নলেন গুড়ের রসগোল্লা।
বঙ্গজীবনে প্রতি বছর নলেনের প্রবেশ কোনও সুপারস্টারের চেয়ে কম নয়। কনকনে শীতের কুয়াশাঘেরা সকালে যখন ঢেকে যাবে আদিগন্ত মাঠ-ঘাট, রাস্তা-প্রান্তর, নগর-উপনগর, যখন হিমঋতু ছুরির ফলার মতো নাকের ডগায় আঁচড় বসাবে, সোয়েটার-টুপি-মোজার আড়ালে কচিকাঁচারা শীতের ভোরে জড়সড় এসে দাঁড়াবে বারান্দায়, ঠিক তখনই কুয়াশার বুক চিরে মাটির কলসিতে প্রবেশ ঘটবে তার। ধীরে সরে যাবে কলসির ঢাকনা। বেরিয়ে আসবে তরল সোনা। হিমেল হেঁশেলে তপ্ত চাটুর বুকে পড়বে এক হাতা চালের গোলা আর তা থেকে ধোঁয়া উঠতেই নলেনের প্রলেপ ভাগ জমাবে স্বাদু ওমে। সামান্য এই চালের পিটুলি ও নলেন গুড়ের জাদুজুটি বশ করে রেখেছে গোটা একটা জাতিকে। দুধে-চালে ফুটিয়ে হোক বা শেষপাতে রুটির উপরে শীতের ক’দিন রসনারাজ্যে নলেন যেন রাজমুকুটের মধ্যমণি। কিন্তু এই ‘মুকুট’মণি ধরে রাখা কি অতই সহজ?
কালীপুজোর পর শিউলিগন্ধী ভোরে কনকনে ঠান্ডায় চাদরমুড়ি দিয়ে রস সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়েন শিউলিরা। রোগাভোগা শরীরে খেজুরগাছের অমসৃণ গা বেয়ে উঠে পড়েন একেবারে মাথায়। সেখানে হাজার কারিকুরি করে বেঁধে দিয়ে আসেন কলসি। তার মধ্যেই একটু একটু করে জমা হয় খেজুরের রস। আর এই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ ও জ্বাল দিয়েই তৈরি হয় খেজুর গুড়, ঝোলা গুড়, পাটালি। এ বঙ্গে অবশ্য নলেন গুড়ের সন্ধান মিলেছে বহু আগে। তার নিদর্শন রয়ে গিয়েছে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থে। গ্রন্থটি বঙ্গাধিপতি লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম সামন্ত অধিপতি বটুদাসের ছেলে শ্রীধর দাস কর্তৃক সঙ্কলিত। এই গ্রন্থেই ‘হেমন্তের নূতন গুড়ের গন্ধে আমোদিত বাংলার গ্রামের বন্দনা’র উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব’-এ তার উল্লেখ করেছেন নীহাররঞ্জন রায়। তবে ভাল নলেন গুড়ের জন্য সঙ্গত চাই জুতসই আবহাওয়ার। ভাল ঠান্ডা না পড়লে গুড়ের মানও ভাল হবে না।
‘কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে
দেয় না...’
এ গানের ছত্রে-ছত্রে যেন নলেনের যাপন। ঠান্ডা না পড়লে রস ভাল হবে না। আবার পশমি রোদের সঙ্গতও চাই। মেঘলা হলেও রস টক ভাব চলে আসে। তাই আকাশে মেঘ জমলেও মুশকিল, ভাল গুড় মিলবে না। আগে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকেই বাজার ভরে যেত গুড়ে। ইতুলক্ষ্মীর ঘট বিসর্জনের আগে নতুন গুড়, চাল গুঁড়ি দিয়ে পিঠে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে। নতুন গুড়ের গন্ধে ম-ম করত চারদিক। এখনও অবশ্য সে রেওয়াজ দেখা যায় গুটিকতক ঘরে। তা ছাড়া কাঁচা দুধ, নতুন ফসল আর গুড় মিশিয়ে তৈরি হয় নবান্ন। পৌষ সংক্রান্তির দিন তো সুবাস বেড়ে দুই গুণ। গ্রামবাংলার কাঁচা রাস্তা ভেসে যায় দুধে নতুন গুড় আর চাল জ্বাল দেওয়ার স্বাদু গন্ধে।
তবে রসের মানের উপরে নির্ভর করে গুড়ের নাম ও মান। হিমেল হাওয়া না লাগলে গাছের রস ভাল হয় না। তাই গাছকে ঠান্ডায় একটু আয়েশ করতে দিতে হয়। এর পর গাছ তোলার পালা। গাছের মাথার দিকের পাতাসম্বলিত বাকলগুলো ধারালো দা দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ পরে আবার গাছ চেঁছে দেওয়া হয়। ওই চাঁছা অংশ কিছুটা কেটে বাঁশের নল ও খিল লাগিয়ে সামনে হাঁড়ি বাঁধা হয়। ওই নল দিয়েই রস এসে জমবে হাঁড়িতে। গুড় সংগ্রাহকদের কাছ থেকে জানা গেল, প্রথম রাতে যে রস পাওয়া যায়, তার মান সবচেয়ে ভাল, একেই বলে নলিয়ান বা নলেন। ব্রজবুলিতে ‘নওল’ বা নতুন থেকে নলেন শব্দটি এসেছে। রঙের জন্য একে আবার লালি গুড়ও বলেন অনেকে। তবে এক মিষ্টিবিপণির কর্ণধারের কাছে জানা গেল, নলেনের আগেও নাকি শ্রেষ্ঠতম পয়ার গুড় মেলে। তবে তা মানে শ্রেষ্ঠ হলেও পরিমাণে কম উৎপন্ন হয়। নলেনের পরের কাট থেকে আসে ‘পরনলিয়ান’। এর পরেও একবার রস পাওয়া যায়, তাকে বলে ঝরা রস। এই রস অবশ্য় জোলো। এর পরের তিন দিন গাছকে জিরান বা বিশ্রাম দিতে হয়। তাই তিন দিন পরে সংগৃহীত রসকে বলা হয় জিরান কাট। এ বার সংগৃহীত রস ছেঁকে বড় পাত্রে রাখা হয়। তার পরে বাইনে জ্বাল দেওয়া শুরু হয়। রসের অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে শুদ্ধিকরণ করে তৈরি হয় তরল সোনা। তা জমিয়ে আবার পাটালি।
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
তবে গুড় জ্বাল দেওয়ার কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। বেশি জ্বালে অনেক সময়ে গুড় কালচে ও তিতকুটে হয়ে যায়। তাই রস থেকে গুড় তৈরির জন্য চাই অভিজ্ঞ পাকা হাত। মনে পড়ে যায় নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পের প্রেক্ষাপট। এই গুড় তৈরির অভিজ্ঞতার জন্যই বিচ্ছেদের পরেও হাঁড়ি কাঁধে খেজুর রস নিয়ে মোতালেফ দৌড় লাগায় প্রাক্তন স্ত্রী মাজু খাতুনের বাড়ির দরজায়। কারণ নতুন বৌ ফুলবানুর হাতে সেই জাদু নেই, সে গুড় তৈরি করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। সে পাক দিতে পারে না ঠিক করে। তাই প্রাক্তন মাজুই ভরসা, যার হাতের গুড়ে দূর পরগনা থেকেও খরিদ্দাররা আসে ঝাঁকে-ঝাঁকে। পরে এই গল্প অবলম্বনেই অমিতাভ বচ্চন, নূতন ও পদ্মা খন্নাকে নিয়ে তৈরি হয় ‘সওদাগর’। শহুরে মিষ্টির দোকানিরাও তাই প্রতি শীতে মোতালেফের মতো প্রত্যন্ত গ্রামের গুড়ব্যাপারিদের দরজায় কড়া নাড়েন। নদিয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মজিলপুর, জয়নগর, বহুড়ু, মথুরাপুরের গুড়ব্যবসায়ীরা খাস গুড়ের জোগান দেন শহুরে দোকানগুলোয়। আগে যশোর-খুলনার দিকেও খেজুর গুড় উৎপাদন হত প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। সেই গাছও নেই, সেই গুড়ও নেই। আর ভাল রস চেনা, তা থেকে গুড় তৈরির মতো অভিজ্ঞ মানুষও কমে আসছে ধীরে ধীরে। তার উপরে এই গুড় আবার ক্ষণিকের অতিথি। শীতের দু’মাস বলতে গেলে তার আয়ু। বছরভর অবশ্য এই বিভাগে প্রক্সি দিতে হাজির থাকে তালপাটালি, আখের গুড়। নিরামিষ রান্নায় স্বাদ আনতে এরাও কম যায় না।
কী করিলে বলো পাইব তোমারে...
এমন অমূল্যরতন গুড় হাতে আসাও অত সহজ নয়। ভেজাল আর নকলের বাজারে আসল নলেন চেনাও দুষ্কর। গুড়বিক্রেতাদের কাছ থেকে জানা গেল, আসল নলেন জানান দেবে তার সুগন্ধে। এর পাটালিও ইটের মতো শক্ত হবে না। হাতের চাপে ভেঙে-গলে যাবে। দোকানে গুড় কিনতে গেলে ঝোলা গুড়ের তরল অংশ চামচ দিয়ে হাতে ফেলে স্বাদ নিতে বলেন অনেকে। কিন্তু আসল গুড় চিনতে ওই তরল ভেদ করে অভিযান চালাতে হবে নীচের জমে যাওয়া গুড়ে। মনে রাখতে হবে তরলের নীচে ঘনসন্নিবিষ্ট অবস্থায় থাকবে সান্দ্র নলেন গুড়, যা তরলও নয়, কঠিনও নয়। একে অপরের সঙ্গে লেগে জমেও যাবে না। চামচ চালিয়ে তুলে আনলেও চামচ থেকে ঝুলে পড়বে। তার পর তো স্বাদ আছেই। এখন টিউবে, প্যাকেটে অনেক রকম গুড় মেলে বাজারে। কিন্তু সে স্বাদে নলেনকে ধরে রাখা অসাধ্য, দুঃসাধ্য। গ্রামবাংলায় শিউলিরাও এখন আসল নলেনের মতোই ভ্যানিশ। খেজুর গাছও হাতে গোনা। ফলে ক্রমশ এই গুড়সম্রাটের রাজত্বে ভাঁটা। তবে আশা একটাই, গ্রামবাংলার এই স্বল্পায়ু গুড় শিল্পে সরকারও উদ্যোগ নিচ্ছে। নলেনের রাজপাট বজায় রাখতে আরও খেজুর গাছও দরকার বইকি!
এত প্রেম আমি কোথা পাব...
এত গুড় কিনে কী হবে, যদি না তা রসনাতৃপ্তির দোসর হল। নলেনের পিঠে-পুলি, গুড়ের রসগোল্লা, সূর্যকুমার মোদকের জলভরা, বাবা পঞ্চাননের চূড়ামণি, ফেলু মোদকের মোহিনী, নলিন চন্দ্র দাস অ্যান্ড সনসের গুড় মনোহরা, গিরীশ চন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড় চন্দ্র নন্দীর গুড়ের মৌসুমী, জলভরা তো রইলই। নলেন গুড় দিয়ে বাড়িতে রেঁধে নিতে পারেন কিছু নতুন পদও:
মিঠে ভাত
উপকরণ: গোবিন্দভোগ চাল এক মুঠো, নলেন গুড় এক কাপ, অল্প তেঁতুল, সামান্য নুন, জল মাপমতো, নারকেল কোরা।
প্রণালী: জল ফুটিয়ে তার মধ্যে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে দিন। চাল সিদ্ধ হয়ে এলে সামান্য নুন আর অল্প তেঁতুল ক্বাথ দেবেন। এতে চাল ভাঙবে না। এ বার জল মরে আসার আগে নলেন গুড় মিশিয়ে দিয়ে আঁচ বন্ধ করে ঢাকা দিন। কলাপাতায় ঘি লাগিয়ে একটু গরম করে নিন। তার পর এই ভাত সাজিয়ে উপরে নারকেল কোরা ছড়িয়ে দিন। কলাপাতায় পরিবেশন করলেই এই মিঠে ভাতের স্বাদ খুলবে। আর ভাত ঝরঝরে হলে বুঝবেন রান্না ঠিক হয়েছে। চাইলে কিশমিশ দিতে পারেন।
নলেন গুড়ের মাংস
উপকরণ: বোনলেস চিকেন ৩ কাপ, পেঁয়াজ ১টা, লাল-হলুদ-সবুজ বেলপেপার কুচি ১ কাপ, নুন, গোলমরিচ স্বাদ মতো, নলেন গুড় ৪ টেবিল চামচ, পাতিলেবুর রস ২ টেবিল চামচ, সয় সস ১ টেবিল চামচ, সাদা তিল ১ চা চামচ, অরিগ্যানো ১ চা চামচ, চিলি ফ্লেকস ১ চা চামচ।
প্রণালী: প্রথমে চিকেন নুন, গোলমরিচ ও পাতিলেবুর রস দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখুন। এ বার প্যানে সাদা তেল দিয়ে পেঁয়াজ ও বেলপেপার নাড়াচাড়া করে তা অল্প নরম হয়ে এলে চিকেন দিয়ে দিন। ঢাকা দিয়ে কম আঁচে রান্না করুন। কিছুক্ষণ পরে পুরো রান্নাটা মজে এলে সয় সস, অরিগ্যানো, চিলি ফ্লেকস দিন। তার পর নলেন গুড় ছড়িয়ে মিনিট তিনেক নাড়াচাড়া করে সাদা তিল ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
আর অত রান্নাবান্নার পাঠে মন দিতে না চাইলেও কুছ পরোয়া নহি। সুকুমার রায় তো কবেই লিখে গিয়েছেন, ‘কিন্তু সবার চাইতে ভাল, পাউরুটি আর ঝোলা গুড়’। শীতসকালে গুটিসুটি বসে শালের নীচ থেকে হাতটা বার করে রুটি, পাউরুটি, তেকোনা পরোটা বা ফুলকো লুচি যা জোটে, নিয়ে নিন। নলেনে অবগাহন করিয়ে চালান দিতে হবে রসনারাজ্যে। এ বার চোখ বুজে মজে যান নলেনে। না হলে চোখের পলকে হারিয়ে যাবে এই ‘নলেন’ঋতু। এ সময় কথা বলতে নেই, কারও কথা শুনতে নেই, চোখ খুলে কিছু দেখতে নেই, পড়তেও নেই। অতঃপর উদরপুরের দিকে সুপারস্টারের প্রস্থান ও পর্দার শেষ দৃশ্যে সমাপ্ত। আপাতত পাঠকের সম্ভাব্য গন্তব্য বাজারের গুড়পট্টি বা হেঁশেলের গুড়ভাণ্ড।