ডিজিটাল মাধ্যমে হোক বা সামনাসামনি— দৈহিক আকার, আয়তন, কিংবা গড়ন নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান
Body shaming

বডি শেমিং ব্যর্থ করুন

ডিজিটাল মাধ্যমে হোক বা সামনাসামনি— দৈহিক আকার, আয়তন, কিংবা গড়ন নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার 

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২১ ০৬:১৩
Share:

বহু দিন যাবৎ বডি শেমিং মানসিক ও সাংস্কৃতিক মহামারি। তার ত্রাস ঘরে ঘরে, দেশ থেকে বিদেশে। প্যারিসের ফ্যাশন মঞ্চ থেকে পলাশডাঙার অন্দরমহল, সেলেব্রিটিকুল থেকে সাধারণ মানুষ... কাউকেই সে ছাড়ে না। অন্যের দৈহিক আকার, বর্ণ, সাজসজ্জা, অঙ্গের তথাকথিত ত্রুটি-বিচ্যুতি, হ্রাস-বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে তাঁকে দু’চার কথা শুনিয়ে চুপিচুপি আত্মশ্লাঘা অনুভব করা, ঠাট্টার ছলে হুল ফোটানোর এই বদভ্যেস আদতে বিকৃতি। বিনোদনের রাস্তা ধরেই এই অসুখের এ হেন বাড়বাড়ন্ত। জনপ্রিয় গান শিখিয়েছে, ‘জিসকি বিবি মোটি’, তাঁর স্ত্রী নাকি বিছানার গদি! নারী লম্বা হলে সিঁড়ি, ফরসা হলে ইলেকট্রিক লাইট! এ ভাবেই দশকের পর দশক সিনেমা, বিজ্ঞাপনের ঝাঁ-চকচকে দুনিয়া নারী ও পুরুষের শারীরিক সৌন্দর্যের একটি কৃত্রিম মডেল তৈরি করেছে। তার অন্যতম কারণ ব্র্যান্ডেড পোশাক, ফরসা হওয়ার ক্রিম, শ্যাম্পু ইত্যাদি প্রসাধনীর ব্যবসায়িক সুবিধে করে দেওয়া। এই আদর্শ নারী বা পুরুষের সংজ্ঞামাফিক ত্বক, রং, চুলের ঘনত্ব বা কেতা প্রভৃতির সঙ্গে যাঁদের বাহ্যিক রূপটি মেলে না, লিঙ্গনির্বিশেষে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার চেষ্টা চলে। তাই কৃষ্ণকলির বিয়ে হওয়া মুশকিল, রোগা ছেলেকে তালপাতার সেপাই বলে বিদ্রুপ। তরুণীর শরীর সময়মতো প্রস্ফুটিত হয়ে না উঠলে তাকে নিয়ে মুখ টিপে ইঙ্গিত করেন অন্য মেয়েরাই! গড়ন ও বরণ নিয়ে মুখোমুখি মন্তব্যবাণ ছোড়া তো প্রচলিত দস্তুর। প্রতিবাদ করলে হয়তো জবাব আসে, ‘মজা করছিলাম’!

Advertisement

বডি শেমিং মজা নয়। নির্মল রসিকতা ও ব্যঙ্গ-শ্লেষে অকারণে আঘাত করার মধ্যে গণ্ডি টানতে জানাটাই সভ্যতা এবং সুস্থতা। যিনি টিপ্পনী কাটছেন, বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর মনে বিকার রয়েছে। এমন আচরণের উৎস হীনম্মন্যতা, অপ্রাপ্তির হতাশা, ঈর্ষা, অহংতৃপ্তি বা আজন্মলালিত সংস্কার। অন্য দিকে যাঁকে আক্রমণ করা হচ্ছে, তাঁর মনে ও ব্যক্তিত্বে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষটি অবসাদে কুঁকড়ে যাচ্ছেন, তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আনন্দ আর আলো। সামাজিক মাধ্যমের যুগে বডি শেমিং সহজতর। কখনও ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসা সম্ভব ছিল না এমন মানুষকে, অপরিচিতকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপদস্থ করাই যায়। সদ্য মা হওয়া তরুণীর স্বাভাবিক মেদবৃদ্ধি, নায়কের স্ত্রীর চেহারা-পোশাক সব কিছুকেই গালমন্দ করা যায়। সুপারহিরোর পেটানো চেহারার সামান্য শৈথিল্যেও কটুকথার বান ডাকে। বডি শেমিংয়ের গ্রাফও শিখর ছুঁয়েছে। এ বার এই প্রথাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার সময় এসেছে।

Advertisement

মনের জোরে মোকাবিলা

যে সিনেজগৎ এই বিষ আমাদের পান করিয়েছে, ওষধির সন্ধানও চলছে সেখানেই। স্থূলকায়দের কমিক চরিত্রে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা ভাঙছে। বহুবর্ণের, সব চেহারার মানুষদের গল্প বলার চেষ্টা চলছে। পৃথুলা স্ত্রীকে ভালবাসার, চুল ঝরে যাওয়ার লজ্জা কাটিয়ে ওঠার ঘটনা নিয়ে ছবি মন কাড়ছে। সামাজিক মাধ্যমে বডি শেমিংয়ের তীব্র প্রতিবাদ করছেন সেলেবসন্তান, তারকারা। সমীরা রেড্ডি পাকা চুল, মেকআপবিহীন ছবি দিয়ে মা হওয়ার সুখের প্রকাশ্য উদ্‌যাপন করেছেন। বিকৃতরুচির নেটিজ়েনকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘তোমার জন্মের সময় মা কি ‘হট’ ছিলেন?’ জ়িরো ফিগার নয়, সুস্বাস্থ্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছে ফ্যাশন দুনিয়া। প্লাস সাইজ়ের, নানা বয়সের মডেল নিয়ে শো-ও হয়েছে। যে বলিউড মাধুরী দীক্ষিতকে পর্যন্ত প্যাডেড অন্তর্বাস পরতে বাধ্য করেছিল, আজ সেখানে পীনপয়োধর শ্রোণিভার ইত্যকার কালিদাসবর্ণিত যৌন অলঙ্কার ছাড়াই রাজত্ব করছেন আলিয়া ভট্ট। তাঁর অভিনয় ক্ষমতা, চোখের ভাষা এতই তেজিয়ান যে, তার বাইরে অন্য কিছু খোঁজার সাধ্য কার! বিশেষ অঙ্গের সৌষ্ঠবের অভাবের জন্য ছোট থেকে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই অপমান সয়েছেন, তাই নিয়ে সরব অনন্যা পাণ্ডে। তাঁর স্বরে স্বর মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, নারীত্বের বিশালত্বকে ফিতে দিয়ে মাপব কেন? অতএব, হাওয়া কিন্তু বদলাচ্ছে। নিজের শরীরেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার ইতিবাচক ধারণাটা বলিউডের মূলস্রোতে প্রবল হচ্ছে। এই বিশ্বাসের সুবাতাস আমাদের জীবনকেও শুদ্ধ করুক দ্রুত।

ব্যক্তিগত পরিসরে বডি শেমিংয়ের অনভিপ্রেত পরিস্থিতিকে কী ভাবে প্রতিহত করবেন? মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ, ‘‘নম্র ভাবে বলা যায়, আমি রোগা না মোটা, আমাকে কেমন লাগছে ইত্যাদি নিয়ে এখন একদম আলোচনা করতে চাইছি না। আমার নিজেকে নিজের দিব্যি লাগে।’’ তাঁর মতে, নিজের কাছে নিজের যে প্রতিকৃতি তাতে ভাল থাকলেই হল। তা নিয়ে আমার সংশয় বা দ্বিধা থাকলেও, অন্য মানুষকে জানাব কেন? সেই মানুষ যদি আমাকে হীন বা হেয় করে উত্তর দেন, তাঁর কাছে নিজের বিপন্নতার কথা কখনওই তুলে ধরব না। সেটা আমি নিজের মতো করে যুঝে নেব। অন্য মানুষের সঙ্গে সেই আলোচনা-সমালোচনায় না-ই যেতে পারি।’’

অনুত্তমা আরও বলছেন, ‘‘আমার শরীরের কোনটাকে আমি সৌন্দর্যের নির্ধারক হিসেবে দেখব, সমাজ ঠিক করে দেবে কেন? এই মাপকাঠি হওয়া উচিত সুস্থতার। হাঁটতে চলতে অসুবিধে হলে, ব্যথা-বেদনা ভোগালে, হাঁপ ধরলে, যদি চিকিৎসক কিছুটা ওজন নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন, তবে বিষয়টা আলাদা। কারণ, এর সঙ্গে আমার স্বাস্থ্য জুড়ে আছে। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কিন্তু আগাগোড়াই আপেক্ষিক। ক’জনই বা অন্যকে দেখে বলেন, ‘এই তো তুমি একদম ঠিক আছো’। হয় বলেন ‘কত রোগা হয়ে গিয়েছ’, নয়তো বলেন ‘আগের চেয়ে মোটা হয়ে গিয়েছ’। তার মানে আমাদের শরীর নিয়ে মন্তব্য সব সময়েই মানুষ করছেন। সেটা যে সারাক্ষণই উচিত-অনুচিত বোধ মেনে করছেন, তা কিন্তু নয়। নিজের শরীর বা চেহারা নিয়ে নিজের কাছে স্বচ্ছন্দ বোধ করাটাই সৌন্দর্যের উদ্‌যাপন। আমি যদি নিজেকে নিয়ে, নিজের জীবন, নিজের যাপন নিয়ে সুস্থ স্বচ্ছন্দ থাকি, মনে করি যে নিজেকে নিয়ে অসুবিধে হচ্ছে না, তা হলে সেই অনুভবকেই গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কারণ, সমাজের প্রতিটি আয়নায় আমার ভিন্ন প্রতিবিম্ব ফুটে উঠবে। তাদের উপরে আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। কোনও আয়নায় আমার চেহারা মোটা লাগতে পারে, একই চেহারা অন্য আয়নায় অর্থাৎ অন্য কারও চোখে রোগা ঠেকতে পারে। কারও চোখে আমার বর্ণ কালো লাগলে অন্য কারও চোখে সাদাও মনে হতে পারে! আমার নিজের দৃষ্টিটা যেন সেই চোখের উপর নির্ভরশীল না হয়।’’

মানুষ সুন্দর বৈচিত্রে

বিপণনের বাজারভিত্তিক দুনিয়া সৌন্দর্যের যে কাঠামো তৈরি করছিল, সব্বাইকে সেই এক ছাঁচে ফেলে দিলে প্রত্যেককে একই রকম দেখাত। সে তো একঘেয়ে হয়ে যেত! আসলে মানুষ প্রজাতির সৌন্দর্যই বিভিন্নতায়। প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, ভিন্ন গড়ন। একই মানুষের চেহারা বয়স অনুযায়ী বদলায়। সেই আলাদা রকম চেহারার সঙ্গে মানিয়েগুছিয়ে ভাল থাকাতেই তো জীবনের পরিপূর্ণতা। আমেরিকার স্কুলে পড়ার সময়, পরে হলিউডে গাত্রবর্ণের কারণে ‘বাদামি সন্ত্রাসবাদী’ বলা হয়েছিল প্রিয়ঙ্কা চোপড়াকে। শেষে ‘দেশি গার্ল’-এর লাবণ্যে কিন্তু আচ্ছন্ন হয়েছে আন্তর্জাতিক দুনিয়া। সম্প্রতি প্রিয়ঙ্কা জানিয়েছেন, চল্লিশের প্রান্তে তাঁর শরীর বদলেছে, সেটাও তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন। শরীরকে নতুন ভাবে যত্নে রেখেছেন। তাই এখনও ধারালো তাঁর ম্যাজিক।

তবে সার কথাটা বলেছেন বিদ্যা বালন। তাঁর শিল্পে বুঁদ লোকজনও তাঁর শরীরের আকৃতি নিয়ে কথা তুলতেন। বিদ্যার কথায়, ‘নিখুঁত’ শরীর নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? মেধা, মস্তিষ্ক নিয়ে তো এত আলোচনা, কাটাছেঁড়া নেই! কারণ শরীরটাই পণ্য। মস্তিষ্ক তো আর বিক্রি হয় না!

অতএব, নিজের শরীরটিকে, তার স্বকীয় গঠনকে ভালবাসুন, তাকে ভাল রাখুন। বডি শেমিংয়ের উদ্দেশ্য সফল করে, তাকে পণ্য হতে দেবেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement