আনলক ফেজ় ওয়ান শুরু। এ বার কাজে ফেরার পালা। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার পরে এ মুক্তির আস্বাদ ঠিকই। কিন্তু বাইরে বেরোতে পারার আনন্দে সতর্ক ও সাবধান হওয়ার কথা ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাসের আক্রমণ এখনও জারি রয়েছে। তাই করোনা মোকাবিলা করার অস্ত্র নিয়েই বেরোতে হবে রাস্তায়।
বর্ম হোক মুখোশ
মাস্ক পরে তবেই রাস্তায় বেরোন, কর্মক্ষেত্রে যান। অনেকেরই অভ্যেস থাকে বারেবারে মুখে হাত দেওয়া, মোবাইলের মাউথপিস ঠোঁটের কাছে ধরে কথা বলা। মাস্ক পরা থাকলে সচেতন না থাকলেও এ সব থেকে বিরত হবেন। নোংরা হাত মুখে না গেলে অনেকটাই নিরাপদ থাকা যাবে। অন্য দিকে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলেও তাঁর হাঁচি, কাশি থেকে সংক্রমণের ভয় থাকবে না। তাই মাস্ক মাস্ট। তবে মাস্কের ব্যবহারবিধিও জানতে হবে। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘সুতির কাপড়ের মাস্ক পরলে মোটা কাপড়ের পরুন। তাতে যেন অ্যাবজ়র্বিং সারফেস থাকে, যাতে হাঁচি, কাশি হলে ড্রপলেট অ্যাবজ়র্ব করতে পারে। এন নাইনটি ফাইভ মাস্ক হেলথওয়র্কাররা পরতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে চার সেট মাস্ক কিনতে হবে। একটা মাস্ক রিপিট হবে তিন-চার দিন পরে। কারণ করোনা ভাইরাস সর্বাপেক্ষা তিন দিন মাস্কের সারফেসে থাকতে পারে। তা ছাড়া অনেকেই মাস্ক পরে, তা হাত দিয়ে অনবরত খোলা-পরা করেন। তা কিন্তু করা যাবে না। মাস্ক পরার পরে তাতে আর হাত দেওয়া যাবে না। আর মাস্ক ডিসপোজ় করতে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এসএমএস (সোপ, মাস্ক, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং) হ্যাবিট তৈরি করতে হবে।’’ ওয়াশেবল হলে ধুয়েও ব্যবহার করতে পারবেন মাস্ক। প্রত্যেক বার ব্যবহারের পরে সাবান জলে কেচে গরম জলে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে নিন। গন্তব্যে পৌঁছে মাস্ক খুলে রাখতে চাইলে ছোট ব্যাগ সঙ্গে রাখুন। মাস্ক খুলে টেবিলের উপরে ফেলে না রেখে ব্যাগে ভরে রাখুন। ফেরার সময়ে আবার পরে নিন। মাস্ক খোলা ও পরার আগে অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
হাতে থাকুক গ্লাভস
অনেকেরই কথায় কথায় চুলে হাত দেওয়ার প্রবণতা থাকে। অনেকে আবার চোখ কচলান। এই ধরনের অভ্যেস ছাড়তেই হবে। গ্লাভস পরে থাকলে চট করে চোখে বা মুখে হাত যাবে না। গ্লাভস থাকায় তা মনে করিয়ে দেয় সচেতন থাকার কথা। তবে গ্লাভস পরে বাইরের সব কাজ করে বাড়ি এসে ডিসপোজ় করতে হবে। ওয়াশেবল হলে সাবানজলে ধুয়ে নিয়ে আবার ব্যবহার করুন।
দূরত্বও দরকার
রাস্তাঘাটে, বাজারে, কর্মক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই চলুন। সব সময়ে স্কেল মেপে দূরত্ব বজায় রাখা তো সম্ভব নয়। তাই চোখের আন্দাজে আপনি ও আপনার সামনের ব্যক্তিটি সোজাসুজি হাত বাড়ালেও যাতে তার মাঝে এক আঙুল ব্যবধান থাকে, ততটা দূরত্ব বজায় রাখুন। অফিসে বসার ব্যবস্থা পাশাপাশি হলে চেয়ারের মাঝের ব্যবধান বাড়িয়ে নিন।
ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে
বেশির ভাগ জিনিস না ধরাই ভাল। হাত দিয়ে কোনও দরজা না খুলে, পা দিয়ে ঠেলে খুলতে পারেন। একান্তই স্পর্শ করতে হলে আঙুলের মাথা দিয়ে করুন। পরে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। কনুই বা হাতের উল্টো দিক দিয়ে রাস্তার জিনিস ধরবেন না। এত দিন ধরে হাত ধোয়ার অভ্যেস তৈরি হয়েই গিয়েছে। কিন্তু কনুই যদি ধুতে ভুলে যান, তা হলে কিন্তু ভয়। পাবলিক টয়লেটে সাবধান। বেিসনের কল সাবান দিয়ে ধুয়ে ব্যবহার করুন।
কেয়ার করুন, শেয়ার নয়
কর্মক্ষেত্রে অনেকেই সহকর্মীর সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খান। আপাতত তা বন্ধ করুন। জন্মদিন উপলক্ষে একই কেক কেটে সেই টুকরো সকলে খাওয়ার অভ্যেসও বদলাতে হবে। আর যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের সকলের আগে শেয়ার করে স্মোক করা বন্ধ করতে হবে। ধূমপান এড়িয়ে চলাই ভাল। এতে ফুসফুস ভাল থাকে, সংক্রমণের ভয়ও কম। অন্য কারও বোতল থেকে জল খাওয়াও চলবে না। মেয়েদের মেকআপ প্রডাক্ট সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। সহকর্মীদের সঙ্গে লিপস্টিক শেয়ার করা যাবে না।
স্যানিটাইজ়ার-সাবানের সখ্য
কর্মক্ষেত্রে বা গন্তব্যে পৌঁছনোর পরে সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। ব্যাগে রাখতে হবে ৬০-৭০ শতাংশ অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার। যদি গন্তব্যে বা কর্মক্ষেত্রে হাত ধোয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা না থাকে, সে ক্ষেত্রে হাত স্যানিটাইজ় করে নিন নিজের স্যানিটাইজ়ার দিয়ে। স্যানিটাইজ়ার কাজ করার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা (অন্তত ১ মিনিট) করুন। মনে রাখবেন স্যানিটাইজ়ার কিন্তু সাবানের বিকল্প নয়। তাই খাবার খাওয়ার আগে সাবান দিয়েই হাত ধুতে হবে।
সতর্ক থাকাই শ্রেয়
প্রত্যেকের কাজের জায়গা আলাদা, কাজের ধরন আলাদা। শিক্ষককে যেমন চক, ডাস্টার ধরতেই হবে, অফিসে কর্মরতদের ল্যাপটপ। তাই কর্মক্ষেত্রের সব জিনিস স্যানিটাইজ় করা হচ্ছে কি না সে দিকেও নজর রাখুন। কিছু জিনিস ব্যক্তিগত ভাবে নিজেও ক্যারি করুন। কারও হাঁচি, কাশির মতো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসক দেখানোর পরামর্শ দিন। তাঁর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন।
নজর রাখুন নিজের উপরেও
করোনা সংক্রমণ রুখতে নিজেকেও দায়িত্ব নিতে হবে বইকি! পাশের মানুষটির করোনা হয়েছে কি না যেমন খেয়াল রাখবেন, তেমনই নিজের শরীরের দিকেও চোখ রাখুন। যদি জ্বর, কাশি ইত্যাদি উপসর্গ আপনার বা আপনার পরিবারের কারও দেখা দেয়, আপনাকেই কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে হোম কোয়রান্টিনে চলে যেতে হবে।
বাড়ি ফেরার পরে
রাস্তায় বেরোনোর সময়ে সতর্ক হলেই শুধু চলবে না। বাড়ি ফিরেও কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি।
• বাইরে বেরোনোর ব্যাগও নিয়মিত পরিষ্কার রাখা জরুরি। কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করলে কেচে নিতে পারবেন। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেরোন। এতে বাড়ি ফিরে স্যানিটাইজ় করতে সুবিধে হবে। লেদার ব্যাগ হলে বাড়িতে ফিরে কাঁধের ব্যাগটা এমন জায়গায় রাখুন, যেখানে কারও হাত পড়বে না।
• জুতো মোজা খুলে তার পর সোজা ঢুকে যেতে হবে বাথরুমে। ডা. মণ্ডলের কথায়, ‘‘বাইরে থেকে ফিরে সেই হাত বাড়ির দরজায়, সুইচে কোথাও দেবেন না। বাড়ির লোককেই বাড়ির ও বাথরুমের দরজা খুলে দিতে বলুন। হাতে হ্যান্ডওয়াশ ঢেলে কল খুলে দিতে বলুন। হাত ধুয়ে মাস্ক ও চশমা খুলে নিন।’’ মাস্ক কেচে পরিষ্কার করে নিন। চশমাও সাবান দিয়ে ধুয়ে রাখতে হবে। এ বার পোশাক খুলে বালতিতে সাবানজলে ভিজিয়ে দিন। জামাকাপড় কেচে গরম জলে ধুয়ে নিন। রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
• সাবান মেখে, শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করতে হবে। বড় চুল হলে স্কার্ফ বেঁধে বেরোতে পারেন। পায়ের তলাও সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন।
• সবশেষে মোবাইলটাও ভাল করে স্যানিটাইজ় করে নিতে হবে।
কথায় আছে, সাবধানের মার নেই। করোনাকে কুপোকাত করতে আপাতত সাবধানতাই হাতিয়ার। শান দেওয়া যাক সেই অস্ত্রে।
সচেতনতাই হাতিয়ার
• ভিড় যানবাহন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। তার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে বেরোতে হব। একই রুটে হলে অফিসের কয়েক জন একটা গাড়ির ব্যবস্থাও করতে পারেন। তবে পিছনের সিটে দু’জনের বেশি বসবেন না
• অফিসের ল্যান্ডফোন ব্যবহার কম করাই ভাল। রিসিভার বেশি মুখের কাছে নিয়ে কথা বলবেন না। কাজটা ফোনেই হলে মাউথপিস স্যানিটাইজ় করে ব্যবহার করুন
• রাস্তাঘাটে বাসে-ট্রামে অনেক জায়গায় হাত পড়ে। তাই মোবাইল ব্যাগে রাখুন। গন্তব্যে পৌঁছে হাত ধুয়ে মোবাইল বার করে চেক করে নিন
• এটিএম থেকে টাকা তোলার পরে, সেই টাকা ও কার্ড মানিব্যাগের একটি আলাদা পকেটে রাখুন
মডেল: হিয়া মুখোপাধ্যায়; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল; মেকআপ: উজ্জ্বল দত্ত