দুটি সংক্রমণ একসঙ্গে হলে তা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। প্রতীকী ছবি
গত বছর এ সময়ে প্রায় ৬০০-র বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেঙ্গিতে। এ বার একে করোনা, তার মধ্যেই বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে ইতিমধ্যেই চিকিৎসকদের কাছে ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী আসতে শুরু করেছেন। বৃষ্টির জল কোথায় জমছে, কোথায় আবর্জনা জমে রয়েছে, ডেঙ্গির মরসুম শুরু হলে কোথায় মশার আস্তানা তৈরি হতে পারে, সে সব দিকে নজরদারি চালাচ্ছে প্রশাসন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডেঙ্গির কোনও ওষুধ নেই। পুরোটাই ম্যানেজমেন্ট। এই রোগ ঠেকাতে কী করতে হবে, কী বলছেন চিকিৎসকরা?
ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়া দুটিই মশাবাহিত রোগ। দুটি ক্ষেত্রেই জলের ভূমিকা রয়েছে। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে রোগে সবচেয়ে বড় ভূমিকা জলের। কারণ জল ছাড়া মশা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে ভেক্টর বা বাহক এডিস মশা। রাজ্যে ডেঙ্গি ছড়ায় এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামে দু’টি প্রজাতি । গবেষকরা বলছেন, এডিস মশার ক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধির জন্য এক ছিপি জলই যথেষ্ট । তাই ডেঙ্গি ভাইরাসের প্রকোপও বেশি ।
ডেঙ্গি রুখতে মশার বংশবৃদ্ধি আটকানো সবচেয়ে জরুরি, বলছেন সংক্রামক ব্যধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। বৃষ্টি থেমে থেমে হওয়ার কারণে ডেঙ্গি মশার জন্মানোর সম্ভাবনা বাড়ছে । পরিত্যক্ত যে কোনও জিনিস ছাড়াও নির্মীয়মাণ বাড়ির আবর্জনাতেও জল জমতে না দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলেন অমিতাভবাবু।
আরও পড়ুন: করোনার সময়ে অবহেলা নয় সাধারণ অ্যালার্জিকেও
১) জ্বর, মাথা যন্ত্রণা, হাত-পাযের সঙ্গে সারা শরীরে ব্যথা। চোখের পেশিতেও ব্যথা শুরু হয়।
২) বমি ভাব, অরুচি। গাঁটে ব্যথা।
৩) ৪-৫ দিন পর জ্বর কমলেও, গায়ে র্যাশ, চুলকানি, ডায়ারিয়া, দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়।
৪) গলা ব্যথা, ঢোক গিলতে কষ্ট।
এই সব উপসর্গ থাকলেই র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে এন-এস১ রক্ত পরীক্ষা করতে হবে দ্রুত, জানালেন অমিতাভ নন্দী । তিনি বলেন, জ্বর দেখে যে হেতু ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কোরোনা কিছুই বোঝা যায় না, তাই ব্লাড কাউন্ট-সহ প্রথমেই প্রাথমিক রক্ত পরীক্ষা অর্থাৎ ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া টেস্ট করতে হবে।
মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, জল জমার বিষয়ে বেশি রকমের সতর্ক থাকতে হবে । তাঁর কথায়, বাড়ির আশপাশের অতিরিক্ত জল জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। টবে জমা জল, পরিত্যক্ত জায়গায় জমা জল, আগাছার কারণে জমে থাকা জল সবটাই সরিয়ে ফেলতে হবে । ডোবা জাতীয় জলাশয় থাকলে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
চিকিৎসকের কথায়, হাত-পা সম্পূর্ণ ঢাকা থাকবে এ জাতীয় পোশাক পরাই ভাল। অনাবৃত অংশে মশার কামড়ের হাত থেকে রেহাই মিলবে সে ক্ষেত্রে। যাঁরা বাইরে বেরোচ্ছেন নিয়মিত, সে ক্ষেত্রে স্প্রে ব্যবহার করলে খানিকটা সুবিধা মিলবে ।
মশারি টাঙিয়ে শোওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। বিশেষত বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে, যাঁরা রোগের কারণে শয্যাশায়ী, তাঁদের এটা অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
পরিত্যক্ত গাড়িতেও বর্ষার জল জমে ডেঙ্গি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নজর দিতে হবে সে দিকেও। আবাসনে জল যাতে না জমে, নজর রাখতে হবে সে দিকেও ।
ব্লিচিং পাউডার জীবাণুমুক্ত করলেও লার্ভা মরে না এতে। তাই অ্যান্টি-লার্ভাল স্প্রে ব্যবহার করতে হবে, যাতে লার্ভাগুলি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়, সে দিকে নজর রেখে স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।
আরও পড়ুন: কাঁপুনি দিয়ে জ্বর-র্যাশ, স্ক্রাব টাইফাস নয়তো?
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং মেডিক্যাল এন্টোমোলজিস্ট গৌতম চন্দ্র ডেঙ্গি সংক্রমণ প্রসঙ্গে বলেন, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা এবং জল জমতে না দেওয়াটাই ডেঙ্গি ঠেকানোর একমাত্র উপায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা( হু) বলছে, ডেঙ্গির ক্ষেত্রে সেই অর্থে নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ নেই। কারও ডেঙ্গি হলে ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমেই নিরাময় করা হয়। তাকে যাতে মশা না কামড়ায়, সেই বিষয়টিও দেখতে বলছে হু।
তাঁর কথায়, পাঁচ ফুটের বেশি গভীর জলাশয়ের ক্ষেত্রে এডিস মশা কখনওই জন্মায় না, কারণ এদের লার্ভা জলের তলায় গিয়ে খাবার খায়, শ্বাস নিতে উপরিতলে উঠে আসে। সে ক্ষেত্রে গভীর পুকুর হলে এই লার্ভা বাঁচতে পারে না। তবে ছোট ছোট পাত্রে জল থাকলে, সহজেই জন্ম নেয় এই লার্ভা। আইসক্রিমের কাপ, ডিমের খোলা কিংবা প্লাস্টিকের চটি যাইহোক, ২ সেন্টিমিটারের মতো জল থাকলে তাতেই লার্ভা জন্ম নিতে পারে।
উচু গাছের এমন কোনও অংশ, যাতে জল জমলেও সহজে তার নাগাল পাওয়া মুশকিল, সে ক্ষেত্রে স্প্রে করার সময় সতর্ক থাকতে হবে। গবেষণা বলছে, এই মশা মূলত দিনে কামড়ালেও ইজিপ্টাই রাতে কামড়ানোর সম্ভাবনা ১৬ শতাংশ, অ্যালবোপিকটাসের ক্ষেত্রে তা ১০ শতাংশ। দিনের সময়টা বাদ রাখলে সন্ধে ৬টা থেকে রাত ১০টা, ভোর ৪টে থেকে সকাল ৬টাতেও এই মশা সক্রিয় থাকে। কেটে রাখা বাঁশ, গাছের কোটরের ক্ষেত্রেও এই লার্ভা বংশবিস্তার করে সহজেই। তাই একটু সতর্ক থাকলেই লার্ভা নিধন সম্ভব। ঠেকানো সম্ভব ডেঙ্গি।