ফাইল চিত্র।
১৮ বছর আগে যখন সার্সের (সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) সংক্রমণ হয়েছিল, তখনই গবেষকেরা জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র জল-সাবানে নিয়মিত হাত ধুয়ে এই রোগের আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য হাত পরিষ্কার থাকলে ফুসফুসজনিত যে কোনও সংক্রমণের আশঙ্কাই ২০ শতাংশ কমে, তা-ও তো জানা গিয়েছে অনেক আগে। পাশাপাশি কলেরা, ইবোলা, হেপাটাইটিস ই-সহ প্যাথোজ়েনজনিত একাধিক সংক্রমণও এই পদ্ধতিতে ঠেকানো যে সম্ভব, সেটিও প্রমাণিত।
কিন্তু তার পরেও জল-সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা ‘হ্যান্ড হাইজিন’-এর গুরুত্ব বুঝতে কোভিড ১৯-এর মতো অতিমারির কেন প্রয়োজন পড়ল, এ নিয়ে বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক মহলে আলোচনা চলছিলই। সেই আলোচনাই আলাদা মাত্রা পেয়েছে আজ, বৃহস্পতিবার ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’-এ (গ্লোবাল হ্যান্ডওয়াশিং ডে)। বিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্য চিকিৎসকদের বক্তব্য, সুস্থ থাকতে হাত পরিষ্কার রাখার প্রাথমিক পাঠ ছোটবেলাতেই দেওয়া হয়। যে কারণে বাইরে থেকে এলে বা খেতে বসার আগে ছোটদের হাত ধুতে বলেন বড়রা।
কিন্তু সেই শিক্ষা বড় হয়ে ‘ভুলে যাওয়া’ বা ‘গুরুত্ব’ না দেওয়ার মধ্যেই যে কোভিড ১৯-এর মতো সংক্রমণের বীজ লুকিয়ে, তা সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আরও এক বার প্রমাণিত বলে জানাচ্ছেন তাঁরা! এক জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘করোনা সংক্রমণের সময়ে হাত ধোয়ার গুরুত্বের উপরে বিশেষ সমীক্ষা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সেই রিপোর্টের উল্লেখও করেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র সাবান দিয়ে প্রতিদিন হাত ধুলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে যায়!’’ ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর এপিডিমিয়োলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান শম্পা মিত্র বলছেন, ‘‘এমন নয় যে, হাত ধোয়ার গুরুত্ব আমাদের অজানা ছিল। বরাবরই বিষয়টা জানতাম। কিন্তু পালন করতাম না। এটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস, করোনা সংক্রমণ তা কান ধরে শেখাল!’’
তবে সব জায়গায় সমান ভাবে জল বা সাবানের সরবরাহ নেই, তা স্বীকার করছেন বিশেষজ্ঞেরা। শুধু দেশেই নয়, এ রাজ্যেও বহু অঞ্চলে হাত ধোয়ার পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। কোথাও হাত বার বার ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত জলের অভাব, কোথাও সাবানের অভাব। কিন্তু যেখানে এই অভাবগুলি নেই, সেখানেও হাত ধোয়া সর্ব স্তরে এখনও অভ্যাস হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি! এক ভাইরোলজিস্টের কথায়, ‘‘এক জন সংক্রমিত ব্যক্তি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যত জায়গায় হাত রাখেন, সেগুলির ৪৪ শতাংশেই প্যাথোজ়েন থাকে। জল-সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে প্যাথোজ়েনের আগ্রাসন অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া যায়।’’ এক বেসরকারি হাসপাতালের ইর্মাজেন্সি মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক কুমার রাজের কথায়, ‘‘সুস্থ থাকার অন্যতম প্রাথমিক শর্ত হ্যান্ড হাইজিন পালন করা। তবে করোনার মতো শুধু বিশেষ পরিস্থিতি নয়, যে কোনও পরিস্থিতিতেই তা মানা দরকার।’’
আরও পড়ুন: বিপদসঙ্কেত! ‘কেরলের শিক্ষা না নিলে পুজোর পর করোনা-সুনামি’
আরও পড়ুন: ভাত খেলেই কি মোটা? উপকার পেতে কতটা খাবেন, কেন
কেন মানা দরকার তার কারণ ব্যাখ্যা করে গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এক জন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৬-২৩ বার নিজের অজান্তে, প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় (রিফ্লেক্স) হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করেন। ফলে সে হাত যদি নোংরা থাকে, তা হলে প্রত্যেক বারই কোনও না কোনও রোগের আশঙ্কা থেকে যায়। করোনার মতো যে কোনও সংক্রমণ ঠেকাতে সেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় বদল আনা দরকার। সে ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার পাশাপাশি হাত যাতে মুখ স্পর্শ না করে, সেই অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই তৈরি করতে হবে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। ‘ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন’-এর পূর্বাঞ্চলের সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সদস্য অয়ন ঘোষের কথায়, ‘‘ছোটদের হাত ধোয়ার কথা বলেন বড়রা। কিন্তু হাত ধোয়ার অভ্যাস বড়দের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ, করোনা সেই শিক্ষা দিয়েছে।’’যদিও এর পরেও সংশয় থাকছে, হাত পরিষ্কার রাখার এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে তো? নাকি শুধুমাত্র এই অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক অভ্যাস হিসেবেই তা সীমাবদ্ধ থাকবে? যদি দ্বিতীয়টিই হয়, তা হলে আরও একটি কোভিড ১৯-এর মতো অতিমারি অবশ্যম্ভাবী, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের!