বেহাল নিকাশিতেই বাসা রোগের

এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপ ফের শুরু হতেই নজরে পড়ছে যে, শিলিগুড়ি শহরের নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। দিনে রাতে মশার উপদ্রবে বিরক্ত বাসিন্দারাও। বিভিন্ন এলাকাতে শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরসভার তরফে কেন নিকাশি সাফাইয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শহরবাসীদের অনেকেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৫ ০২:৩৭
Share:

শিলিগুড়ি ইস্টার্ন বাইপাসের ধারেই ডাম্পিং গ্রাউন্ডের বাইরেই ফেলা হচ্ছে জঞ্জাল। রয়েছে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপ ফের শুরু হতেই নজরে পড়ছে যে, শিলিগুড়ি শহরের নিকাশি ব্যবস্থা বেহাল। দিনে রাতে মশার উপদ্রবে বিরক্ত বাসিন্দারাও। বিভিন্ন এলাকাতে শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরসভার তরফে কেন নিকাশি সাফাইয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শহরবাসীদের অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, আগের বারের থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার বর্ষার মরসুমে আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল প্রশাসনের। কিন্তু তা করা হয়নি। আগের বার ১৬০ জনের মৃত্যুর পরেও কী করে উত্তরবঙ্গের প্রশাসন এত উদাসীন থাকতে পারে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।

Advertisement

শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, খালপাড়া, নয়াবাজার, হায়দরপাড়া, কুলিপাড়া-সহ বিভিন্ন এলাকাতেই নিকাশি নালার মধ্যেই আবর্জনা জমে রয়েছে। জল দাঁড়িয়ে থাকছে। বিশেষ করে শহরের খোলা নর্দমা এবং বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণ কাজের জায়গায় জমে থাকা জল মশার আঁতুর ঘরে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ।

তবে পুর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ডেঙ্গি এনসেফ্যালাইটিস প্রতিরোধে তাঁরা তৎপর হবেন। এ দিন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বর্ষার মধ্যে ব্লিচিং ছড়ানো বা স্প্রে করার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। আমরা নতুন পুরবোর্ডে শপথ নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে বর্ষা শুরু হয়েছে। তাই নিকাশি পরিষ্কারের জন্য ভাবা হলেও তা করা যায়নি। তবে বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জায়গায় যাতে জল জমে না থাকে, সে ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তিনি জানান, ডেঙ্গি প্রতিরোধে ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে ট্রেনিং করানো হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা এক দফায় সচেতনতা প্রচার করেছেন। শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন শুয়োর ধরার ব্যাপারেও কী করা যায়, তা নিয়ে শীঘ্রই আলোচনা করবেন।

Advertisement


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

যাঁর সমর্থন নিয়ে বামেরা পুরবোর্ড গড়েছেন ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সেই নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দ ঘোষ বলেন, ‘‘ডেঙ্গি, এনসেফ্যালাইটিসের মতো রোগ ঠেকানোর মতো বিষয়ে যাতে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয় সে জন্য মেয়রের সঙ্গে কথা বলব। তা ছাড়া নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক করা, স্প্রে, ব্লিচিং ছড়ানোর মতো পরিষেবা তো যথাযথ দিতেই হবে।’’

অভিযোগ, শিলিগুড়ি শহরের নিকাশি ব্যবস্থার হাল ফেরানো নিয়ে পুরভোটের মুখে রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তেহার ভরে গিয়েছিল প্রতিশ্রুতিতে। আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজ সিস্টেম চালু করার শর্ত দিয়ে তবেই বোর্ডকে সমর্থন জানান অরবিন্দবাবু। তাঁর সমর্থন প্রত্যাশী বামেরা তখন বিনা শর্তে রাজি হয়েছিলেন তাঁর প্রস্তাব মেনে নিতে। সেই সঙ্গে তৃণমূলের পক্ষ থেকেও শহরের নিকাশিকে সাজিয়ে তুলতে নানা রকম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পুরভোটের পর তিন মাস কেটে গেলেও এখনও প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি শহরবাসীর। পুরসভার পক্ষে রাজ্য সরকারের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া, আর কোনও উপায় নেই বলে স্বীকার করেছেন মেয়র। মেয়র বলেন, ‘‘আমরা নিকাশিকে ঢেলে সাজাতে চাই। কিন্তু পুরসভার পক্ষে একক ভাবে তো কোনও কাজ করা সম্ভব নয়।’’

এর আগে পুরসভার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের গা ঘেঁষে শান্তিনগর এলাকায় একটি রাস্তা ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা তৈরি করে দিয়েছিল উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর। পুরসভায় ক্ষমতায় এলে তাঁরা শহরের ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা গড়বেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে পুরভোটে হেরে তারা এখন বিরোধী আসনে।

শহরের মধ্যে টাউন স্টেশন, জংশন স্টেশন লাগোয়া কুলিপাড়া, জ্যোতিনগর, লালা লাজপত রায় সরণি, হরিজন বস্তি, ডাম্পিং গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকায় দিনভর শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। প্রাণিসম্পদ বিকাশের উত্তরবঙ্গের ডেপুটি ডিরেক্টর অমল হালদার বলেন, ‘‘পুর আইনেই রয়েছে শহরে শুয়োরের খামার রাখা যাবে না। বিষয়টি পুরসভার তরফেই দেখা দরকার। তবে শুয়োরের প্রতিষেধক দেওয়ার কর্মসূচি আমরা নিয়ে থাকি। বর্ষার আগে তা করা হয়েছে। বর্ষার পর ফের তা করা হবে।’’ সে ব্যাপারে পুরসভার তরফে বা বাসিন্দারা সাহায্য চাইলে সহায়তা করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

মেডিক্যাল কলেজ সূত্রেই জানা গিয়েছে, মৃতদের মধ্যে নকশালবাড়ির বাসিন্দা বুধুয়া টুডু (৫৩), কার্শিয়াঙের দুধিয়ার বাসিন্দা সুগ্রীব দর্জি (৩১) এইএসে মারা গিয়েছেন। শিলিগুড়ি লাগোয়া জলপাইগুড়ির জেলার অন্তর্গত ভক্তিনগরের দেব রায় (৪১), কল্যাণ বর্মণও (২০) এইএসে মারা গিয়েছেন। ওই এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় মণ্ডল (৩২) মারা গিয়েছেন জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের বাসিন্দা ডলি মাহাতোও (২৭) জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মারা গিয়েছেন। আলিপুরদুয়ারের মধুমিতা দত্ত (১২) এইএসে ও দিনহাটার হারুলাল রসিদ (১১) জেই-তে মারা গিয়েছে।

উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার নির্মল বেরা বলেন, ‘‘জাপানি এনসেফ্যালাইটিস বা এইএস-এ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে অন্তত ৪ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের চিকিৎসা চলছে। ওই রোগীদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কিটও রয়েছে। দুই তিন জন করে রোগী আসায় তেমন কোনও সমস্যা এখন পর্যন্ত হয়নি।’’

গত বছর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, অন্তত ১৬০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। রাজ্য জুড়ে তা নিয়ে হইচই পড়ে। তথ্য গোপনের অভিযোগে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার এবং জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়। পরে সাসপেন্ড হন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ-ও। এ বছর পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাসখানেক আগেই উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের ৪ টি ব্লক, দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি এবং মাটিগাড়া ব্লক এবং জলপাইগুড়ির দুটি ব্লকে অন্তত ১০ লক্ষ বয়স্ক বাসিন্দাকে এনসেফ্যালাইটিসের প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। তবে এর পরেও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে রোগীরা আসছেন। অন্তত ৫ জন রোগী এখন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের রক্ত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement