জল পানে সাবধান
গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়াচ্ছে আন্ত্রিক, ডায়েরিয়া। কী ভাবে এই রোগ থেকে বাঁচবেন। জানাচ্ছেন চিকিৎসক বিশ্বদেব ঘোষ
প্রশ্ন: কলকাতায় আন্ত্রিকের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। দুর্গাপুরে কি তেমন কোনও আশঙ্কা রয়েছে?
উত্তর: বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কলকাতা পুর-এলাকায় পানীয় জল থেকেই আন্ত্রিকের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। পানীয় জলের সঙ্গে নিকাশির জল মিশলে এমন হতে পারে। এমন পরিস্থিতি কয়েক বছর আগে দুর্গাপুরে ঘটেছিল। বেনাচিতির বিস্তীর্ণ এলাকায় সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। গাঁধী মোড়ের কাছে জলের পাইপ ফেটে গিয়ে এই বিপত্তি হয়েছিল। কাজেই এ শহরে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে।
প্রশ্ন: জলবাহিত রোগ কী ভাবে সংক্রমিত হয়?
উত্তর: জলবাহিত রোগ যে শুধু পানীয় জল থেকেই হয় তা নয়। অর্থাৎ শুধু দূষিত জল পান করলেই সংক্রমণের শিকার হতে হয় তেমন নয়। সংক্রমিত জল যে কোনও ভাবে শরীরে গেলেই রোগের আশঙ্কা থাকে। যেমন, দূষিত জলে স্নান করলে, মুখ-হাত ধুলে, এমনকী সাঁতার কাটার সময়েও কয়েক ফোঁটা মুখে ঢুকে গেলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন: কোন কোন ধরনের জলবাহিত রোগ হয়?
উত্তর: অণুজীব, ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, পরজীব থেকে নানা ধরনের অসুখ হতে পারে। যেমন, ই-কোলাই ব্যাকটিরিয়া। ই-কোলাই ব্যাকটিরিয়া মলের মধ্যে থাকে। কোনও কারণে মল জলের সঙ্গে মিশে গেলে সংক্রমণ হয়। আমাদের নানা জায়গায় নানা রকম জল পান করতে হয়। তখন ট্রাভেলার্স ডায়েরিয়া হতে পারে। টাইফয়েড, ক্লসটিডিয়াম, সিরেলা, সালমোনেলা এ সব থেকেও সংক্রমণ হয়। রোটা ভাইরাস, প্রটোজোয়া জিয়ারডিয়াসিস, অ্যামিবায়োসিস, সাইক্লোস্পোরাটিস থেকেও সংক্রমণও হতে পারে। আবার পরজীবী যেমন, গোলকৃমির জন্য অ্যাসকারিয়াসিস-সহ আরও নানা রোগের আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন: লক্ষণ কী?
উত্তর: পাতলা মল, বমি। সবথেকে মারাত্মক হল ডিহাইড্রেশন। অর্থাৎ শরীর থেকে জল বেরিয়ে যাওয়া। এর ফলে কিডনি কাজ বন্ধ করে দিতে পারে। তাই প্রথম থেকেই সাবধান হওয়া দরকার।
প্রশ্ন: ওআরএস কখন দিতে হবে?
উত্তর: প্রথমেই দেখতে হবে, প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে কি না। না হলে ওআরএস দিতে হবে। আগে বমি হলে খেতে দেওয়া হত না। ফলে রোগীর ক্ষতি হত। কলেরা হলে রোগী মারা যেতেন। ওআরএস দেওয়ার পরে বমি হতে পারে। কিন্তু উদ্বিগ্ন হলে হবে না। মুখ ধুইয়ে ফের ওআরএস দিতে হবে। এর ফলে শরীরে সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, পটাশিয়াম ক্লোরাইড ঢুকবে।
প্রশ্ন: বাড়িতে ওআরএস কী ভাবে বানানো যাবে?
উত্তর: এক লিটার জলে চার চামচ চিনি, অর্ধেক চামচ নুন, চামচের এক চতুর্থাংশ খাবার সোডা ও লেবুর রস। লেবুর রস দিলে ভাল স্বাদ হয়। অনেকে সেটা পছন্দ করেন।
প্রশ্ন: পরিমাণ কতটা দিতে হবে?
উত্তর: দেহের ওজনের কিলোগ্রাম প্রতি ৫০-২০০ মিলিলিটার হারে ওআরএস দিতে হবে। অর্থাৎ ওজন ও প্রয়োজন অনুযায়ী দিনে প্রায় আড়াই লিটার থেকে ১০ লিটার পর্যন্ত ওআরএস দিতে হতে পারে।
প্রশ্ন: কখন বোঝা যাবে বিপদ বাড়ছে?
উত্তর: তিন বার পাতলা মল হলে বুঝতে হবে মাইল্ড ডায়েরিয়া। চার বার পর্যন্ত পাতলা মল সঙ্গে পেট ব্যথা হলে মাঝারি ডায়েরিয়া। চার বারের বেশি পাতলা মল সঙ্গে জ্বর, ঝিমুনি হলে বুঝতে হবে ‘সিভিয়ার ডায়েরিয়া’। তখন আর শুধু মুখ দিয়ে ওআরএস দিলেই হবে না। স্যালাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সঙ্গে মুখ দিয়েও ওআরএস দিতে হবে। স্যালাইন দামী। এতে বেশি স্যালাইন কেনার খরচ বাঁচবে।
প্রশ্ন: কত তাড়াতাড়ি ফল মিলবে?
উত্তর: শরীর যদি ‘সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন’ হয়ে যায় তখন দ্রুত অ্যাবজর্ভ করার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। যেমন কোনও জায়গায় দীর্ঘ দিন খরা হলে প্রথমে বৃষ্টি নজরেই আসে না। সব শুষে নেয়। এটাও তেমনই। এক কাপ খাওয়ানো হল। দেখা গেল দুই মিনিটের মধ্যে বমি হয়ে গেল। সবটা কিন্তু বেরোবে না। কিছুটা ততক্ষণে অ্যাবজর্ভ হয়ে গিয়েছে। ফলে শরীর জলশূন্য হওয়া থেকে বাঁচা যায়। কিডনি বেঁচে যায়। দরকার হলে বমির ওষুধ দিতে হবে। তাই এক মিনিট বা দু’মিনিট পরে বমি হলেও দুশ্চিন্তায় পড়লে চলবে না। লাগাতার ওআরএস দিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: বিশেষ কোনও ওষুধপত্র আছে কি?
উত্তর: ওষুধপত্র তেমন লাগার কথা নয়। খুব পেটব্যথা হলে বা বমি হলে ওষুধ দিতে হয়। তবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় লাগেই না। মলের সঙ্গে রক্ত পড়লে অবশ্য ‘স্টুল কালচার’ করে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। তা না হলে ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে আপনা থেকেই সেরে যায়। শুধু ফ্লুইড (সাদা জল) ও ইলেকট্রোলাইট (নুন-চিনি) চালিয়ে যেতে হবে। আসল ওষুধ ওআরএস। শরীর থেকে যে পরিমাণ জল বেরোচ্ছে তার থেকে বেশি করে জল শরীরে ঢোকাতে হবে। ঘন ঘন পাতলা মল হলে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। কারণ, জলের পরিমাণে সমতা রাখতে শরীর নিজেই সে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। সেই সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরে কিডনি ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
প্রশ্ন: ওআরএস-এ তো চিনি থাকে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের কী হবে?
উত্তর: ওআরএসে চিনি দিতেই হবে। শরীরকে নুন অ্যাবজর্ভ করাতে চিনি হল ‘ভেহিকল’। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস রোগীদেরও প্রতি দিন ১০০ গ্রাম গ্লুকোজ লাগে। এতে সুগার বাড়তে পারে। সে জন্য দরকার হলে ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু শীরের গ্লুকোজ চাই চাই।
প্রশ্ন: সেই সময়ে খাওয়া-দাওয়া কেমন করতে হবে?
উত্তর: অতিরিক্ত খাওয়া বন্ধ করতে হবে। সহজ পাচ্য খাবার খেতে হবে। বাচ্চাদের পটাশিয়াম দ্রুত কমে যায়। তাই লেবুর রস, কলা, সুপ জাতীয় খাবার, পেঁপে এ সব দিতে হবে। ফাইবার জাতীয় খাবার এই সময় না খাওয়াই ভালো। পরের দিকে আলুসিদ্ধ, পেঁপে, ভাত এ সব খেতে হবে। কোনও অবস্থায়ই খাওয়া বন্ধ করলে চলবে না।
প্রশ্ন: শীত প্রায় শেষ। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কি এই ধরনের রোগের কোনও সম্পর্ক আছে?
উত্তর: সরাসরি জলের সঙ্গে রোগের সম্পর্ক নেই। এই সময়ে সর্দি বেশি হয়। তবে বাইরের রাস্তার কাটা ফল, সরবত, স্যালাড এ সব থেকে দূরে থাকতে হবে। দু’রকম ভাবে সাবধান হওয়া যায়। ‘কমিউনিটি লেভেল’-এ পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে। আর নিজেদেরও সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে ক্যানসার রোগী, বয়স্ক এবং শিশুদের ‘ইমিউনিটি’ কম থাকে। ফলে সহজেই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শীতে তৃষ্ণা কম থাকে। গরমে জলের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই তখন অনেকেই যেখানে সেখানে জল পান করেন। এটা উচিত নয়।
প্রশ্ন: রোজকার জীবনে সাধারণ কী সাবধানতা নেওয়া যেতে পারে?
উত্তর: খাবার আগে এবং পরে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। শৌচাগারে গেলে সাবান বা জীবানুনাশক দিয়ে হাত ধুতে হবে। রান্নার জায়গা পরিষ্কার রাখা, জলের ট্যাঙ্ক নিয়মিত পরিষ্কার করা, বাসনপত্র ঠিক ভাবে ধোওয়া, মাছি যাতে খাবার না বসে তা দেখা, বাচ্চাদের মুখে হাত দেওয়া থেকে দূরে রাখা— এ সবে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া জল পরিশুদ্ধ করে পান করতে হবে। তবে পরিশুদ্ধ জল পানের পাশাপাশি হাত-মুখ ধুতেও পরিস্রুত জল ব্যবহার করা উচিত। বলা হয়ে থাকে তামার পাত্রে জল রাখা হলে স্টেরিলাইজড হয়। তামা ট্রেস এলিমেন্ট।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা?
উত্তর: স্কুলে বা সামার ক্যাম্পে বাচ্চাদের জন্য পরিশুদ্ধ জল নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বাইরের কাটা ফল, সরবত থেকে দূরে রাখতে হবে। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম। তাই জলের পাত্রে হাত যাতে না ডোবানো হয় তাও দেখতে হবে।
প্রশ্ন: গ্রীষ্মে অনুষ্ঠানবাড়িতে গেলে কেমন খাওয়া-দাওয়া করা দরকার?
উত্তর: যে কোনও গরম খাবারে ভয় কম। তবে অনুষ্ঠানবাড়িতে স্যালাড থেকে বিপদের আশঙ্কা থাকে। কারণ, দেখা গিয়েছে, স্যালাড খুব একটা স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে কাটা হয় না। তাই স্যালাড খেতে গেলে বোতলের জল দিয়ে ধুয়ে খেতে পারলে ভালো। কিন্তু তা আবার দৃষ্টিকটূ! তাই স্যালাড এড়িয়ে চলাই ভাল।