সম্প্রতি চিকেনপক্স চিন্তায় ফেলেছে সকলকে। কী কী বিষয়ে সাবধান থাকবেন, জেনে নিন 
Chicken Pox

জলবসন্তে আতঙ্ক নয়, সচেতন থাকতে হবে

ভ্যারিসেলা জ়স্টার ভাইরাসের জন্য জলবসন্ত হয়। এর প্রকোপ বাড়ে শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসার আগে, ঋতু পরিবর্তনের সময়ে।

Advertisement

ঊর্মি নাথ 

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৪৫
Share:

চিকেনপক্সের বাড়বাড়ন্ত কপালে ভাঁজ ফেলেছে রাজ্যের মানুষের। প্রতীকী ছবি।

জলবসন্ত বা চিকেনপক্সের বাড়বাড়ন্ত কপালে ভাঁজ ফেলেছে রাজ্যের মানুষের। শেষ তিন মাসে এই রোগে যে ক’জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ৫০ শতাংশের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। স্বাভাবিক ভাবে সকলেরই মনে চিন্তার পারদ বাড়ছে। কারণ জলবসন্ত মারাত্মক সংক্রামক। ‘‘জলবসন্ত কিন্তু সিজ়নাল ট্রেন্ড। বয়স্কদের সংক্রমণের যে সংখ্যা দেখছি তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। গত দু’বছরেও বহু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জলবসন্ত হয়েছে। কোভিডের জন্য সে খবর হয়তো প্রকাশ্যে আসেনি। আগেও জলবসন্তে বয়স্কদের মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সমস্যা হচ্ছে, কোভিডের আগে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই বয়স্করা হাসপাতালে চলে আসতেন। কিন্তু করোনাকালের পরে ভাইরাস সংক্রান্ত রোগের জন্য ভর্তি হওয়ার প্রবণতা কমেছে। ধারণা তৈরি হয়েছে, ওষুধ খেয়ে বাড়িতে বিশ্রাম নিলে কমে যাবে। যতক্ষণ না পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন না তাঁরা। জলবসন্তের ক্ষেত্রে যত দেরি হবে তত সমস্যা বাড়বে,’’ বললেন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের প্রাক্তন এবং বর্তমানে এসএসকেএম-এর সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. যোগিরাজ রায়।

Advertisement

জলবসন্তের প্রাথমিক কথা

ভ্যারিসেলা জ়স্টার ভাইরাসের জন্য জলবসন্ত হয়। এর প্রকোপ বাড়ে শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসার আগে, ঋতু পরিবর্তনের সময়ে। সাধারণত ছোট বয়সে অর্থাৎ এক থেকে চোদ্দো বছর বয়সিদের মধ্যে বেশি হয় এই রোগ। প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, একবার জলবসন্ত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে আর হবে না। তা কিন্তু নয়, দ্বিতীয় বার হওয়ার দশ শতাংশ সম্ভাবনা থেকেই যায়। জলবসন্তের পরিচিত লক্ষণগুলি হল জ্বর, সঙ্গে গা-হাত-পা ব্যথা। জ্বর ক্রমশ বাড়তে থাকবে এবং দু-তিন দিন পর থেকে শরীরে লাল ফুসকুড়ির মতো বার হয়। যত দিন যাবে ছোট ফুসকুড়ি জল ভরা ফোস্কার আকার নেবে। বুক, পেট, পিঠ, হাতে, পায়ে, মুখে সারা শরীরে জল ফোস্কা ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় ত্বকে চুলকানি হয়। সাত-আট দিন পরে ফোস্কা শুকোতে শুরু করবে।

Advertisement

চিকিৎসা

জন্মের পর থেকে দশ বছরের মধ্যে জলবসন্তের টিকা দিয়ে দিলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। বয়স্কদের জলবসন্তে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে ডা. রায়ের পরামর্শ, ‘‘জলবসন্তে ছোটদেরও ভোগান্তি হয় ঠিকই কিন্তু প্রাণঘাতী নয়, বয়স্কদের ক্ষেত্রে ফেটাল হয় কোমর্বিডিটির জন্য। এখন চল্লিশ থেকেই শরীরে কোনও না কোনও সমস্যা হয়। বয়স যত বাড়ে কোমর্বিডিটি তত বাড়ে। এ ছাড়া সদ্যোজাত শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, ইমিউনো কম্প্রোমাইজড বা যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং নিয়মিত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খান, তাঁদের জলবসন্ত হলে জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। জ্বর, গা ব্যথা বা লক্ষণ প্রকাশের শুরুতেই চিকিৎসকের কাছে এলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া যায়। অ্যান্টিভাইরাল ডোজ় দিয়ে দিলে অল্প দিনেই সেরে যায়, কষ্টও কম হয়। দিন যত বাড়বে, র‌্যাশ বেশি বেরোতে থাকবে, তখন আর অ্যান্টিভাইরাল ডোজ় কাজ করে না। আগে রোগীকে ঘরেই রেখে দেওয়া হত, কারণ ওষুধ ছিল না। এখন তো ওষুধ আছে। তাই ঘরে সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের কাছে যত দ্রুত সম্ভব যাওয়া প্রয়োজন। বয়স্ক যাঁরা মারা গিয়েছেন অধিকাংশই একেবারে শেষ সময়ে এসেছিলেন।’’

জলবসন্তে শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই জোর দিতে হবে খাওয়াদাওয়ার উপরে। বসন্ত রোগীর ডায়েটে কোনও বিধিনিষেধ নেই, নিরামিষ, আমিষ সব খাবার খাওয়া যায়। ‘‘এ সময়ে শরীরে ক্যালোরি, প্রোটিন দরকার। লাইসিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তবে পথ্য হবে সহজপাচ্য। যেমন পাতলা মাছের ঝোল, পনির, ডিমের সাদা অংশ, তেতো ইত্যাদি। কিন্তু চিকেনপক্স যেহেতু ত্বক ছাড়াও গলার ভিতরের মিউকাস পর্দায় হয়ে থাকে, তাই গরম, অধিক টক, ঝাল বা নুন-সমৃদ্ধ খাবার রোগীর খেতে অসুবিধে হয়। সে দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণে ফ্লুইড দরকার। জলের পাশাপাশি রোগীর পছন্দ অনুয়ায়ী ফলের রস, মিছরির শরবত, আলু সিদ্ধ, গলা ভাত ইত্যাদি দিতে হবে। পক্সের জন্য চোখে যাতে ক্ষতি না হয়, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন ‘এ’-র এবং আয়রনের সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন। সেরে ওঠার পরে বেশ কিছু দিন ভিটামিন ‘ই’ সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন, এতে ত্বকের দ্রুত রিকভারি হয়,’’ বললেন জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল।

প্রতীকী ছবি।

ভয় না পেয়ে সচেতন হতে হবে

আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হলে বিপন্মুক্ত থাকা যায়। এ সময়ে জ্বর হলে অনেকেই ধরে নেন ঋতু পরিবর্তের জন্য ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়েছে। ভাবনাতেও আসে না যে বড় বয়সে আবার পক্স হতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ না নিশ্চিন্ত হচ্ছেন জ্বরের রকমফের নিয়ে, ততক্ষণ বাইরে না বেরোনোই ভাল। ‘‘অনেকেই চাকরিসূত্রে বাড়ি থেকে দূরে একা থাকেন। বসন্ত হয়েছে বুঝতে পেরেও তাঁরা বাসে বা ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে আসেন, তার পরে আইসোলেশনে যান। এখানেই হয় বিপদ। তিনি ততক্ষণে অনেককে সংক্রমিত করে ফেলেছেন,’’ বললেন ডা. রায়। আক্রান্তের হাঁচি, কাশি বাতাসে ভেসে সংক্রমণ ছড়ায়। তাঁদের থুতু ও ফোস্কার রসও ছোঁয়াচে। পক্স একদম শুকিয়ে গেলে ফোস্কার উপরের শুকনো চামড়া বা খোসা উঠতে শুরু করে। এটিও সংক্রামক। তাই সেগুলো একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। যাঁদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাড়িতে রাখা হয়, তাঁদের পোশাক, তোয়ালে, গামছা, বাসন ইত্যাদি সব কিছু আলাদা করে দিতে হবে। আলো-বাতাসপূর্ণ পরিচ্ছন্ন ঘরে রোগী থাকবেন। সেই ঘরে অবশ্যই বাড়ির অন্য কোনও সদস্য থাকবেন না। রোগীর হাতের নখ কেটে দিতে হবে। না হলে চুলকানি সহ্য করতে না পেরে চুলকে দিলে নখের আঁচড়ে পক্স ফেটে ইনফেকশন হতে পারে। রোজ ঈষদুষ্ণ জলে নিমপাতা ফেলে হালকা করে গা মুছিয়ে দিতে পারেন। খেয়াল রাখতে হবে যাতে ঘষা না লাগে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ক্যালামাইন জাতীয় লোশন লাগানো যেতে পারে। বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে রোজ অক্সিজেন লেভেল, রক্তচাপ মাপতে হবে। ডায়াবেটিকদের নিয়মিত গ্লুকোমিটারে শর্করার মাত্রা চেক করে নেওয়া ভাল। যিনি বসন্তের রোগীকে সেবা করছেন তাঁকেও ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আগাম সচেতনতার জন্য ওষুধ খেতে হবে। তাঁকে ব্যবহার করতে হবে মাস্ক ও গ্লাভস। চেষ্টা করতে হবে, তিনি যেন বাড়ির অন্য সদস্যদের থেকে দূরে থাকেন। প্রয়োজনে এ সময়ে বাড়ির বাচ্চা ও বয়স্কদের, বিশেষ করে যাঁদের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা আছে তাঁদের অন্যত্র থাকাই ভাল।

জলবসন্ত থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরে শরীর বেশ দুর্বল থাকে। তাই সেরে যাওয়ার পরে শরীর বুঝে কয়েক দিন পরে কাজে যোগ দেওয়া উচিত, বিশেষ করে যাঁদের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement