—প্রতীকী চিত্র।
দৃশ্য ১: ‘ইশ, এই সব কেউ দেখে? গোলাপ ফুলের চপ!’ ভাইরাল রিলটি নিয়ে এমন মন্তব্যের পরেও অবশ্য রাতে প্রায় চার ঘণ্টা এমনই কত রিল দেখে কাটল বছর ৩৮-এর অয়নের। এ দিকে পরের দিন অফিস।
দৃশ্য ২: একাদশ শ্রেণির তিথিকে নিয়ে নাজেহাল তার অভিভাবক। পড়াশোনা, খেলাধুলো, কিছুতেই আগ্রহ নেই মেয়ের। তিথির দুঃখ? তার কন্টেন্টে হাজার হাজার লাইক পড়ছে না যে!
দু’টি দৃশ্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমাজমাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে পড়ার ভয়। সঙ্গে রয়েছে রিল-শর্টস-ভ্লগের মতো কনটেন্টের প্রতি এক ধরনের মোহ। অনেকে এটিকেই বলেন ‘ফোমো’। অর্থাৎ, ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’। শব্দটা কিন্তু নতুন নয়। অনেক দিন ধরে চর্চা হচ্ছে শব্দটি নিয়ে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেন এক মানসিক রোগে পরিণত হচ্ছে ফোমো।
যশোজিৎ বন্দ্যোপাধ্য়ায় এবং পূজিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি:শুভদীপ সামন্ত।
শুধুই উদ্বেগ?
সমাজমাধ্যমে যে ধরনের লেখা, ছবি, ভিডিয়ো পোস্ট করা হচ্ছে, তাকেই কনটেন্ট বলা হয়। এই কনটেন্ট তৈরি ও পোস্ট করার প্রবণতা সব সময়ে খারাপ নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “করোনার সময়ে মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। তখন সমাজমাধ্যমে ছবি, ভিডিয়ো পোস্ট করার সংখ্যাও বেড়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্দার আড়াল থেকেই চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা নিজের নানা প্রতিভা, জীবনের গল্প তুলে ধরার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এই কনটেন্ট।” কিছু ক্ষেত্রে তা উপার্জনের পথও হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞান বলে, কোনও কাজ করে পুরস্কার পেলে, আমাদের মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের ‘ফিল গুড’ হরমোন (ডোপামিন) ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনের কাজ হল আমাদের খুশি রাখা, আরও ভাল কিছু করতে উৎসাহ দেওয়া।
একই ভাবে, যখন কেউ মনে করেন যে কাজের ফাঁকে বা অবসর সময়ে ‘একটা রিল-পোস্ট করি বা দেখি’, তখন তাঁদের এক ধরনের ‘আত্মতৃপ্তি’র অনুভূতি হয়, বলছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা নীলশ্রী ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “এই অভ্যেস নতুন নয়। বারবার নানা বই উল্টেপাল্টে দেখা বা টিভির চ্যানেল দ্রুত পাল্টানো, এমন প্রবণতা মানুষের আগেও ছিল। বর্তমানে মুঠোফোনের দৌলতে সেই সুযোগটা বেড়ে গিয়েছে। তাই ক্রমাগত স্ক্রোল, সোয়াইপ করাও বেড়েছে কয়েক গুণ। নিজের অবচেতনেই হয়তো অনেকে এটা করেন।” তাঁরা হয়তো বুঝতেও পারেন না কী দেখছেন, কেন দেখছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ভাইরাল হওয়া বা ট্রেন্ডে থাকার মরিয়া চেষ্টা আদতে যেন ডিজিটাল দুনিয়ায় ‘টিকে থাকার লড়াই’। পোস্টে ক’টি লাইক, শেয়ার বা কত ক্ষণ ভিডিয়ো ভিউ হচ্ছে, তা-ই সাহায্য করছে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের নিজ-নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে।
