Online games

খেলার ফাঁদে মৃত্যু রুখতে নেই আইন, বরং প্রচারে আয় নামী ব্যক্তিদের

নেশার ফাঁদে আটকে আত্মনির্যাতনমূলক ‘টাস্ক’ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গেমের নির্দেশ মতো কেউ হাত কাটছে, কেউ পিন বা সুচ ফুটিয়ে নিজের শরীরে ছবি আঁকছে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:১৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন শিক্ষিকা। একটি খাতায় দশম শ্রেণির এক ছাত্র লিখেছে, ‘দু’মাস ধরে নীল তিমি খেলছি। একেবারে ফেঁসে গিয়েছি। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। ওরা আমাকে আত্মহত্যা করতে বলেছে। না হলে বাবা-মাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিচ্ছে।’ শিক্ষিকা দ্রুত যোগাযোগ করেন ছাত্রের বাবা-মা, স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত এই চক্রব্যূহ থেকে বার করে আনা গিয়েছিল ছেলেটিকে। জানা গিয়েছিল, ‘ব্লু হোয়েল’-এর ৪৯তম ধাপে পৌঁছে গিয়েছিল সে। তার পরেই ছিল ‘শেষ চ্যালেঞ্জ’, আত্মহত্যা!

Advertisement

ওই ছাত্রকে উদ্ধার করা গেলেও এমন গেমের ফাঁদে পড়ে বহু ছেলেমেয়েরই জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। নেশার ফাঁদে আটকে আত্মনির্যাতনমূলক ‘টাস্ক’ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গেমের নির্দেশ মতো কেউ হাত কাটছে, কেউ পিন বা সুচ ফুটিয়ে নিজের শরীরে ছবি আঁকছে। গেমে জিততে শর্ত মতো আত্মহত্যা করতেও পিছপা হচ্ছে না অনেকে। এমন টাস্কের ভিডিয়ো বিক্রি হচ্ছে ‘ডার্ক ওয়েব’-এ। নয়তো গেমের পেজে সরাসরি সম্প্রচার দেখিয়ে টাকা কামানো হচ্ছে। মনোরোগ চিকিৎসক থেকে সমাজতত্ত্বের শিক্ষকদের বড় অংশেরই দাবি, এমন নেশা যেমন প্রতিহিংসার জন্ম দিচ্ছে, তেমনই অসংবেদনশীল করে তুলছে।

এমনকি, অভিনেতা, অভিনেত্রী থেকে খেলোয়াড়দের হামেশাই দেখা যাচ্ছে এমন ‘গেম খেলো, টাকা জেতো’ বিজ্ঞাপনে। অভিযোগ, এ নিয়ে না রয়েছে আইন, না আছে কোনও কড়া সরকারি নীতি। দায় সেরে ফেলা হচ্ছে ‘নিজ দায়িত্বে খেলুন, নেশা হতে পারে’ বলেই! এর পরে টাকা লাগিয়ে খেলার নেশায় কেউ বাবা-মায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করছে, কেউ হঠাৎ হাতে আসা টাকায় স্বপ্ন দেখছে দামি মোটরবাইক বা মোবাইলের।

Advertisement

তদন্তে জানা যাচ্ছে, গেম খেলে হাতে আসা এমন টাকা দিয়েই দামি মোটরবাইক কেনার স্বপ্ন দেখেছিল বাগুইআটির খুন হওয়া কিশোর অতনু দে। তার বন্ধু এবং পরিবার সূত্রের খবর, অনলাইন গেম খেলায় তুখোড় অতনু দ্রুত পার হতে পারত গেমের একটির পর একটি স্তর। সেই খেলা সে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভ দেখাত। যত বেশি দর্শক, তত আয়। নিজের গেম আইডি সে বিক্রিও করত। সাইবার গবেষক তথা ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং’-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘প্রচুর এমন খেলোয়াড় রয়েছেন। গেমে একটির পর একটি স্তর দ্রুত পার হয়ে যান এঁরা। আবার এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা হয়তো ভাল খেলতে পারছেন না বা শুরু থেকে খেলে ধাপে ধাপে ওঠার সময় তাঁদের হাতে নেই। তাঁরা তখন গেমের আইডি কিনে নেন ভাল খেলোয়াড়দের থেকে।’’

কলকাতা পুলিশের সাইবার শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারিক বললেন, ‘‘ফ্রি-ফায়ার, স্ম্যাশ অব কিংস বা পি-৫ ক্যাসলের মতো গেমের আইডি লক্ষ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়। টাকা ঢাললেই মেলে গিয়ার (ছুরি, বোমা, বন্দুক বা গাড়ির মতো খেলার ভার্চুয়াল উপকরণ)।’’ ওই আধিকারিক জানান, দিনকয়েক আগেই দমদমের এক কিশোর বাবা-মায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে আইডি কিনেছিল। তাতেও হেরে যায়। এমনই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে টাকা খোয়ানোর অনুতাপ তো দূর, বরং নতুন আইডি কিনতে বাবা-মায়ের কাছে আরও টাকা দাবি করে সে। বকুনি দেওয়ায় পরদিন তার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় শোয়ার ঘর থেকে।

এই প্রবণতার কারণ কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি ঘোষণায় জানিয়েছে, গেমের অভ্যাসের কারণে মস্তিষ্কের কোষ থেকে কিছু রাসায়নিক নির্গত হয়, যা আমাদের স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাসেই তৈরি হয় নেশা— যা ব্যবহার, মনঃসংযোগ ও প্রতিদিনের কাজকর্মেও প্রভাব ফেলে। এই পরিবর্তন আদতে ‘গেমিং ডিজ়অর্ডার’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজ়িজ়’-এর (আইসিডি) একাদশতম সংস্করণে এই অসুস্থতাকে নিয়ে এসেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাকৃতিক পরিবর্তন, পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস, মানুষের পরিবর্তিত অভ্যাসের ফলে নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে। ‘গেমিং ডিজ়অর্ডার’ তেমনই এক অসুস্থতা।

এর ওষুধ কী? আপাতত উত্তর নেই কারও কাছে। রাজ্য পুলিশের সাইবার শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্তা বললেন, ‘‘এখনও তো এ নিয়ে তেমন আইনই নেই!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement