সাপের কামড়ে প্রতি বছর মৃত্যু হয় অগুনতি মানুষের। যাঁরা চিকিৎসকের সাহায্য নেন, তাঁদের সংখ্যাটা জানা গেলেও বহু ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে ঘটে গুরুতর বিপত্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর ১৯ সেপ্টেম্বরে সাপে কাটা নিয়ে সচেতনতা দিবস পালন করে। তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে অন্তত ৫৪ লক্ষ মানুষকে সাপে কাটে। তার মধ্যে অন্তত ১৮ থেকে ২৭ লক্ষ সাপ বিষাক্ত। পাশাপাশি, সর্পদংষ্ট্র হয়ে পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর সংখ্যাটা প্রতি বছর ৮১,৪১০ থেকে ১,৩৭,৮৮০।
চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানাচ্ছেন, সাধারণত বর্ষায় ঝোপ-জঙ্গল বাড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সেই জঙ্গলে থাকা সাপের সংখ্যা। খেত, আল, জঙ্গল বা অনেক সময় রাস্তাঘাট কিংবা ঘরের আনাচকানাচে সাপ দেখা যায়। যদি অসাবধানতায় সাপের গায়ে হাত-পা পড়ে যায়, তা হলে তা ছোবল মারতে পারে।
সাপ চেনার উপায়
গোখরো, চন্দ্রবোড়া, কেউটে: এই বিষধর সাপগুলির নাম অনেকেরই জানা। কিন্তু বিষধর এবং নির্বিষ সাপ বোঝার উপায় কী?
দাঁতের গঠন: বিষধর সাপের বিষ-দাঁত দু’টি লম্বা হয়। নির্বিষ সাপের ক্ষেত্রে সব ক’টি দাঁতই হয় সমান মাপের।
ছোবল মারার পরে যদি একটি বা দু’টি দাঁতের দাগ দেখা যায়, তবে সাপটি বিষধর বলে সাধারণত মানা হয়।
গায়ের রং: বিষধর সাপ সাধারণত উজ্জ্বল রঙের হয়। উল্টোটা ঘটে নির্বিষ সাপের ক্ষেত্রে। যদিও ময়াল বা স্যান্ড বোয়ার গায়ের রং উজ্জ্বল হলেও তা বিষহীন।
মাথার আকৃতি: ত্রিভুজাকার এবং ভোঁতা মাথার সাপের বিষধর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে সাপগুলির মাথা ছোট এবং লম্বাটে, সেগুলি বিষহীন হয়।
লেজ: লেজ চ্যাপ্টা হলে সেটি বিষধর, ভোঁতা হলে সেটি নির্বিষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে, দু’ধরনের সাপের ক্ষেত্রেই অনেক সময় লেজটি নলাকৃতিও হয়।
সাপে কাটার লক্ষণ
- ক্ষতস্থানে লালচে দাগ।
- জায়গাটি সংক্রমিত হয়ে ফুলে যেতে পারে। জ্বালা, ব্যথা হতে পারে। এমনকি পচনও ধরতে পারে।
- পেশিগুলি সঙ্কুচিত হয়ে আসার ফলে শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা হতে পারে। কষ্ট হয় কথা বলতেও।
- শ্বাসকষ্ট, বমি, পেট খারাপ, চোখে ঝাপসা দেখা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
- বিষের প্রভাবে স্নায়ু বিকল হতে পারে (নার্ভ প্যারালিসিস)। রক্ত জমাট না বাঁধা বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, দুইয়েরই আশঙ্কা থাকে। অস্বাভাবিক ভাবে রক্তক্ষরণের ফলে কিডনি, যকৃৎ, হৃৎপিণ্ডে প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি, সেগুলি বিকল হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। যদি চিকিৎসা সময়ে না করা হয়, তবে প্রাণহানির ভয় থাকে।
তবে, সব সময় সাপের কামড় মানেই যে মৃত্যু, তা কিন্তু একেবারেই নয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সব সাপ বিষধর হয় না। আবার এমনটাও হয়ে থাকে, হয়তো এক জনকে একটি সাপে ছোবল মেরেছে। কিন্তু তার আগে সেটি অন্যত্র ছোবল বসিয়েছিল। ফলে সাপের বিষও আগের স্থানেই থেকে যায়।
সাপে কাটলে যা করণীয়
সাপে কাটল কিছু বিষয় মানতে হবে:
- শরীরের যে অংশে সাপে ছোবল মেরেছে, চেষ্টা করতে হবে সেই জায়গাটির যাতে বেশি নড়াচড়া না হয়। এতে বিষ শরীরের বাকি অংশে কিছুটা ধীরে ছড়াবে।
- বেশ কিছু ক্ষণ ধরে পরিষ্কার জল আর সাবান দিয়ে ভাল করে ক্ষতস্থানটি ধোয়া দরকার। বিষের মাত্রা কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু ক্ষতস্থান জলে ডুবিয়ে রাখবেন না।
জরুরি সচেতনতা
- প্রাথমিক ভাবে সামাল দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন দ্রুত কাছাকাছি কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করা। ডা. তালুকদার জানাচ্ছেন, অনেক সময় কোনও কারণে ক্ষতস্থানের জ্বালা ভাব কিছুটা কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার বিষয়টিকে উপেক্ষা করার প্রবণতাও দেখা যায়। অনেকে আবার ভাবেন, তাঁরা নিজেরা যেহেতু সাপটিকে চেনেন না, তাই ঠিক মতো চিকিৎসা পরিষেবা মিলবে না। খরচের ভয়েও কেউ কেউ পিছিয়ে আসেন। কিন্তু এই ধারণাগুলি একেবারেই ভ্রান্ত। সব হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রেই এক ধরনের ‘কমন অ্যান্টি স্নেক ভেনম’ থাকে। এই অ্যান্টিস্নেক ভেনম যে কোনও সাপের বিষ প্রতিরোধ করতে কার্যকর। তবে গোটা প্রক্রিয়াটি দ্রুত করতে হবে।
- সর্পদংশনের কথা শুনলে অনেকেই ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করেন। ছুরি বা ব্লেড দিয়ে ক্ষতস্থানটি চিরে বিষাক্ত রক্ত বার করার চেষ্টা করেন অনেকে। মুখ দিয় বিষরক্ত শুষে ফেলতে যান। আবার তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে রোগীর পরিবার ছুটে যান স্থানীয় ওঝার কাছে। এই সবের ফলে রোগীর বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ওঝা বা স্থানীয় ‘টোটকা’য় কখনও কখনও সুফল মিলতে পারে। তবে তাতে ওঝা বা টোটকার কোনও কৃতিত্ব নেই। সবটাই নির্ভর করে সাপের বিষের ধরনের উপরে। আবার এ-ও ঘটে, সাময়িক ভাবে হয়তো সুস্থ হয়ে ওঠেন কেউ। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে পরে তাঁদের শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
তাই, সাপে কাটলে মনোবল হারালে যেমন চলবে না, তেমনই কুসংস্কারের শরণাপন্ন হলে ফল হতে পারে মারাত্মক।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)