দহন: তীব্র গরমে গলে গিয়েছে রাস্তার পিচ। ডিউটি করার সময়ে রোদ থেকে বাঁচতে রুমালে মুখ ঢেকেছেন ট্র্যাফিক সার্জেন্ট। ধর্মতলায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী
বর্ষা কোথায়! এ যে সম্পূর্ণ শুকনো খটখটে।
ফুটবল বিশ্বকাপের মরসুমে গত বৃহস্পতিবার থেকে তাপপ্রবাহ এমনই দাপুটে স্কিল দেখাতে শুরু করেছে যে নাজেহাল শহরবাসী। বেলা বাড়তেই রাস্তা প্রায় সুনসান। উত্তর থেকে দক্ষিণ— বেলা সাড়ে এগারোটার পর থেকেই শহর কলকাতা কার্যত জনশূন্য। খুব প্রয়োজন না পড়লে পথ-মুখী হচ্ছেন না প্রায় কেউই। ভাবখানা এমন, যেন নামী ফুটবলারের মতোই গোলপোস্টের কাছে গিয়ে চকিতে টার্ন করেছে বর্ষা। সামনে থাকা ডিফেন্ডারের মতোই ধোঁকা খেয়েছে আবহওয়া দফতর। প্রবল বিরক্তিতে ফেটে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই শহরবাসীর। শ্যামবাজার পাঁচ মাথা মোড়ে অফিসের বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি ঘামতে ঘামতে বললেন, ‘‘গরমে প্রাণটা বাঁচলে হয়!’’
চিকিৎসকেরাও মানছেন, এই প্রবল গরমে সুস্থ থাকাটাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁরা বলছেন, তাপপ্রবাহের সঙ্গে এই অসম লড়াইয়ে হাতিয়ার হতে পারে প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া। সঙ্গে সুতির পোশাক। নিউরোলজিস্ট দীপেশ মণ্ডল আবার বলছেন, ‘‘জল তো প্রয়োজন বটেই, দীর্ঘক্ষণ পেট খালি রাখাও চলবে না।’’ তাঁর বক্তব্য, খালি পেট থাকলেই শরীরে জলের অভাব হবে। আর তা থেকেই প্রবল গরমে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন যে কেউ। দীপেশবাবু জানান, এমনিতে শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন। প্রবল গরমে সেই তাপমাত্রা অনেকটাই বেড়ে যায়। তার ফলে মেটাবলিজম অনেক বেড়ে যায়। হৃদযন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করতে পারে না। পেশি ভেঙে গিয়ে কিডনিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, হঠাৎ করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢোকা বা বেরোনো এড়িয়ে চলতে হবে এই সময়ে। তাঁর কথায়, ‘‘শরীর ৪-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রার পার্থক্য মানিয়ে নিতে পারে। তাই হঠাৎ করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে বাইরের ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে এসে দাঁড়ালে শরীর খারাপ হতে বাধ্য।’’ সমস্যা কাটাতে বেশি করে জল খাওয়া এবং মশলা দেওয়া খাবার না খাওয়ার কথা বলছেন অরুণাংশুবাবু। জানাচ্ছেন, সবচেয়ে বেশি গরম থাকে সকাল ১০টা থেকে দুপুর দু’টোর মধ্যে। এই সময়ে রোদে বেরোনো এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। সেই সঙ্গে তাঁর পরামর্শ, ভাল থাকতে কাটা ফল এড়িয়ে চলুন।
চলতি মরসুমে বৃহস্পতিবারই তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মনে করা হচ্ছে, এমন তাপপ্রবাহ থাকবে আরও কয়েক দিন। প্রবল গরমে নাজেহাল শিশুরাও। শিশু চিকিৎসক প্রবাল নিয়োগী বলছেন, ‘‘শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কখনওই বড়দের মতো হয় না। তাই বারবার ভেজা কাপড়ে গা মোছানোর পাশাপাশি তাদের পোশাকের দিকেও নজর দিতে হবে।’’ ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল জানালেন, গরম থেকে বাঁচাতে শিশুদের পোশাকের উপরে নজর দেওয়া খুব প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই শিশুদের হাফ হাতা পোশাক পরান। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত জায়গায় বা প্রবল গরমের কখনওই এই পোশাক ঠিক নয়। দু’ক্ষেত্রেই সরাসরি প্রভাব পড়ে। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের হাওয়া বা সূর্যের তাপ সরাসরি শিশুর গায়ে লাগলে শরীর খারাপের এটা মূল কারণ হতে পারে। ফলে লম্বা হাতার জামা জরুরি।’’ বড়দের জন্য অগ্নিমিত্রার পরামর্শ, ‘‘হালকা সুতির পোশাক পরুন। আঁটোসাঁটো পোশাক কখনওই নয়। স্টাইল ধরে রাখতে স্কার্ফের ব্যবহার চলতে পারে।’’
আর বয়স্কদের জন্য উপায়? তাঁদেরও গরম থেকে বাঁচার নিয়মাবলী প্রায় একই। সেই সঙ্গে জেরন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী যোগ করলেন, চিকিৎসার পাশাপাশি বয়স্কদের মন ভাল রাখা প্রয়োজন। তা হলেই গরমকে সহজে বুড়ো আঙুল দেখানো যাবে। তাঁর কথায়, ‘‘দেখতে হবে বয়স্কদের যেন একা না লাগে, তাঁরা যেন সঙ্গ পান। আনন্দে থাকলে গরমের সঙ্গে এমনিই লড়ে নেওয়া যাবে।’’