DEPRESSION

খ্যাতি-বৈভব-গ্ল্যামারের মধ্যেও অবসাদের ছোবল! কেন মরেন সুশান্তরা...

কথা বলার জন্য ‘আছি’টুকুই যথেষ্ট নয় । কী বলব এবং কী বলব না তা খেয়াল রাখা ভীষণ দরকার।

Advertisement

অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২০ ১৫:৩৫
Share:

মনখারাপের মেঘেই ঝরে গেলেন সুশান্ত? ফাইল চিত্র।

মাত্র চৌত্রিশ বছরে কী এমন ঘটল?
এত যশ এত অর্থ তবু আত্মহত্যা করল কেন?
এমন প্রাণোচ্ছল হাসি, তবু অবসাদের শিকার হল কেন?
যে নিজের ছবিতে বেঁচে থাকার স্লোগান তুলেছে সে এ ভাবে হেরে গেল কেন?

Advertisement

সুশান্ত সিংহ কেন আত্মহত্যা করলেন সেই উত্তর ওঁর সঙ্গেই চলে গিয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্নপত্রটি আমাকে ভাবাচ্ছে। শুনছি আর মনে হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও অনেক সংলাপ বাকি। এই প্রতিটি প্রশ্নের অন্তরালে বেশ কিছু ভুল ধারণা ঢুকে আছে।

‘অবসাদ’, ‘মেন্টাল হেলথ’ এই শব্দগুলো একটু গভীরে গিয়ে বোঝা প্রয়োজন। আমরা অনেকেই জানান দিচ্ছি, ‘আছি। আমায় ফোন করে কথা বলতে পারেন’। খুবই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। কিন্তু কথা বলার জন্য ‘আছি’টুকুই যথেষ্ট নয় । কী বলব এবং কী বলব না তা খেয়াল রাখা ভীষণ দরকার।

Advertisement

অনেককে মনের জোর দিতে গিয়ে বলতে শুনেছি ‘তোমার মত মানুষের কি ভেঙে পড়া মানায়’? বক্তব্যটির উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু অভিঘাত কাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে।

ভেঙে সকলেই কখনও না কখনও পড়তে পারেন। হয়ত গতকাল পর্যন্ত ভাঙেননি, আজ পারেন। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তে হয়ত ভাঙেননি, কিন্তু আজ পারেন। জীবনের ঝাপটায় ভেঙে পড়লেই সে দুর্বল প্রমাণিত হয় না। আমরা বড় চট করে মানসিক দৌর্বল্যের লেবেল মেরে দিই। কারও ভেঙে পড়াকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে সেই বা তার গোপনতম ক্ষত আমাকে দেখাবে কেন বলুন তো? বরং প্রশ্নবাণ এড়াতে সে হয়ত হাসি সেঁটে দেখা করবে। আমরা জানতেও পারব না আপাদমস্তক হুল্লোড়ের কয়েক ধাপ নীচে, যন্ত্রণার এলাকা নিঝুম হয়ে আছে। টেরও পাব না, এত আড্ডার মধ্যেও কেউ নিজের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। তার পর এক দিন সে নিজেকে নিভিয়ে দিলে হতবাক হব।

যে নিরাপদ পরিবেশে মানুষ ভাঙলেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারবে, জানবে এই ভাঙন নিয়ে চর্চা হবে না, আমরা কি সেই পরিবেশ দিতে পারছি?

বহু সময় দেখেছি, কেউ মন খারাপের কথা বললেই লোকে তাকে বড্ড উঁচু থেকে জ্ঞান বিলোতে শুরু করে। বহু ক্ষেত্রে নিজেরা কত ঝড় অনায়াসে পার করেছে সেই অধ্যায় গর্বের সঙ্গে আওড়াতে থাকে। তাতে কথকের মুড ঊর্ধ্বগামী হলেও শ্রোতার মেজাজ উৎফুল্ল হয় না। যে অবসন্ন তার বরং মনে হতে পারে, আমি ছাড়া আর সবাই কত দক্ষ। একা আমিই বোধহয় অপারগ। কোনও নিদান না দিয়ে স্রেফ শোনার জন্য থাকাটাও স্বস্তিদায়ক হতে পারে।

বিষণ্ণ মানুষটি যাতে তাঁর ব্যক্তিগত আখ্যান নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করতে পারেন, সেই আবহাওয়া তৈরি না হলে তিনিই বা কথা বলতে স্বচ্ছন্দ হবেন কেন?

অবসাদ মানে দুঃখবিলাস নয়। যে কোনও দুঃখই আবার অবসাদ নয়। জগজিৎ সিংহ শুনতে শুনতে চোখে জল আসা মানে অবসাদ নয়। সেটা রোমন্থন।

অবসাদ তীব্র ধারাবাহিক মনোকষ্টের এক অতল খাদ। যেখানে মানুষ পড়তে থাকে এবং ক্রমশ চারপাশ অর্থহীন শূন্যতায় ভরে যায়। অবসাদের ডেরায় কেউ ইচ্ছে করে পাড়ি জমায় না। অবসাদ আসে। সে বয়েস, খ্যাতি, বিত্তের ধার ধারে না। ব্যস্ততা বা আলসেমির তোয়াক্কা করে না। অবসাদের কারণের মধ্যে একজনের দীর্ঘ ইতিহাস, মানসিক কাঠামো, নিউরোলোজি, হরমোন ইত্যাদির মিলিত ভূমিকা থাকতে পারে। যেমন কেউ মনের জোর দেখিয়ে পালস রেট বাড়িয়ে ফেলতে পারবেন না, ঠিক তেমনই দিনে তিন বার ‘বি পসিটিভ’ উচ্চারণ করলেই কারওর অবসাদ হাওয়া হয়ে যায় না। অবসাদ কারও অক্ষমতা নয়। ব্যর্থতা নয়। এটি একটি মানসিক সমস্যা যার চিকিৎসা এবং যত্নের প্রয়োজন। মুশকিল হল, আমাদের পরিপার্শ্ব বহু সময় অবসাদমুক্তির সহায়ক হয় না। এমনকি যাঁরা মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের প্রতি অনেকেই অবলীলায় কটাক্ষ করেন। মানসিক সমস্যা দেখানো যায় না বলে এখনও অনেকে মনে করেন পুরোটাই ‘ভান’।

আমরা অনেক সময় ভাবি অমুকের তো সব আছে, তবে কিসের দুঃখ! আমি যেটাকে প্রাপ্তি বলে ধরে নিচ্ছি, হয়ত সেই ব্যক্তির কাছে তার তেমন মূল্য নেই। বরং সে হয়ত অন্য কোনও অভাববোধে বিপন্ন। অবসাদ সেই অপ্রাপ্তিবোধগুলিকে বিরাট ফন্ট সাইজে লিখতে শুরু করে। যা নেই তা পাওয়ার সমস্ত আশায় জল ঢেলে দেয়। ফলে বহু সময় অবসন্ন মানুষটির কাছে জীবন অর্থহীন মনে হতে শুরু করে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্লান্তি জমতে থাকে। অসাড় লাগে। সারা ক্ষণ চোখের কোণ ভিজতে থাকে। কাজের গতি এবং ইচ্ছে কমে আসতে পারে, আবার নাও পারে। কিন্তু কাজ থেকে বা নেহাত অকাজ থেকে আর কোনও আনন্দ আসে না। অবসাদের ছোবলে অনেকেই নিজের প্রতি আস্থা হারাতে থাকেন। আর ঠিক এ অবস্থায়, ‘তুমি কেন হেরে যাচ্ছ’ বলে আমরা যদি সংলাপ শুরু করি, তাতে আরও বেশি হীনমন্যতা বাড়বার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বিষাদের সঙ্গে সহবাস সহজ নয়। হয়ত সেই জন্যে আমরা তাকে ঠেলেঠুলে চাঙ্গা করে ফেলতে চাই। অধৈর্য হয়ে উঠি। এক সময় চুপ হয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে বাতিলের খাতায় পাঠিয়ে দিই। তাঁদের কাজের পরিসর, সামাজিক গণ্ডি ছোট হয়ে আসতে থাকে। অন্যের গুণাবলীর কথা আমরা তাঁর স্মরণসভায় উচ্চকিত কণ্ঠে বলি, কিন্তু বেঁচে থাকাকালীন শুধুই খুঁত ধরতে ব্যস্ত থাকি। ফলে জীবদ্দশায়, অনেকের নিজের কাছেই অস্তিত্বের গুরুত্ব কমে আসতে থাকে। নিজের অসুবিধার কথা অন্যকে বলতেও কুণ্ঠিত লাগে।

অবসাদ আর অবসান একত্রে আসবেই এমন বলা যায় না। অনেক সময় মানুষ দীর্ঘ অবসাদের মধ্যে দিয়ে গেলেও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নাই নিতে পারেন। আবার অনেকে কোনও অবসাদের ইতিহাস ছাড়াই হঠাৎ আত্মহত্যা করতে পারেন। এক সামান্য মুহূর্তের অভিঘাত। চরম ধাক্কা। আর তাঁর ফলে মৃত্যু-তাগিদ হঠাৎ জীবনের প্রতি সব টান উপড়ে নিতে পারে। কখনও অন্যের উপর তৈরি হওয়া রাগ মানুষ নিজের উপর প্রয়োগ করে নিঃশেষ হতে পারে। আত্মহননের সিদ্ধান্তের পেছনে সাময়িক কোনও বিপর্যয়ের ভূমিকা থাকলেও ডিপ্রেশন ছিলই, এমনটা বলা যায় না। যেমন কেউ আত্মহত্যা করব বলছে মানে সে কখনও করবে না, এমনটা বলা যায় না। কারণ যাই হোক, আত্মহত্যা নিয়ে আমাদের স্টিগমার অন্ত নেই। এমনকি যে পরিবারে কেউ আত্মহত্যা করেছে, তাদের নিয়েও ফিসফিস অব্যাহত থাকে।

সুশান্ত সিংহ রাজপুতের স্বেচ্ছামৃত্যু অনেকের কাছেই অমীমাংসিত ধাঁধা। একে সেলিব্রিটি তার ওপর আত্মহত্যা! কিছু কিছু মৃত্যু সংবাদ আমাদের বিস্ময় আর কৌতূহলের পাল্লা খুলে দেয়। এও তেমনই। অনেকেই জানতে চাইছেন সেলিব্রিটি বলেই কি আরও বেশি করে অবসাদ-প্রবণ? সে আলোচনায় না হয় আসব। কিন্তু একজন সেলিব্রিটির মৃত্যু পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলোকে একটু দেখব না? মৃত্যুর কারণ ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে আমরা একটা সম্মানজনক বিদায় পর্যন্ত দিতে পারছি না । মৃতদেহের ছবি একে অপরকে পাঠাচ্ছি। যে সমাজে মৃত্যুর ডিগনিটি নেই সেখানে জীবনযুদ্ধের আঘাতগুলো মর্যাদা পাবেই বা কী করে?

সেলিব্রিটিদেরও মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হতেই পারে। যাঁদের ওপর সর্ব ক্ষণ জনসাধারণের মনোযোগ আছড়ে পড়ছে, তাঁদের মন ভাল না থাকলেও একটি বিশেষ ভাবমূর্তির মুখোশ চাপিয়ে রাখতে হয়। তাতে ভার জমে। নিজের জীবন দুর্বিষহ ঠেকলেও ক্যামেরার সামনে ভাল থাকার সংলাপ আওড়াতে হয়। অনেকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও কেউ কেউ তাঁদের দুর্বলতম মুহূর্তে ধরার মতো নির্ভরযোগ্য হাত পান না। এই বৈপরীত্য অসহ্য লাগে। তখন সাফল্য নিয়েও উদাসীনতা আসে। শূন্য লাগে। আবারও ভার জমে।

পাশাপাশি, পরিচিত মুখ হওয়ার দরুন অনেকে মানসিক চিকিৎসায় আসতেও সঙ্কোচ বোধ করেন। কেউ কেউ সেই নৈঃশব্দ্য ভেঙেছেন ঠিকই, কিন্তু এখনও অনেকেই গোপনীয়তা অটুট থাকবে কিনা তাই নিয়ে সন্দিগ্ধ হন। এ ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন, একজন প্রশিক্ষিত মনোবিদ বা মনোরোগ চিকিৎসক গোটা প্রক্রিয়াটির গোপনীয়তা রক্ষার্থে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু চিকিৎসার দরজা পর্যন্ত পৌঁছনোর রাস্তায় অনেক কৌতূহলী চোখ থাকে। জনপ্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে সেটি একটি অপ্রিয় পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।

সুশান্ত সিংহ টেলিস্কোপ কিনেছিলেন। কোন অভিমানে পৃথিবীর থেকে মুখ ফেরাতে চাইছিলেন জানি না।

মহাকাশের কাছে কি আশ্রয় চাইছিলেন? জানি না। কিন্তু এই স্বনির্বাচিত মৃত্যু জানান দিচ্ছে, মানুষ ভাল নেই। যে সব সুশান্তরা ক্রমশ জীবন থেকে পিছু হটছে, আমাদের টেলিস্কোপে তারা ধরা পড়বে তো?

(লেখক মনস্তত্ত্ববিদ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement