অরিত্র রায়চৌধুরী
বিবাহ শব্দটির সঙ্গে সিন্দুর ও আলতার অঙ্গাঙ্গি যোগাযোগ। সিন্দুরই নারীকে বধূ রূপে স্বীকৃতি দেয়। আর তা যদি হয় পঞ্চাশ বছরের পুরনো বিশ্বাসযোগ্য সংস্থা ‘খুকুমণি’র তা হলে তো সোনায় সোহাগা! দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে, এই ব্র্যান্ড প্রতিটি বাঙালির গৃহস্থ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, সুচারু পরিকল্পনা, এবং নিপুণ নেতৃত্ব। সংস্থার সেই পথ চলার গল্প নিয়ে এবারে হাজির ‘খুকুমণি সিন্দুর ও আলতা’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অরিত্র রায়চৌধুরী। সঙ্গে জানালেন তাঁদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাও।
এ বছর তো খুকুমণির পঞ্চাশ বছর? কী ভাবে শুরু হল ‘খুকুমণি’র যাত্রা?
হ্যাঁ, এবার খুকুমণির সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ। আমার দুই ঠাকুরদা প্রয়াত গোপীকান্ত রায়চৌধুরী ও শ্রীকান্ত রায়চৌধুরী এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। হাওড়া জেলার বাগনানের কাছে মুগকল্যাণ গ্রামের হরিনারায়ণপুরে আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল। ওখানেই ব্যবসার শুরু। বাগনানে বইয়ের দোকান ছিল ওঁদের। কিন্তু প্রত্যক্ষ উৎপাদন করে কিছু একটা শুরু করতে চেয়েছিলেন ওঁরা। নেলপলিশ তৈরি ও বিপণন দিয়ে ব্যবসা শুরু হয়।তখনও অবশ্য ‘খুকুমণি’র ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি।
শুনেছি আপনার ঠাকুমাও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
সেই সময়ে মেয়েরা কিন্তু বাইরের কাজ কমই করতেন। বিশেষ করে জেলায়। আমার ঠাকুমা স্বর্গীয়া সন্ধ্যা রায়চৌধুরী (গোপীকান্ত রায়চৌধুরীর স্ত্রী) ঠাকুরদার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসার হাল ধরেছিলেন। এমনকী সরাসরি সিন্দুর, আলতার উৎপাদনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। বর্তমানে প্রতিটি মানুষ মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছেন। অথচ আমার ঠাকুমা সেই সময়ে গ্রামের মহিলাদের কাজ দিয়েছিলেন। সিন্দুর, আলতা তৈরি থেকে প্যাকেজিং– সব কিছু করতেন মহিলারা। তাঁদের কাজ শিখিয়ে নেওয়া হতো। এখনও আমরা সেই প্রথা বজায় রেখেছি।
আপনারা সেই প্রথা বজায় রেখেছেন! অর্থাৎ?
এখনও আমাদের খুকুমণি ব্র্যান্ডে কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের প্রায় অর্ধেকই মহিলা। এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এখনও কিন্তু উৎপাদনের দিকটা পুরোপুরি সামলান আমার মা সোমা রায়চৌধুরী। তবে এখন তো পুরো ব্যাপারটাই অনেক বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক। তাই প্রস্তুত থেকে শুরু করে প্যাকেজিং সব ক্ষেত্রেই কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
খুকুমণির এগিয়ে চলার ইতিহাসটা আরও একটু জানতে চাই।
১৯৮০ সালে ব্যবসার স্থান পরিবর্তন হয়। বাগনানের খাদিনানে আসে। আমার বাবা শ্রী প্রদীপ রায়চৌধুরী একমাত্র সন্তান। বাবা ছোটবেলা থেকে এই ব্যবসার সঙ্গে থেকে বড় হলেও পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। বাবা অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রদীপ কেমিক্যাল ওয়ার্কসকে বড় করে তুলেছেন। খুকুমণি ব্র্যান্ডকে সমাজের সব ধরনের মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।
প্রদীপবাবু নিশ্চয়ই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সিন্দুর ও আলতা তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছিলেন?
একেবারেই তাই। আর সেই কারণেই ‘খুকুমণি’র সবক’টি পণ্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। প্রদীপ কেমিক্যাল ওয়ার্কস নামটা শুনে বুঝতেই পারছেন খুকুমণির প্রতিটা প্রোডাক্ট কেমিক্যালি টেস্টেড। ত্বক ও চুলের নিরাপত্তার কারণে খুকুমণির সিন্দুর আলতা আধুনিক পরীক্ষাগারে নিয়মিত যাচাই করে তার পরেই বাজারে ছাড়া হয়। বিএসআই (BSI) থেকে খুকুমণি পেয়েছে ISO 9001:2015, গুণমানের জন্য শংসাপত্র। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে খুকুমণি ব্র্যান্ড পেয়েছে ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস’ (জিএমপি) সার্টিফিকেট।
আপনার মা সোমা রায়চৌধুরী কী ভাবে খুকুমণির সঙ্গে যুক্ত?
বিয়ের পর থেকে আমার মা, ঠাকুমার সঙ্গে উৎপাদনের বিভিন্ন কাজ দেখতেন। যে সব মহিলা কর্মী কাজ করেন, তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। ২০০২ সালে ক্ষুদ্র শিল্পে সাফল্যের জন্য খুকুমণির অন্যতম কর্ণধার হিসেবে সোমা রায়চৌধুরীকে বিশেষ ফলক দিয়ে সম্মান জানায় ক্ষুদ্র শিল্প ফ্রেডারেশন (ফসমি)। এবং এখনও খুকুমণি ব্র্যান্ডের প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন থেকে প্যাকেজিং সবটাই হয় আমার মায়ের তত্ত্বাবধানে।
খুকুমণির সিন্দুর ও আলতায় নাকি নানারকম ভেষজ উপকরণ থাকে?
ঠিকই শুনেছেন। প্রথমত, খুকুমণির সিন্দুর ও আলতায় এমন কোনও রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হয় না, যা ত্বক ও চুলের ক্ষতি করবে। দ্বিতীয়ত, এখন সিঁদুরে মেশানো হচ্ছে চন্দন ও তুলসি। তুলসি ত্বকে ইনফেকশন হতে দেয় না আর চন্দন ত্বককে মোলায়েম রাখে। খুকুমণির আলতায় থাকে গ্লিসারিন ও অ্যালোভেরা, যা পায়ের ত্বক নরম রাখে, গোড়ালি ফাটা থেকে বাঁচায়।
আপনাদের লিক্যুইড সিন্দুরেরও তো খুব চাহিদা। এর বিশেষত্ব কী?
বর্তমান প্রজন্মের মেয়েরা লিক্যুইড সিন্দুর খুব পছন্দ করেন। বিশেষ করে যাঁরা কাজ করছেন। আর পছন্দ করেন স্টাইল সচেতন মেয়েরা। এটা চটজলদি পরা যায়, গরমে ঘামে ছড়িয়ে যায় না। লাল ও মেরুন, দু’টি রঙে পাওয়া যায় ‘খুকুমণি’র প্রিমিয়াম হার্বাল লিকুইড সিন্দুর এবং এক্সক্লুসিভ হার্বাল লিকুইড সিন্দুর।
এছাড়াও খুকুমণি ক্লাসিক সিন্দুর অর্গানিক আর কয়েকদিনের মধ্যেই বাজারে আসছে। গুণমানেও দারুণ! যে কোনও অন্য নামী ব্র্যান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এতে থাকবে হলুদ, তাই রঙটা হবে হলদে লাল। হলুদ ত্বকের সুরক্ষা দেবে। আরও অনেক ধরনের প্রসাধনী নিয়ে আমাদের ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আমাদের কোনও প্রোডাক্ট বাজারে পৌঁছনোর আগে বিভিন্ন রকম সতর্কতা নিই আমরা। উপভোক্তাদের সুরক্ষা আমাদের কাছে প্রথম ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
খুকুমণি ব্র্যান্ড যেমন পশ্চিমবঙ্গ এবং তার বাইরেও বাজার দখল করেছে, তেমন শুনেছি নকলও হচ্ছে?
এটা সত্যিই খুব সমস্যার। কম দামে নকল খুকুমণি সিন্দুর আলতা বিক্রি হচ্ছে, যার কোয়ালিটি খুব খারাপ। মানুষ ঠকছেন। মানুষকে সচেতন হতে হবে। সঠিক প্যাকেজিং দেখে তবেই কিনতে হবে।
খুকুমণির ইউএসপি কী?
আমাদের কোম্পানির ইন হাউজ ল্যাবরেটরি আছে। এখানে প্রতিটি সামগ্রী পরীক্ষা করে তার পরেই ব্যবহার করা হয়। ক্ষতিকর কেমিক্যাল নয়, বরং ফুড গ্রেড কালার দিয়ে প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়। ‘খুকুমণি সিন্দুর ও আলতা’ ব্র্যান্ড কখনও কোয়ালিটির সঙ্গে আপোস করেনি, করবেও না। সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দু’টিতেই আমরা সমান গুরুত্ব দিই।
প্রদীপবাবুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি অরিত্র। যাঁর হাতে রয়েছে ‘খুকুমণি’কে আগামী দিনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই সময় নতুন প্রজন্মের ক্রেতারা খুকুমণির কাছে কী চায় বলে আপনার মনে হয়?
আমার মনে হয়, ভাল গুণমানের পাশপাশি নতুন প্রজন্ম চায় ঝকঝকে আধুনিক প্যাকেজিং। তার জন্য দাম একটু বেশি হলেও তাদের দিতে আপত্তি নেই। তাই আমি এ’দিকে নজর দিচ্ছি। তাছাড়া সিন্দুর ও আলতার পাশাপাশি অন্য প্রসাধনীও আসতে চলেছে খুকুমণি ব্র্যান্ডের আওতায়। তবে আগেও যেটা বলেছি, শেষেও সেটাই বলব। খুকুমণির পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রাখতে গুণমানের সঙ্গে কখনও আপোস করব না।
এই প্রতিবেদনটি ‘খুকুমণি সিন্দুর ও আলতা’র সঙ্গে আনন্দবাজার ব্র্যান্ড স্টুডিয়ো দ্বারা যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।