মা মানেই কি সর্বংসহা? মায়েদের জীবনেও থাকুক ইচ্ছেযাপন। সন্তান-সংসার ও কর্মজগতের মাঝে প্রত্যেক মা-ই ভাল থাকুন ছবি: জয়দীপ মণ্ডল।
হোমমেকার পৃথার সারাটা দিনকাটে সংসার আর মেয়ে নিয়ে। কিন্তু টিনএজে পা রাখতেই মেয়ের সঙ্গে কোনও মতেরই মিল হয় না মায়ের। এ দিকে মেয়ের জন্যই চাকরি ছেড়েছিলেন পৃথা। আফসোস হয় এখন পৃথার, খুব হতাশ লাগে।
অরিত্রার আবার অপরাধবোধ কাজ করে। ছোট্ট উজানকে ছেড়ে মাঝেমধ্যেই তাঁকে অফিসেরকাজে বাইরে যেতে হয়। দাদু-দিদার কাছে রেখে গেলেও, বাড়ি ফিরে মা-বাবার শীতল চাহনি ও কড়া কথা হজম করতে হয় তাঁকে।
শ্রীময়ী অফিসে থাকলে তাঁর স্বামী ছেলে-মেয়েকে সামলায় ঠিকই। কিন্তু তা নিয়ে ঝগড়াও লেগে থাকে। কথা শুনতে হয় বড়দের কাছে। সব মিলিয়ে শ্রীময়ীর মানসিক চাপও কম নয়।
মা হওয়া কি মুখের কথা! সত্যিই তাই। বাস্তব যেন আরও রূঢ়। এই যে কয়েকটি চিত্র আঁকার চেষ্টা করা হল, তার একটাও কাল্পনিক নয়। মা চিরন্তন ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতীক। সন্তানের চারপাশেই তাঁর সময় কাটবে, এমনটাই যেন স্বাভাবিক। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগছে না, এটুকু কথা বলতে পারা যেন অপরাধের শামিল। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না মা সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। রোজ সন্তান-সংসার, কর্মজগতের দোলাচলে নিঃশব্দেই কত হতাশা-অবসাদের সঙ্গে লড়ে যেতে হয় মায়েদের। তাঁদের খেয়াল কি কেউ রাখেন? কিন্তু মা যে সর্বংসহা নন। তাঁরও একটু স্বস্তির কোণ দরকার, তাঁরও বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে। মায়েরাই যদি চেষ্টা করেন, নিজের জন্য সময় বার করে নিতে পারেন। তার জন্য অবশ্য পরিবার-পরিজনের সাহায্যও দরকার।
সমস্যাটা কোথায়?
সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহা বললেন, “সমস্যাটা আসলে বৃহত্তর। আমাদের সমাজ, জীবনদর্শন ও পরিস্থিতি সবই এর জন্য মূলত দায়ী। এখন বেশির ভাগ পরিবারই নিউক্লিয়ার। যৌথ পরিবারে একটা সুবিধে ছিল, সন্তান সকলের মধ্যে বড় হত। মায়েদের উপরে অতটা চাপ তৈরি হত না। সে হয়তো সংসারের কাজে ব্যস্ত, সন্তান তখন কাকা-পিসি বা তুতো ভাই-বোনের সঙ্গে খেলত। কিন্তু নিউক্লিয়ার পরিবারে মা বাড়িতে থাকলে তার পুরো সময়টাই সন্তানকে দিতে হয়।” ওয়ার্ক ফ্রম হোম যাঁরা করেন, তাঁরা কাজ-সন্তান-সংসারের ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’-এ পড়ে যান। আর হোমমেকাররা সংসার আর সন্তান নিয়ে একে নাজেহাল, তার উপরে কারও কারও আইডেন্টিটি ক্রাইসিস সঙ্গী হয়।
আর একটি সমস্যা উল্লেখ করলেন জলি, সেটা হল সন্তানের কাছ থেকে মায়েদের আশা-প্রত্যাশাও মায়েদের হতাশার আরও এক কারণ। নিজের সবটুকু দিয়ে সন্তানকে মনের মতো গড়তে চান প্রত্যেক মা-ই। হয়তো গান শেখালেন বা নাচ। কিন্তু সন্তান একটু বড় হতেই তার পছন্দ হয়তো বদলে গেল। তখন মায়ের মনে হয়, এত পরিশ্রম করে, টাকা খরচ করে এত কিছু করানোর এই ফল? তার থেকেও হতাশা দানা বাঁধে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম ভিন্ন একটি বিষয় উল্লেখ করলেন, “সন্তানরা কেমন তৈরি হল, তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা দিয়ে অনেক সময়ে মায়েদের মূল্যায়ন করা হয়। এখনও আমাদের সমাজে ছেলেমেয়ে দোষ করলে মাকেই কথা শুনতে হয়। ফলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। তার সঙ্গে নিজের কাজ ব্যালান্স করার দায়িত্ব থাকে। এই ব্যালান্স করাটা তখনই সম্ভব যদি বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কিছু দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া যায়।”
একটু অবসর আর যত্ন চাই
আইআইটি খড়্গপুরের ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্য বললেন, “প্রথমেই এক্সট্রিম ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সন্তানের নামে কেউ কিছু বললে বা কর্মক্ষেত্রে কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে সাঙ্ঘাতিক অবসাদ গ্রাস করে। চট করে মাথা গরম হয়ে যায়, অনেকে আবার ভেঙে পড়েন। তখন সন্তানের উপরে গিয়ে রাগ পড়ে। তাই সে সময়ে নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে আনা জরুরি। ভাল গান শুনুন বা রাস্তায় হনহন করে খানিকটা হেঁটে আসুন।” কাছেপিঠে বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারেন। শুনতে সামান্য মনে হলেও এগুলো কাজে দেয়।
ছবি: অমিত দাস।
কাজ ভাগ করে নেওয়া জরুির। “সকালে একটা সময় সন্তানের জন্য বরাদ্দ থাকুক, তার পরে হয়তো অফিসের কাজ শুরু হয়ে গেল। তখন পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। তার পরেই বাড়ি ফিরে আবার সন্তানকে নিয়ে না বসে নিজের একটা ‘মি টাইম’ বার করুন। আধ ঘণ্টা হলেও সেই সময়টুকু নিজের জন্য থাকুক। দরকার হলে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব মি’র একটা বোর্ড বা সাইন ব্যবহার করুন,” বললেন দেবারতি। ওরা ছোট হলেও বড়দের কিন্তু বোঝে। “আপনি যদি ওকে বুঝিয়ে বলেন যে, এই সময়টা আপনি একা থাকতে চান, ওরা সে সময়টা আপনাকে দেবে,” বললেন জলি লাহা।কিছু দায়িত্ব ছাড়তেও শিখতে হবে বলে মত দেবারতির। অনেক মা-ই ভাবেন, ‘সন্তানকে আমার মতো করে কেউ খাওয়াতে পারবে না’ ইত্যাদি। এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। ওকে স্বাবলম্বী হতে শেখান। ওর কাজগুলো দরকার হলে স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিন। তাতে আপনিও সময় পাবেন, সন্তানও স্বনির্ভর হবে।অফিসের সব কাজ হাতে নিয়ে অনেকে বসে থাকেন। ‘না’ বলতে পারেন না। এ দিকে বাড়ির সমস্যার মাঝে সে কাজও সামলে উঠতে পারেন না। এতে চাপ তৈরি হয় নিজের উপরেই। তাই যতটুকু আপনার সাধ্য সেটুকুই করুন। অহেতুক নিজের উপরে চাপ সৃষ্টি করবেন না।দেবারতি মনে করিয়ে দিলেন, “হোমমেকারদের মানসিক চাপ কিন্তু তুলনায় বেশি। যেহেতু কর্মরত মহিলারা কাজের মধ্যে কিছুটা সময় কাটান, তাঁরা স্পেস পান। কিন্তু হোমমেকাররা যেহেতু অধিকাংশ সময়ে বাড়িতে থাকেন, সংসারের সব দায়িত্ব তাঁদের। তাঁরা যদি নিজের জন্য সময় চান, তাতেও জবাবদিহি করতে হয়। অনেক সময়ে সেটুকুও তাঁরা পান না।” তাই অল্প কিছু হলেও নিজের শখ-আহ্লাদ বজায় রাখতে হবে।“মায়েদের বয়সটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মেনোপজ়ের সময়ে মেয়েদের এমনিতেই হরমোনাল পরিবর্তন দেখা যায়, যা থেকে মুড সুয়িং, ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। তার সঙ্গে যদি সন্তানের ব্যর্থতা যোগ হয়, তা হলে হতাশা বেড়ে যায়। হয়তো ছোট সন্তানের জন্য মা চাকরি ছেড়েছেন। বছর বারো ঘুরতেই সন্তানের নিজের জগৎ তৈরি হয়ে যায়। এ দিকে মাঝবয়সে পৌঁছে তখন মা-ও নিজের কেরিয়ার শুরু করতে পারছেন না। তখন সব দিক থেকে ক্লান্ত লাগে, অর্থহীন মনে হয় সব কিছু। তাই নিজের জগৎ তৈরি করতে হবে। সন্তান এবং মা যে দুটো আলাদা মানুষ, সেটা গোড়া থেকেই স্পষ্ট করা জরুরি,” বলে মনে করেন ডা. জয়রঞ্জন রাম।সংসারের কাজ হোক বা সন্তানের বা অফিসের, সেগুলো সবই কাজ। আপনার অবসর আপনাকেই বার করতে হবে। সে সময়টা নিজের মতো কাটান। কাছের বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটালেও মন ভাল থাকে। বন্ধুর সময় না থাকলে একটা সিনেমা দেখলেন বা বই পড়লেন। মনের মতো সেজে কফিশপে গিয়েও বসতে পারেন কিছুক্ষণ। নতুন কিছু শিখতে পারেন। ড্রাইভিং, কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট, আঁকার ক্লাসে যোগ দিন। শেখার তো কোনও বয়স নেই। শিখতে পারার আনন্দ প্রাণবন্ত রাখবে আপনাকে।
মনে রাখবেন সব দিকে ভারসাম্য রাখতে না পারলেও ক্ষতি নেই। ৩৬৫ দিন ব্যালান্স করা সহজ নয়, সম্ভবও নয়। মা মানেই সুপারউওম্যান নয়, সে-ও মানুষ। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যেক দিনের প্রায়োরিটি ঠিক করুন। কোনটা সে দিন বেশি জরুরি, সে দিকে মন দিন। বাকি দিকে কী হচ্ছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তেমনই একটা দিন যদি নিজের জন্য রাখা জরুরি মনে হয়, তা-ই রাখুন। তার জন্য অপরাধবোধে ভুগবেন না, জবাবদিহিও করবেন না। রোজরুটিন থেকে মায়েদেরও ছুটি দরকার। একটু সুখাবসর না হয় উপহার দিলেন নিজেকে।
মডেল: সুস্মেলী দত্ত, মোনালিসা সৎপতি; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল; মেকআপ: চয়ন রায়