কথাটির সঙ্গে কিছুটা সহমত জনপ্রিয় ইউটিউবার উন্মেষ গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি জানাচ্ছেন, ২০১৯-এ যখন ইউটিউবে মজার কনটেন্ট বানানো শুরু করেন, তখন সেগুলি হত দীর্ঘমেয়াদি। ছোট-ছোট রিল বানানোর বিষয়টি সে ভাবে প্রচলিত ছিল না। “টিকটক বন্ধের পরেই শুরু হল রিল-শর্টসের রমরমা। আমূল পরিবর্তন এল কনটেন্টের ধরনে। দর্শকের অভ্যেসের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে চেষ্টা করতে হল স্বল্প দৈর্ঘ্যের মধ্যে অভিনব কায়দায় গল্প বলা। দর্শক যদি কনটেন্টে বদল চান, তা হলে ক্রিয়েটরদেরও সেই সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। তা না হলে বিজ্ঞাপন পেতেও সমস্যা হয়,” বললেন উন্মেষ।
ভিডিয়ো ক্রিয়েটর ঝিলম গুপ্ত অবশ্য লকডাউনে অবসরে ভিডিয়ো বানানো শুরু করেন। তখন তিনি অন্যত্র কাজ করলেও, পরে অফিস ছাড়েন। এখন তাঁর উপার্জনের মাধ্যমই হল কনটেন্ট তৈরি। তবে এখনও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিয়ো বানাতে তিনি স্বচ্ছন্দ নন। ঝিলমের কথায়, “রয়ে বসে, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যাবে, সমাজমাধ্যমে এমন দীর্ঘমেয়াদি কনটেন্ট দেখতে ও বানাতে বেশি পছন্দ করি।”
সমস্যা যেখানে
আবীরের মতে, সাময়িক আনন্দ ও বিনোদনের জন্য বানানো এই ছবি-ভিডিয়োগুলি আসক্তিতে পরিণত হলে সমস্যার সূত্রপাত। তখন দিনের সিংহভাগ সময় অসংখ্য কনটেন্ট বানাতে বা দেখতে চলে যায়। কখনও বৈচিত্র আনতে কনটেন্ট ‘বিকৃতির’ পর্যায়ে চলে যায়। সম্প্রতি সার্ভাইকাল ক্যানসারে মডেল পুণম পাণ্ডে নিজের মৃত্যুর খবর পোস্ট করেন সমাজমাধ্যমে। যিনি কনটেন্টটি ভাইরাল করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্যটি হয়তো সফল। কিন্তু তা কতটা কাম্য?
ট্রোলের শিকার?
বহু ক্ষেত্রে ট্রোলিং, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত নেতিবাচক মন্তব্য ও কটূক্তির শিকার হতে হয় অনেককে। তা সহ্য করতে না পেরে পাল্টা কুমন্তব্য করা বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার ঘটনাও দেখা যায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীরের পরামর্শ, কোন কথাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া যায়, তা নিজেকে বিবেচনা করতে হবে। আগে কি মানুষ অপরকে নিয়ে সমালোচনা, অযাচিত আক্রমণ করত না?
হতে পারে রোগও
দিনে আনুমানিক ছ’-আট ঘণ্টা যদি কেউ স্ক্রিনের সামনে কাটাতে থাকেন, তা হলে দেখা দিতে পারে,
নিয়ন্ত্রণ জরুরি
কী দেখব, কেমন কনটেন্ট তৈরি করব, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা জরুরি। ‘আসক্ত’ হয়ে পড়ছি মনে হলে জরুরি ‘ডিজিটাল ডিটক্সিফিকেশন’। যুব সমাজের সঙ্গে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যেও ডিজিটাল-আসক্তি বাড়ছে। তাদের বোঝানো জরুরি যে, স্ক্রিনের দুনিয়াটাই সব নয়। বাইরে সিনেমা-নাটক দেখলেও মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।
ফোমো নিয়ে চর্চার আবহে আমরা বরং ভাবি ‘জোমো’ নিয়ে, অর্থাৎ ‘জয় অব মিসিং আউট’।