লড়াকু: অনুষ্ঠানে শিশু ও তাদের অভিভাবকেরা। মঙ্গলবার, এসএসকেএম হাসপাতালে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
চিকিৎসা করিয়ে কী হবে? বেশি দিন তো বাঁচবে না! ক্যানসার আক্রান্ত ছ’মাসের মেয়েকে নিয়ে কলকাতার সরকারি হাসপাতালে ছোটাছুটি করার সময়েই শুনতে হত কথাগুলো। শহরতলির বাসিন্দা সেই দম্পতি তবু লড়াই ছাড়েননি। এক সময় রোগ হার মানে তাঁদের লড়াইয়ের কাছে। সেই মেয়ে এখন সুস্থ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চলেছে। নাচ শিখছে। স্বপ্ন, নৃত্যশিল্পী হওয়ার। তবু প্রতিবেশীদের অনেকেই এখনও বলেন, অতীতের রোগের কথা জানলে তাকে নাকি কেউ বিয়েই করবে না! অর্থাৎ, লড়াই শুধু রোগের সঙ্গে নয়, রোগকে ঘিরে যে হাজারো সংস্কার, তার সঙ্গেও। চিকিৎসকদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, অনেকেই লড়াই ছেড়ে দেন এই পরিস্থিতিতে। চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয় মাঝপথেই। কিন্তু ঠিক সময়ে, ঠিক চিকিৎসা শুরু করা গেলে শিশুদের ক্যানসার সারতে পারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। কিন্তু এ নিয়ে কোনও সচেতনতা নেই অনেকেরই।
মঙ্গলবার শিশু দিবসে এই সচেতনতার প্রচারেই উদ্যোগী হয়েছিল ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এসএসকেএম হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তাদের এই কর্মসূচি হয় হাসপাতালের প্রেক্ষাগৃহে। চিকিৎসক, বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি ছিলেন ক্যানসার আক্রান্ত শিশু এবং তাদের অভিভাবকেরাও। এসএসকেএম হাসপাতালের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাচ্চার অসুখ হলে তার
প্রভাব শুধু বাচ্চার উপরেই আটকে থাকে না। প্রভাব পড়ে পরিবারের সকলের উপরে। এটা বুঝেই গত এক বছর ধরে আমরা নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছি।’’
এসএসকেএমের রেডিয়োথেরাপি ও অঙ্কোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অলোক ঘোষদস্তিদার এর পরে জানান, এক বছর আগে শিশু দিবসেই এই হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি পরিষেবা চালু হয়। পাশাপাশি, শিশুদের জন্য ‘ডে-কেয়ার’ কেমোথেরাপি সেন্টার চালু হয় এসএসকেএমের অ্যানেক্স ভবন কলকাতা পুলিশ হাসপাতালে। তিনি দাবি করেন, গত এক বছরে পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজির বহির্বিভাগে ২১৯৬ জন রোগীকে পরিষেবা দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বিভাগে কেমোথেরাপি হয়েছে প্রতি মাসে ১০৮টি করে। ‘ডে-কেয়ার’ পরিষেবা পেয়েছেন প্রতি মাসে ৫৩ জন। অলোকের কথায়, ‘‘বিশ্বে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু ভারতের জনসংখ্যা এত বেশি যে প্রতি জনের হিসাবে ধরলে বিশ্বের মোট আক্রান্তের তুলনায় সেই সংখ্যাটা অনেক বেশি। কিন্তু আশার কথা, সময়ে এবং ঠিক চিকিৎসা হলে শিশুদের ক্যানসার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্মূল করা যায়।’’
এসএসকেএম হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক মৌ দাস বলেন, ‘‘বাচ্চাদের ক্যানসারের বড় দিক থ্যালাসেমিয়া। এর মধ্যে বিট থ্যালাসেমিয়া নিয়ে আলাদা সচেতনতা প্রয়োজন। এটি একটি জিনঘটিত রোগ। জিনের মিউটেশনের জন্য হয়। যে বাচ্চার এই রোগ হয়, তার শরীরে ভাল করে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না। রক্তকোষগুলি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। শিশুকাল বা জন্মের পর থেকেই বাচ্চার রক্তাল্পতা দেখা দেয়। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের ৬.৫ শতাংশ মানুষই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। ফলে রক্তপরীক্ষা করে সচেতন ভাবে এগোলে আর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা গেলে কিন্তু এই রোগকেও হারানো সম্ভব।’’
উদ্যোক্তা সংগঠনের পক্ষে পার্থ সরকার বলেন, ‘‘সচেতন ভাবে এই পথ চলার ক্ষেত্রেই আমরা বাচ্চা ও তার পরিবারের পাশে আছি। মনে রাখতে হবে, ক্যানসার মানেই সব শেষ নয়। আমি বলব, কিছুই শেষ নয়। দরকার সময়ে চিকিৎসা।’’