ক্যানসারের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে দৈনিক কিছু অভ্যাসও। ছবি: আইস্টক।
শরীরের যত্ন নিতে আমরা কত কিছুই না করি! অন্তত ভয়াবহ কোনও অসুখ ঠেকাতে যেটুকু নিয়মানুবর্তিতা ও খেয়ালের প্রয়োজন, তাতে যাতে খামতি না থাকে সে দিকে লক্ষ্য থাকে কমবেশি সকলেরই। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু কাজ প্রায়ই করে থাকেন, যা কোনও না কোনও ভাবে ক্যানসার ডেকে আনায় সহায়ক হয়! অনেক সময় জেনেবুঝেও সেই ভুল করে বসি আমরা। কখনও বা ক্যানসারের বীজ ছড়িয়ে পড়ার কথা না জেনেই সেই সব কাজ রুটিনে রেখে দিই। শরীরের কোনও কোষ অপ্রতিরোধ্য ভাবে বিভাজিত হতে শুরু করলে তাকেই ক্যানসার বলে ডাকেন চিকিৎসকরা।
প্রতি দিনের কিছু অভ্যাস শরীরে এই ধরনের জেনেটিক মিউটেশন ঘটায় শরীরে। তাই নিত্য অস্বাস্থ্যকর কিছু অভ্যাস বাদ দিলে ক্যানসারের ভয় অনেকটাই কমে।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সোমনাথ সরকারের মতে, ‘‘ক্যানসারের নানা কারণ থাকে। তার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে তা দৈনন্দিন অভ্যাস ও কিছু কাজের হাত ধরেও শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে টক্সিক পদার্থের উপস্থিতি যত বাড়বে ক্যানসারের ভয় ততই বড় আকার নেবে। তাই কিছু অভ্যাসে রাশ টানতে পারলে জেনেটিক ভাঙচুরকে অনেকটা রুখে দিয়ে রোগ থেকে দূরে থাকা যায়।’’
কী সে সব অভ্যাস, যা উস্কে দেয় ক্যানসারের প্রবণতা?
দূষণের মধ্যে থাকা: অনেক সময়ই দেখা যায় প্রবল দূষণ, ধোঁয়া-ধুলো এসব জায়গাতেও কোনও রকম প্রতিরোধক ছাড়াই দিনের পর দিন আমরা বসবাস করছি বা কিছু ক্ষণের জন্য হলেও তেমন স্থানে থাকছি। চারপাশের বায়ু দূষণের কাছে আমরা অসহায়। একা সব দূষণ রোধ করতেও পারবেন না। তাই নিজেকে যেমন একদিকে বায়ু দূষণ থেকে বাঁচাতে শিখতে হবে অন্য দিকে বায়ু দূষণ যাতে নিজের কারণে না বাড়ে। বায়ু দূষণ থেকে বাঁচতে অন্তত মাস্ক ব্যবহার করুন, তবে বাজারচলতি অকাজের মাস্ক নয়, সেই মাস্ক যেন চিকিৎসকের মত অনুযায়ী কেনা হয়। চেষ্টা করতে হবে যেন কোনও ভাবেই দূষণকে চেপে বসতে না দেওয়া হয়। বাড়ির চারপাশে এমন পরিবেশ থাকলে বেশি করে গাছ লাগানো, এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার ইত্যাদি উপায়ে দূষণ রুখতে হবে। দূষণের কারণে শরীরে কার্বন ও তার নানা যৌগ জমে।
ই-সিগারেট ও ধূমপান: তামাকজাত দ্রব্যের বাজারে ই-সিগারেট এসে যাওয়ায় অনেকেই ধূমপানের সময় এটি ব্যবহার করেন। ভেবে থাকেন, এতে কম ক্ষতি হয়। কার্ডিওলজিস্ট প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডলের মতে, এই ধরনের ই-সিগারেটেও সমান ক্ষতি হয়। সাধারণ বিড়ি-সিগারেট ও ই-সিগারেট— সব ক্ষেত্রেই শরীরে ঢুকে পড়ে তামাক ও কার্বন। ক্যানসার দানা বাঁধার সব রকম উপাদান এতে মজুত। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মলিকিউলার সায়েন্স’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুযায়ী, এই ই-স্মোকিংয়ের অভ্যাসের কারণে মুখগহ্বরের টিস্যুতে নানা রকম পরিবর্তন দেখা যায়। যে পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক ভাবেই ক্যানসার ডেকে আনে।
প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্যাকেটবন্দি মাছ, বিভিন্ন রকমের প্যাকেটবন্দি মাংস, সস, বেকন, সালামি, হ্যাম এগুলোর লোভনীয় স্বাদ আমাদের বার বার এ সবের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসকদের মত মানলে দেখা যায়, এগুলোকে গ্রুপ ১ কার্সিনোজেন ও গ্রুপ ২এ কার্সিনোজেন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অত্যধিক পরিমাণে এ সব খেলে ক্যানসারের বীজ শরীরে ঢোকে।
