জ্বরে আক্রান্ত আড়াই বছরের এক শিশু। ধূপগুড়ি হাসপাতালে শনিবার। ছবি: রাজকুমার মোদক
উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে তথ্য গোপন করার অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের তিন স্বাস্থ্য-কর্তাকে সাসপেন্ড করেছিলেন শুক্রবার। তার মধ্যে রয়েছেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার অমরেন্দ্র সরকার। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পরেও জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। কারণ, অমরেন্দ্রবাবুর জায়গায় যিনি এ দিন দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই নতুন সুপার সব্যসাচী দাস এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দেওয়া তথ্যের মধ্যেকার ফারাক। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের দেওয়া তথ্য, যার সঙ্গে এঁদের কারও সংখ্যা মিলছে না!
এই অবস্থায় তথ্য গোপন নিয়ে বিতর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিন জনের মধ্যে কে ঠিক?
এ দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নয়া সুপার সব্যসাচীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। সব্যসাচীবাবুর সামনে বসেই তিনি জানিয়ে দেন, “আমি এখান থেকে যে পরিসংখ্যান পেলাম, তাতে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে ২০৩ জন মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে গত ৩০ জুন পর্যন্তই মারা গিয়েছেন ১২০ জন।”
তখন সব্যসাচীবাবুও বলেন, “হ্যাঁ, জানুয়ারি থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনসেফ্যালাইটিস জনিত কারণে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ২০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে জুলাইয়েই মৃতের সংখ্যা ৮৩ জন। এ দিনও এক জনের মৃত্যু হয়েছে।”
এই তথ্য কিন্তু মানতে চাননি রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী কিংবা রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। কলকাতায় স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে শনিবার পর্যন্ত গোটা উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিক ফিভারে ১০৯ জন মারা গিয়েছেন। ৭ জুলাই থেকে হিসেব করলে (এই দিন থেকে এনসেফ্যালাইটিস হঠাৎ বেড়ে যায় বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর) শনিবার পর্যন্ত এনকেফ্যালাইটিক ফিভার বা জ্বরে মৃতের সংখ্যা ৬৯।
বিশ্বরঞ্জনবাবুর হিসেবের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন সুপারের হিসেব মিলছে না কেন? স্বাস্থ্য অধিকর্তার যুক্তি, “উত্তরবঙ্গের রিপোর্টে অনেক গরমিল ছিল। একই কেস একাধিক বার নথিভুক্ত হয়েছে। তাই অনেক বেশি দেখাচ্ছিল। আমরা সব কেটে ঠিক করেছি।” কিন্তু এটাই যদি সঠিক হবে, তা হলে দায়িত্ব নেওয়ার আগে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সুপারকে রাজ্য সরকারের পরিমার্জিত তথ্য দেওয়া হল না কেন, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
তথ্যের বিভ্রান্তি নিয়ে পরে সব্যসাচী দাস বলেন, “হিসেব মিলিয়ে দেখতে হবে, কোনটা ঠিক!”
মৃত্যু নিয়ে তৃতীয় হিসেবটি দেন উত্তরবঙ্গ সফরে থাকা রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এ দিন তিনি বলেন, “এখনও পর্যন্ত সরকারি হিসেবে জুলাইয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জ্বরে মারা গিয়েছেন ৭১ জন। তার মধ্যে ২১ জন জাপানি এনসেফ্যালাইটিস এবং বাকিরা অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস উপসর্গে মারা গিয়েছেন। বাকি কে কী বলছেন, তা জানা নেই।”
বস্তুত, চন্দ্রিমা শনিবার যে হিসেব দিয়েছেন, শুক্রবার সরকারি সূত্রে সেই সংখ্যাই সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া হয়। কিন্তু এ দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের নতুন সুপার নয়া তথ্য দেওয়ায় পরিস্থিতি বদলে যায়। তার পরেই বিশ্বরঞ্জনবাবু মুখ খোলেন। এবং পরে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও। চন্দ্রিমার সঙ্গে এখন উত্তরবঙ্গ সফরে রয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রাতে বলেন, “স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী যে হিসেবটা দিয়েছেন, সেটাই আসল হিসেব।”
শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত যিনি হাসপাতালের সুপার ছিলেন, সেই সাসপেন্ড হওয়া অমরেন্দ্র সরকার অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি ওয়ার্ড থেকে যে পরিসংখ্যান পেয়েছেন, সেই অনুযায়ী রিপোর্ট দিয়েছেন। দার্জিলিঙের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর ভৌমিকও সাসপেন্ড হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এখনই এটা নিয়ে কিছু বলার নেই। এটুকু বলতে পারি, মেডিক্যাল কলেজ যা তথ্য দিয়েছিল, তা-ই রাজ্য দফতরে পাঠিয়েছি। এখন সরকারি তরফে কোনও কৈফিয়ৎ চাওয়া হলে তখন জবাব দেব।”
এই অবস্থায়, এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতিতে লঘু করে দেখানোর আড়ালে কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে সন্দেহ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর। তিনি এ দিন সকালে উত্তরকন্যায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এবং উত্তরবঙ্গের সব জেলার বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেন। পরে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। রোগীর বাড়ির লোকজনের ক্ষোভের মুখেও পড়েন। কেন চিকিৎসায় গাফিলতি হচ্ছে, তা জানতে চান মন্ত্রী।
চন্দ্রিমা পরে বলেন, “স্বাস্থ্য দফতর ব্যর্থ নয়। কিছু আধিকারিক ইচ্ছাকৃত ভাবে, অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঘটনার ভয়াবহতা লুকিয়েছেন। তিন জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আরও কেউ তথ্য গোপন কাণ্ডে জড়িত রয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত করা হচ্ছে। দোষী প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাসপেন্ড হওয়া আধিকারিকরা রুটিন রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা কতটা ভয়াবহ, সেই ব্যাপারে আপৎকালীন রিপোর্ট পাঠাননি। আগে বিষয়টি জানা গেলে, এতগুলো মৃত্যু না-ও হতে পারত। সংবাদমাধ্যমেই প্রথম ঘটনার ভয়াবহতা জানতে পেরেছি।”
ঘটনা হল, চন্দ্রিমাদেবী ১৫ জুলাই উত্তরকন্যায় একটি বৈঠকে যোগ দেন। সরকারি সূত্রের খবর, তার আগে মেডিক্যাল ঘুরে এনসেফ্যালাইটিসের বিষয়টি যে উদ্বেগজনক পর্যায়ে যাচ্ছে, তা টের পেয়ে চন্দ্রিমাদেবীকে জানান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী। সে দিন উত্তরকন্যার বৈঠকের পরে চন্দ্রিমা মেডিক্যাল কলেজে যাবেন কি না, তা জানতেও চেয়েছিলেন কয়েক জন সরকারি কর্তা। কিন্তু, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। এই প্রসঙ্গে চন্দ্রিমার ব্যাখ্যা, “বৈঠকের সময়ে মেডিক্যালের সুপার ছিলেন। তিনি বিষয়টি উদ্বেগজনক নয় বলে দাবি করেন। এত গুরুতর ব্যাপারে তথ্য গোপন করাটা মানা যায় না।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীও দাবি করেন, তিনি একাধিক বার মেডিক্যাল কলেজে গেলেও সুপার কিংবা জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ আছে বলে দাবি করেছিলেন। গৌতমবাবুর কথায়, “তবুও আমি চিন্তিত হয়ে গোটা উত্তরবঙ্গে সতর্কতা জারির জন্য বলি।”
হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে যে ক্ষোভ রয়েছে, এ দিন চন্দ্রিমা এবং গৌতম দেব ওয়ার্ড ঘুরে দেখার সময় তা টের পান। হাসপাতালে ভর্তি চোপড়ার বাসিন্দা জুমন আলির দাদা পেয়ার আলির স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে ক্ষোভ উগরে দেন। তিনি বলেন, “আপনি কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বৈঠক করে বিবৃতি শুধু বিবৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে না।”