সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ) রোগটির দু’টি ধরন— একটি ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, অপরটি এমফাইসিমা। এমফাইসিমা হল ফুসফুসের এক বিশেষ ধরনের রোগ, যেখানে পরিবেশের নানা দূষণকারী পদার্থ দ্বারা সরাসরি ফুসফুসের একেবারে ক্ষুদ্রতম অংশ যেমন রেসপিরেটরি ব্রঙ্কিওল এবং অ্যালভিওলাসের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতির ফলে ফুসফুস আকারে বড় হয়ে যায় এবং তার গ্যাসীয় আদানপ্রদানের ক্ষমতা, মানে অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করার ক্ষমতা ক্রমশ কমতে শুরু করে। এর ফলে বারবার ফুসফুসে সংক্রমণ এবং শ্লেষ্মা বা কফ তৈরি হওয়ার সমস্যা বাড়ে। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট এবং কাশিও হয়। এগুলোই রোগের লক্ষণ। এ ছাড়াও, এই রোগে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে, কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়ে। এর ফলে মাথা ব্যথা, দুর্বলতা, ঝিমুনি থেকে শুরু করে রক্তে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন রোগী।
কেন হয় এই রোগ?
এই রোগের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, দীর্ঘ দিন ধরে নিয়মিত ভাবে দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে আসা। যদিও এই রোগের প্রকোপ পুরুষদের মধ্যেই বেশি, তবু দেখা গিয়েছে, গ্রামের দিকে বায়োমাস ফুয়েল বা জৈব জ্বালানি (ঘুঁটে, খড়, পাট, ঘাস ইত্যাদি) ব্যবহারকারী মহিলাদেরও এই রোগ হয়। ফুসফুস বিশেষজ্ঞ এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী জানালেন যে, “যে কোনও ধরনের নিকোটিন স্মোকিং, যেমন সিগার, সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি থেকে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। তবে কিছু বিরল ধরনের জেনেটিক কারণও আছে। আলফা ওয়ান অ্যান্টি ট্রিপসিন বা এই জাতীয় কিছু এনজ়াইমের অভাব থেকেও এই রোগ হয়। সাধারণত মধ্যবয়সিদের, অর্থাৎ ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সিদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা থাকে।”
কী করে সাবধান হওয়া যায় এই রোগ থেকে?
এই রোগ থেকে সাবধান হওয়ার অন্যতম উপায় হল, যথাসম্ভব পরিবেশ দূষণ এড়িয়ে চলতে হবে, যাঁরা ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন তাঁদের মাস্ক ব্যবহারের অভ্যেস করতে হবে। যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের দ্রুত ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। যাঁরা ধূমপান করেন না, তাঁদের আশপাশের লোকজনের ধূমপান করার সময়ে প্যাসিভ স্মোকিং থেকে দূরে সরে যেতে হবে। গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়ার কার্বন পার্টিকলের পরিমাণ কমলে দূষণের পরিমাণ কমে, ফলে এই রোগের সম্ভাবনা কমে। কাজেই করোনা থাক বা না থাক, মাস্কের ব্যবহার অবশ্যই ভাল। করোনার জন্য এন-নাইন্টিফাইভ জাতীয় অত্যাধুনিক ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা হয়।
এগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাকেও আটকায়। তাই এ রকম মাস্ক শ্বাসকষ্টের রোগীদের পক্ষে অস্বস্তিকর। কিন্তু দূষণপ্রধান এলাকায় সাধারণ কাপড়ের মাস্ক সকলেরই ব্যবহার করা উচিত। এতে ফুসফুস সব সময়েই সুরক্ষিত থাকে।
চিকিৎসায় এই রোগ সেরে যায়?
ডা. অনির্বাণ নিয়োগী জানালেন, “রোগটি ক্রনিক। তাই চিকিৎসায় যে একেবারে শতকরা একশোভাগ নির্মূল হবে, তা বলা যায় না। তবে রোগের লক্ষণগুলোকে চিকিৎসার মাধ্যমে স্তিমিত করে রাখা সম্ভব হয়। কখনও তাপমাত্রা বা বাতাসের আর্দ্রতার আচমকা অনেকখানি পরিবর্তন হলে, এই রোগের লক্ষণগুলো রোগীর দেহে প্রকাশিত হয়ে ওঠে।”
কী ভাবে চিকিৎসা করা হয়?
এই রোগে চিকিৎসার প্রধান উপায়ই হল ইনহেলার। সারা বিশ্বে নানা ধরনের ইনহেলার প্রচলিত রয়েছে। এ ছাড়াও, সমস্যা বেশি হলে ফুসফুসের বেসিক ইউনিটগুলোয় সরাসরি ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় নেবুলাইজ়ার। এ ছাড়াও, কিছু খাওয়ার ওষুধও ডাক্তাররা দিয়ে থাকেন। খুব সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে শর্ট কোর্স স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। ইনফেকশনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অ্যান্টিবায়োটিকও প্রয়োগ করতে হয়। সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পরেও রোগীকে নিয়মিত স্পাইরোমেট্রি বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ়ের মধ্যে থাকতে হয়। ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য এটি খুব প্রয়োজনীয়। এরই সঙ্গে ডা. নিয়োগী আরও জানালেন, “এই রোগীদের ভাল থাকার জন্য ভ্যাকসিন নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কিছু স্ট্রেন বলে দেয়। সেই অনুযায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন আসে। সেই ভ্যাকসিন বছরে একবার করে নিতে হয়। এর সঙ্গে নিউমোকক্কাল ব্যাকটিরিয়ারও ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ডোজ়ে ভ্যাকসিন নিতে হয়। এই ভ্যাকসিন কিন্তু এমফাইসিমা চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাধারণত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের বেশি ব্যক্তিদের জন্যই এই ভ্যাকসিন প্রেসক্রাইব করা হয়।”
এই রোগে কি সার্জারির প্রয়োজন হয়?
এই রোগের মাত্রা খুব খারাপ অবস্থায় গেলে সার্জারির প্রয়োজন হয়, যদিও এই রোগে সার্জারির প্রয়োজন বেশ বিরল। এ রোগে তিন ধরনের সার্জারির ব্যবস্থা আছে। প্রথমত, ফুসফুসের অনেক অ্যালভিওলাই একসঙ্গে নষ্ট হয়ে গেলে, একটা বড় বলের মতো বায়ুপূর্ণ স্পেস তৈরি হয়। একে বলে ‘বুলা’। এটি তৈরি হলে ব্রঙ্কোস্কোপি করে ফুসফুসে একটা বিশেষ ভাল্ভ বসিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, ফুসফুস যখন আকারে খুব বড় হয়ে যায় সাধারণ শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে, তখন ফুসফুস কেটে ছোট করে দেওয়া হয়। এর নাম লাং ভলিউম রিডাকশন সার্জারি বা এলভিআরএস। এটি খুবই বিশেষ ধরনের সার্জারি, সাধারণত করা হয় না। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বয়স, সুস্থ, যাঁরা এই অপারেশনের ধকল নিতে পারবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এটি করা হয়। তৃতীয়ত, বুলেকটোমি। অর্থাৎ প্রথম ধরনের সার্জারির ক্ষেত্রে যে বুলা তৈরি হওয়ার কথা বলা হল, সেগুলোকে কেটে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া এটি।
ডা. নিয়োগী জানালেন, “গত পাঁচ বছর ধরে আমাদের দেশের বহু নামী প্রতিষ্ঠানে লাং ট্রান্সপ্লান্টেশন শুরু হয়েছে। খুব খারাপ এমফাইসিমার ক্ষেত্রে এবং কমবয়সি রোগীদের ক্ষেত্রে এই অপশন নেওয়া হয়। যদিও মাত্র এক শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়।”