গরম চা-কফি: দিনের শুরুই হয় চা বা কফি দিয়ে? তা হোক, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে খুব গরম চা পান করার অভ্যাসে যেন দাঁড়ি পড়ে। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ক্যানসার’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীদের দাবি, খাদ্যনালীতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে ফুটন্ত চা খাওয়ার প্রবণতা। প্রায় প্রতি দিনই যাঁরা ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রার চা খান, তাঁদের এই ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুকুমার সরকারের মতে, “যে কোনও ফুটন্ত গরম খাবারই এড়িয়ে চলতে বলা হয় এই কারণেই। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (হু)-ও ৬৫ ডিগ্রির উপর কোনও পানীয় খেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইতিমধ্যেই। মুখ, গলা ও খাদ্যনালীতে হওয়া ফুয়েল টিউমারই এই ধরনের ক্যানসারকে ডেকে আনে।
প্লাস্টিক: নিরীহ দেখতে প্লাস্টিক যে ক্যানসারের কারণ, তা আজ অজানা নয়। ঘরোয়া দূষণের অন্যতম উৎস হল প্লাস্টিকের বিভিন্ন দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার। জল রাখার জন্য, খাবার রাখার জন্য প্লাস্টিকের তৈরি নানা সামগ্রী আমরা প্রায়শই ব্যবহার করি। কিন্তু প্লাস্টিকে বিসফেনল যৌগ থাকে। এই যৌগ খাদ্যদ্রব্য ও জলের সংস্পর্শে এসে সেগুলিকে দূষিত করে তুলতে পারে। এর ফলে প্রস্টেটের মতো অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে, গর্ভবতী মহিলাদের ভ্রূণেরও ক্ষতি হয়। প্লাস্টিককে পলি কার্বনেটে রূপান্তরিত করেও নানা রকম প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। এর জন্য বিপিএ (বিপিএ বা বিসফেনল এ। এই যৌগ মূলত পলিকার্বনেট প্লাস্টিকের অন্যতম উপাদান।) যৌগটির ব্যবহার করা হয়। বিপিএ আমাদের শরীরে বিভিন্ন খাদ্যবস্তু ও জলের মাধ্যমে প্রবেশ করে। সাধারণ কোনও প্লাস্টিকের বোতলে গরম জল রাখলে বা প্লাস্টিকের পাত্রে মাইক্রোওয়েভে খাবার তৈরি করলে অথবা পাত্রগুলিকে ডিটারজেন্টে ধুলে বিপিএ মুক্ত হয়। পরে খাবার ও পানীয়ের মধ্যে দিয়ে বিপিএ মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। বিপিএ-র জন্য স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে।
চিনি ভেজে লাল: মাছ-মাংসের স্বাদ ও রং বাড়াতে অনেকেই তেলে চিনি ভেজে লাল করে নেন। মাংসের ঝোলে লালচে রং ধরানোর জন্য এটি খুব চালু পদ্ধতি। ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতি অত্যন্ত মারাত্মক। এমনিতেই চিনি সরাসরি ক্যানসারের কারণ কি না, তা নিয়ে বিশ্বে নানাবিধ গবেষণা চলছে। অনেকেই মতেই চিনি কোষকে ভাঙতে সাহায্য করে। তাই চিনি খুব নিরাপদ নয়। আর চিনি ভাজলে চিনির কার্বন যোগ ভেঙে তা সরাসরি খাবারে মেশে। চিনির বদলে লাল বাতাসা, গুড়, মধু ইত্যাদি ব্যবহার করতেও পরামর্শ দেন চিকৎসকরা।
হেয়ার ডাই: চুলে রং করার শখ থাকে অনেকেরই। অগত্যা ডাইয়ের শরণ নিয়ে থাকেন। কিন্তু জানেন কি, এই ডাইয়ে থাকে অ্যামোনিয়া-সহ নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক— যা চুলের ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ও কার্সিনোজেনের মতো আচরণ শুরু করে। বাজারচলতি প্রায় সব ডাইতেই এই উপাদানগুলি থাকে। তাই একান্তই চুলে রং করতে হলে ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তবেই এগোন। এই ডাই থেকে স্তন ক্যানসার ও ত্বকের ক্যানসারের ভয় থাকে বলে জানিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ক্যানসার’-এ প্রকাশিত আমেরিকান বিজ্ঞানীদের গবেষণা।
স্ট্রেস: আধুনিক জীবনে এই জিনিসটি বাদ দিয়ে দিন কাটে না। অথচ সব রকম লাইফস্টাইল ডিজিজকেই বাড়িয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা নেয় এই স্ট্রেস। জেনারেল অঙ্কোলজি ও বিহেভিয়ারাল সায়েন্সের অধ্যাপক লোরেনজো কোহেনের মতে, এই স্ট্রেস শরীরকে ভিতর থেকে ক্লান্ত করে ও কোষগুলিকে কমজোরি করে। ফলে কোষ দ্রুত ভাঙতে শুরু করে ও শরীরকে ক্যানসারের উপযোগী করে তোলে।