরোগের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে অ্যাক্টিভ ইমিউনিটি তৈরিকে কাজে লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছে। প্যাসিভ ইমিউনিটিও কাজে লাগানো হচ্ছে, প্লাজ়মা থেরাপির মাধ্যমে। কিন্তু রোগী খুব ক্রিটিকাল অবস্থায় চলে গেলে প্লাজ়মা থেরাপি আর কার্যকর হচ্ছে না।’’

অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট কেন করা হয়?

কোনও ব্যক্তি জীবাণুবাহিত অসুখে আক্রান্ত কিনা, তা বোঝার জন্য দেখা দরকার তার শরীরে সেই অসুখের অ্যান্টিজেন আছে কি না! যদি অ্যান্টিজেন টেস্টে তা ধরা পড়ে, তা হলে বুঝতে হবে ভাইরাস ইতিমধ্যে শরীরে প্রবেশ করেছে। এ বার সেই ব্যক্তির শরীর সেই রোগ প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারছে কি না, তা দেখার জন্য করা দরকার অ্যান্টিবডি টেস্ট। ব্যাপারটা সহজ ভাবে বুঝিয়ে বললেন ডা. অরুণাংশু তালুকদার, ‘‘ধরুন, কারও ডেঙ্গি হয়েছে। জ্বর আসার তিন-চারদিনের মধ্যে এলে তাঁকে অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে দেওয়া হয়। যেমন এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন টেস্ট। কারণ এত কম সময়ে শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না। কিন্তু পাঁচ দিন পর থেকেই অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়। কারণ তত দিনে শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করে অ্যান্টিজেন ধ্বংস করতে শুরু করে। তাই পরীক্ষায় অ্যান্টিজেন ধরা না-ও পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে আইজিএম অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে দেওয়া হয়। কিন্তু ডেঙ্গি সেরে যাওয়ার এক বছর পরে রোগীর জ্বর হলে চিকিৎসক যদি সন্দেহ করেন ডেঙ্গি, তখন তাঁকে আইজিএম ও আইজিজি টেস্ট করতে দেওয়া হয়। এতে নতুন সংক্রমণ থেকে পুরনো সংক্রমণের পার্থক্য করা যায়।’’

করোনার ক্ষেত্রে সোয়্যাব টেস্ট করা হচ্ছে। লালারসের মাধ্যমে সেই টেস্ট করে দেখা হয় যে, এতে অ্যান্টিজেন আছে কি না। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রোগী জানেনই না যে তাঁর করোনা হয়েছে। কোভিড১৯-এ আক্রান্ত হয়ে হয়তো তিনি ঠিকও হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু টের পাননি। তার মানে সেই ব্যক্তির করোনা হয়তো উপসর্গহীন ছিল। শরীরে অ্যান্টিজেনের প্রবেশমাত্র দেহ সতর্ক হয়ে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট করলে ধরা পড়বে যে, তাঁর শরীরে এই অসুখের অ্যান্টিবডি আছে কি না। প্লাজ়মা থেরাপির আগেও ডোনারের (করোনায় আক্রান্ত হয়ে যিনি সেরে গিয়েছেন) শরীরে কতটা মাত্রায় অ্যান্টিবডি রয়েছে, েসটা দেখতেও এই পরীক্ষা করা জরুরি। তারপরে আক্রান্তের শরীরে প্লাজ়মা থেরাপি শুরু করা হয়।

শরীরকে সুস্থ রাখতে দিন-রাত প্রহরায় আছে অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিজেন ঢুকলে সে সজাগ হয়ে মোকাবিলা করতে শুরু করে দেয়। ফলে কোনও ওষুধ ছাড়াই কিন্তু প্রত্যেক দিন অজস্র ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়াকে পরাজিত করতে পারি আমরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement