শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা যা চেয়েছিলেন সেটাই হল। চিকিৎসকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করল রাজ্য সরকার।
২০১২ সালে ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট (হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চিকিৎসকদের পেশার উপরে নিয়ন্ত্রণ) বিলের একটি খসড়া বিধি তৈরি করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু চিকিৎসকদের আপত্তিতে সেই খসড়া বিধি আজ পর্যন্ত বিধানসভায় পেশ করতেই পারেনি রাজ্য। ওই খসড়া বিধিতে চিকিৎসকদের চেম্বারগুলির উপরে স্বাস্থ্য দফতরের নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলা হয়েছিল। চেম্বারগুলির আয়তন কী হবে, সেখানে কেমন পরিকাঠামো (বসার জায়গা, শৌচাগার ইত্যাদি) থাকতে হবে, তার উল্লেখ ছিল ওই সংশোধনীতে। সেই সব না মানলে ওই চেম্বার বন্ধ করে দেওয়ার আইনি সংস্থানও ছিল বিধিতে। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, চিকিৎসকদের আপত্তিতে ২০১২ সালের সেই খসড়া বিধি আর পেশ করা হবে না বিধানসভায়। তার বদলে নতুন সংশোধিত বিধি
আনা হচ্ছে। যেখানে চিকিৎসকদের চেম্বারের উপরে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিধানসভার বাদল অধিবেশনে ওই সংশোধনী
পাশ করানো হবে বলে স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর।
খসড়া বিধিতে বলা হয়, প্রতি চেম্বারে পর্যাপ্ত জায়গা থাকতে হবে। চিকিৎসক ও রোগীর বসার জায়গা, জলের ব্যবস্থা, শৌচাগার, মহিলাদের শারীরিক পরীক্ষার আলাদা জায়গা এবং মহিলা সহায়ক রাখতে হবে। চেম্বারে চিকিত্সা বর্জ্য সাফেরও ব্যবস্থা থাকতে হবে। ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গির মতো ‘নোটিফায়েবল ডিজিজ’-এর কত জন রোগী ওই চেম্বারে আসছে, তার হিসেব নিয়মিত স্বাস্থ্য দফতরকে দিতে হবে। চেম্বারে বাধ্যতামূলক ভাবে লাইসেন্স, ডাক্তারের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও ফি টাঙিয়ে রাখতে হবে।
রাজ্যে চিকিৎসকদের প্রায় সাড়ে ছ’হাজার চেম্বারের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ উঠে গেলে রোগীদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক কর্তার। এর ফলে ওই চেম্বারগুলি চালাতে আর স্বাস্থ্য দফতরের কাছ থেকে লাইসেন্সও নিতে হবে না। চিকিৎসকেরা যেখানে খুশি চেম্বার খুলে বসে পড়তে পারবেন। সংশোধিত বিধি চালু হলে ওই সব চেম্বারে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে স্বাস্থ্য দফতর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না বলে স্বাস্থ্য কর্তাদের অনেকেরই অভিযোগ।
কোন পরিস্থিতিতে ২০১২ সালের সংশোধিত বিধি কার্যকর করা গেল না ?
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, ওই খসড়া বিধিটি ওয়েবসাইটে দিয়ে সকলের মত চাওয়া হয়েছিল। চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মে়ডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ (আইএমএ) এ ব্যাপারে আপত্তি তোলে। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে ডান-বাম উভয়পন্থী চিকিৎসকেরাই চেম্বারের উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপত্তি তোলেন। তাই সেই বিধি বিধানসভায় পেশ করা যায়নি। ওই বিধি তৈরি হওয়ার পর থেকে চার বার স্বাস্থ্যসচিব বদল হয়েছে, তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত বিধি খসড়া হিসেবেই থেকে গিয়েছে।
বর্তমান স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে কী বলছেন? মলয়বাবু বলেন, ‘‘আগামী বাদল অধিবেশনে এই বিধি আমরা পেশ করব। কাজ প্রায় শেষের মুখে। যে সব চেম্বারে গর্ভপাতের মতো ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করা হয়, সেগুলি ছাড়া চিকিৎসকদের আর কোনও চেম্বার এই বিধির আওতায় পড়বে না।’’ সরকারের নতুন বিধি কার্যকর হলে রোগীদের স্বার্থ কি বিঘ্নিত হবে না? স্বাস্থ্যসচিব বলেন, ‘‘রোগীরা যাতে অসুবিধায় না পড়েন, সে দিকে নজর রেখেই বিধি প্রণয়ন করা হবে। স্বাস্থ্য দফতর এ ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।’’
কিন্তু আইএমএ কোন কোন যুক্তিতে ডাক্তারদের চেম্বারকে ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইনের বাইরে রাখতে চাইছে? সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেনের কথায়, একটি পলিক্লিনিকে যা পরিকাঠামো থাকতে পারে, এক-চিকিৎসক পরিচালিত চেম্বারে তা রাখতে গেলে সেই চিকিৎসকের প্রচুর খরচ হবে। এর জন্য তাঁকে ফি অনেক বাড়াতে হবে যা অনেক রোগী দিতে পারবেন না।
যদি চেম্বারে কোনও চিকিৎসক ভুল ওষুধ বা ইঞ্জেকশন দেন বা বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সরকারকে তথ্য না দেন, তা হলে তাঁদের শাস্তি হবে না ?
শান্তনুবাবুর জবাব, ‘‘তার জন্য আইন দরকার নেই। বরং চিকিৎসকদের সচেতনতা শিবির করতে হবে। তা হলেই কাজ হবে।’’
স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনেকেই স্বাস্থ্য দফতরের ওই সিদ্ধান্তে হতাশ। এক জনের মন্তব্য, ‘‘চিকিৎসক হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করানোর জন্য ডাক্তারি ছাত্রেরা রোগীর সেবা করার অঙ্গীকার করেন। চিকিৎসক হয়ে তাঁদের অনেকেই রোগীর স্বার্থটাই বেমালুম ভুলে যান, এটাই দুঃখের।’’