—প্রতীকী চিত্র।
“পার্কারের কলম, দামী জিনিস। ব্যোমকেশ কলম ভালবাসে, সে তাহার মাথার ক্যাপ খুলিয়া দেখিল, পিছন খুলিয়া কালি ভরিবার যন্ত্র দেখিল; তারপর কলম ফিরাইয়া দিয়া বলিল, ‘ভাল কলম। চুরি করতে হলে এই রকম কলমই চুরি করা উচিত।”
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গরহস্য’-র এই অংশ থেকেই ব্যোমকেশের কলমপ্রীতির উদাহরণ পাওয়া যায়। এই উপন্যাসেই আবার উল্লেখ রয়েছে, মণিলাল এমন একটি কলম বিয়েতে যৌতুকও পেয়েছিল। সহজেই অনুমেয়, সে যুগে কলম কেমন অমূল্য সম্পদ ছিল।
বুকপকেটে পার্কার, শেফার্স, সোয়ানের মতো নামীদামি একটা কলম থাকলেই কলমধারীর মানসম্মান যেন বেড়ে যেত কয়েকগুণ। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময়ে কোন কলম, পরীক্ষার খাতায় বা সইসাবুদের সময়ে কোন কলমে লেখা হবে... তার ভাগ তো ছিলই। পত্র লেখা হোক বা দীর্ঘ উপন্যাস, কলমের বাছবিচার ছিল আমজনতা থেকে সাহিত্যিকমহলেও। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ফাউন্টেন পেনের ভক্ত। ১৮৮৪-তে লুইস ওয়াটারম্যান বাজারে নিয়ে এলেন ফাউন্টেন পেন। বিজ্ঞাপন বেরোল, ‘রিলিফ ফ্রম দ্য স্লেভারি অব দ্য ইঙ্কস্ট্যান্ড’। কবিগুরু খুশিমনে ‘ফাউন্টেন পেন’-এর নাম রাখলেন ‘ঝরনা কলম।’ তবে ফাউন্টেন পেন তারও আগে এসেছে, মনে করা হয়। সপ্তদশ শতকে ইউরোপে এই কলম পাওয়া যেত। লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ও ক্রস-সেকশনেও এমন কলম ব্যবহারের প্রমাণ মেলে, যার মধ্যে কালি রাখার রিজ়ার্ভয়ার ছিল। তাকে রিজ়ার্ভয়ার পেন বলা হত।
মসির জোর
তবে ফাউন্টেন পেনের যুগান্তকারী আবিষ্কারের আগে থেকেই তো লেখালিখির পাঠ শুরু। সে সময়ে চল ছিল খাগের কলমের। এখন অবশ্য তার খোঁজ পড়ে সরস্বতী পুজোর আগের দিন। কিন্তু আগেকার দিনে রীতিমতো খাগের কলমে তালপাতায় লেখা হত পাঠশালায়। কাঠকয়লার গুঁড়োর সঙ্গে গাছের আঠা মিশিয়ে তৈরি হত কালি। কাঠের উনুনে চাপানো কড়াইয়ের পিছনে রান্নাশেষে যে কালি জমে থাকত, তা লাউপাতায় সংগ্রহ করে জল মিশিয়ে তৈরি করা হত লেখার কালি। অনেকে আবার কালি ঘন করতে তার মধ্যেই ঘষে মিশিয়ে নিতেন হরীতকী আর আতপচাল বাটা। আসলে হরীতকী, আমলকী, বহেরা মিশিয়েও কালি তৈরির চল ছিল। তার উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রীপান্থ-র ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে—
“তিল ত্রিফলা শিমুল ছালা/ ছাগদুগ্ধে করি মেলা, লৌহপাত্রে লোহায় ঘষি/ ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসি”। অর্থাৎ ভাল কালি তৈরির জন্য তিল, ত্রিফলা (হরীতকী, আমলকী, বহেরা) ও শিমুল গাছের ছাল ছাগলের দুধের সঙ্গে মিশিয়ে লোহার পাত্রে ঘষে তৈরি করা হত কালি। সেই কালি কাগজে এত সুন্দর লেগে থাকত যে, কাগজ ছিঁড়ে গেলেও কালি উঠত না।
খাগের কলমের পাশাপাশি পাখির পালক দিয়েও লেখার চল ছিল। কলমের ইংরেজি নাম পেনের মধ্যেই এই তথ্য সুসংরক্ষিত। ইংরেজি ‘পেন’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘পেন্না’ থেকে, যার অর্থ পাখির পালক। এ দেশেও লেখালিখির কাজে খাগের কলমের পাশাপাশি পাখির পালকের ব্যবহার ছিল। মিশরীয়রা আবার কাঠির ডগায় তামার নিবের মতো ধাতব পাত পরিয়ে লিখত। ধাতব পাতের গড়ন এমন হত, যাতে কালি ধরে রাখতে সুবিধে হয়। গ্রিসে আবার কলম তৈরি হত হাতির দাঁত দিয়ে, যাকে বলা হত স্টাইলাস।
ক্রমে নানা রকমের কলম ঘুরে তৈরি হল ফাউন্টেন পেন। এই কলমের ব্যবহার বাড়লেও তার কালির দাগে নাস্তানাবুদ হত গৃহস্থরা। সে সময়ে পড়ুয়া বা মসিজীবীদের অন্তত দু’-একটা ফতুয়া বা পাঞ্জাবি অবশ্যই থাকত, যার বুকপকেটে নীল-কালো ছাপ সঙ্গী হত। সেখানেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল পার্কার। ‘সেফটি সিলড ফাউন্টেন পেন’ নামে প্রকাশ পেল পার্কারের বিজ্ঞাপন। লেখা থাকত, “শুইয়ে, লম্বা করে, বেঁকিয়ে... যে ভাবেই এই পেন রাখুন না কেন, কালি লিক করবে না।” অন্য দিকে সোয়ানের বিজ্ঞাপন এল ‘নেভার ব্লটস, নেভার লিকস, নেভার ফলস।’ ১৯০৩ নাগাদ কঙ্কলিন বাজারে নিয়ে এল সেল্ফ ফিলিং পেন, বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত, ‘সম্ভবত এটাই একমাত্র ফাউন্টেন পেন, যাতে কালি ভরা যায় ও পরিষ্কার করা যায় এক হাতে।” এ রকম ‘সেল্ফ ফিলিং পেন’ শেফার্সও এনেছিল বাজারে। পেনের বিজ্ঞাপন আবার পোক্ত হত বিভিন্ন সাহিত্যকদের মন্তব্যে। কঙ্কলিন ক্রেসেন্ট ফিলার ছিল লেখক মার্ক টুয়েইনের প্রিয় কলম। তাঁর মন্তব্যও জুড়ে দেওয়া হল বিজ্ঞাপনে।
কলমে লেখো নাম
বিভিন্ন রকম কলমের প্রতি বাঙালি লেখকদের ঝোঁকও কম ছিল না। এক-একজনের লেখা খুলত এক-এক কলমে। কলম (অবশ্যই ফাউন্টেন পেন) নিয়ে আবেগপ্রবণ ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ওঁর প্রিয় কলম ছিল শেফার্স। যদিও ওয়াটারম্যান, পার্কার, মঁ ব্লাঁ-ও ছিল তাঁর সংগ্রহে। এক বার তাঁর মেয়ের চিঠি পেয়ে বিষম রেগে গেলেন। কারণ সে চিঠি ডট পেনে লেখা। আমেরিকানিবাসী মেয়েকে ধমকে চিঠি লিখলেন, “তোর সাহস হয় কী করে আমায় ডট পেনে চিঠি লেখার!” তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার পছন্দ ছিল মোটা নিবের শক্ত, দামি কলম। লিখতে বসে আগে সুলেখা কালিতে ইষ্টদেবীর নাম লিখে শুরু করতেন লেখা। এ দিকে টাকাপয়সার টান থাকায় কোনও কলমের বিলাসিতা ছিল না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একবার উপহার পেলেন সোয়ান কলম। তা দিয়ে লিখতে লিখতে এক সময়ে নিব, জিপ বেরিয়ে এল। সুতো দিয়ে সেই নিব-জিপ এঁটেই লেখা চালু রইল।
অবশ্য বল পেন আবিষ্কার হল কয়েক বছর পরেই। ঘূর্ণায়মান ধাতব বল পরিয়ে দেওয়া হল কালিভর্তি পেনের মুখে। তা আটকে থাকত সকেটের মতো। কাগজে-কলমে ঘর্ষণে ও কালির চাপে ছোট্ট বল ঘুরতে-ঘুরতেই অক্ষর ফুটে উঠত। কিন্তু বলপয়েন্ট পেন আসার পরেও ফাউন্টেন পেনের কদর কমল না। লেখক মহলে বেশির ভাগ সময়েই অগ্রাধিকার পেয়েছে ফাউন্টেন পেন। অনেকের মতে, ইচ্ছে করলেও দ্রুত গতিতে লেখা সম্ভব নয় ফাউন্টেন পেনে। ফলে প্রত্যেক শব্দ, বাক্য লেখার আগে যে সময় পাওয়া যায়, তাতে সুসংহত হয় রচনা। এই কারণেই হয়তো স্কুলগুলোয় পেনসিল থেকে পেনে ওঠার প্রথম ধাপ ছিল ফাউন্টেন পেন। ক্লাস ফোরে উঠলেই ফাউন্টেন পেনে হাতের লেখা অভ্যেস করার চল অবশ্য এখনও বজায় আছে
কিছু স্কুলে।
নিরুদ্দেশের সন্ধানে
দামি একটা, দুটো পেন হয়তো এখনও পাওয়া যায় বাড়ির দেরাজে। কিন্তু রোজকার জীবনে যান্ত্রব অক্ষরে আঙুলের সজোর ধাক্কায় পিছু হটে গিয়েছে কালি-কলম। উপন্যাস, গল্প, সাহিত্য সবই টাইপ হয়ে যাচ্ছে দু’চার আঙুলে। চিঠিও চলে যাচ্ছে ইমেলে। কিন্তু কলমের রেখায় মনের গতি আর ধরা পড়ে কোথায়? নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত প্রেমপ্রস্তাব বা প্রেমপত্র ভেসে যেত মসির আবেগে। বন্ধুবান্ধবের সেরা কলমটা ধার নিয়ে চলত চিঠি লেখা। নামী-দামি কলম তো দূরস্থান, চাইনিজ় ইঙ্কের ফাউন্টেন পেনই তখন ত্রাতার ভূমিকায়। বাঁকাচোরা হস্তাক্ষর, ভুল বানানের সেই চিঠির কালিতে অবশ্য প্রেম থাকত ষোলোআনা। কখনও সে থরথর আবেগ টুপ করে খসে পড়ে লেখার কালি খানিক মুছে দিত। চিঠির সেই ধুয়ে যাওয়া কালিতে প্রেয়সী ঠিক পড়ে নিত প্রেমিকের মন। যান্ত্রব মেসেজে কি আর সেই আবেগ ধরা পড়ে!
যতই কলমের ব্যবহার কমে যাক, হাতে কলম এসে পড়লে যান্ত্রব খুটখাট থামিয়ে কলমের আখরে নিজের নাম বা দু’চারটে শব্দ লিখে ফেলবেন না, এমন মানুষ পাওয়া ভার। তাই বুঝি এখনও কলকাতার বুকে টিমটিম করে টিকে রয়েছে পেন হসপিটাল। চৌরঙ্গীর মোড়ে এই হাসপাতালে এখনও আদ্যিকাল থেকে শুরু করে ইদানীংয়ের সব পেন তাঁরা সারাই করেন। কোন পেনের নিব ভাঙা, কোন পেনে জং, রিফিলে কালি লিক করছে... সব নিখুঁত সারিয়ে তোলেন।
সেই দোকানের সামনে দেখা মিলল এক প্রৌঢ়া ও তাঁর নাতির। কম্পিত হাতে ব্যাগ থেকে একটা লাল পেনের বাক্স এগিয়ে দিলেন দোকানের মালিকের দিকে, “দেখুন তো, এর নিবটা ঠিক করা যায় কিনা! নাতি এখন পেনে লিখবে তো! এটা দিয়েই শুরু করাব ভাবছি হাতের লেখা। ওর দাদুর খুব ইচ্ছে ছিল নাতি বড় হয়ে এই কলমে লিখবে...” এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে এ ভাবেই হয়তো টিকে থাকে হারানো প্রাপ্তিরা। যতই যান্ত্রব অক্ষর এসে রাজত্ব কায়েম করুক লেখালিখির জগতে, কলমের কালি ফুরোতে এখনও ঢের দেরি...