মন্ত্রী যখন অটোগ্রাফ প্রত্যাশী। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেনের কাছে শশী পাঁজা। ছবি: শৌভিক দে।
সরকারি হাসপাতালে প্রায়ই মেলে না চিকিৎসা। যদি বা সরঞ্জাম থাকে, ডাক্তারের পদ ফাঁকা থাকে। ডাক্তার পাঠালেও তিনি অর্ধেক দিনই থাকেন না হাসপাতালে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে জেলায় জেলায় নতুন মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি করছে, তা কি আদৌ গ্রামের গরিবের কাজে লাগবে?
শুক্রবার এই প্রশ্ন উঠে এল জনস্বাস্থ্য নিয়ে একটি আলোচনা সভায়। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে করেন, নতুন হাসপাতাল তৈরি করাই ঠিক। তিনি বলেন, “একটা হলে তারপর অন্যটা হবে, এ ভাবে চিন্তা করা ঠিক নয়। পুরনো হাসপাতালের উন্নতি করার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন হাসপাতাল তৈরি করতে হবে।”
সভায় না থাকলেও, ঘটনাচক্রে এ দিনই কলকাতায় এসেছেন আর এক বাঙালি অর্থনীতিবিদ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। গরিবের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সহজলভ্য আর তৎপর করার বিষয়ে তিনিও আগ্রহী। তবে নতুন হাসপাতাল তৈরির বিষয়ে তিনি খানিকটা সতর্ক। “চিকিৎসা পরিষেবার মানের উন্নতি করাটাও জরুরি। সে দিকে না দেখে নতুন হাসপাতাল তৈরি করলে অপচয়ের সম্ভাবনা ঠেকানো যায় না।”
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যনীতি বিষয়ে এদিন সভার গোড়ায় কথা বলেন আর এক অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ। বিহার, হিমাচল, রাজস্থান এবং ঝাড়খন্ডের বেশ কিছু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি দাবি করেন, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে একেবারেই ভেঙে পড়েছে, এমন আদৌ নয়। দশ বছর আগে যে সব স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ থাকত, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অনুদানে এখন সেগুলিতে চিকিৎসার যথেষ্ট সরঞ্জাম, ওষুধ রয়েছে, পরিষেবাও মিলছে। তবে ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের উপস্থিতির হার অর্ধেকেরও কম। তা হলে চিকিৎসা করবে কে? দ্রেজ বলেন, ডাক্তারদের গ্রামে রাখতে তামিলনাড়ু সরকার বাড়তি টাকা, আবাসন, উচ্চশিক্ষায় পদ সংরক্ষণ, এমন নানা সুবিধে দিচ্ছে।
নানা সমস্যার মধ্যেও হিমাচল, তামিলনাড়ুর মতো জায়গায় যে ভাল কাজ হচ্ছে, তার উপর জোর দেন অমর্ত্যবাবু। ‘কিছুই বদলাবে না, অতএব কিছুই করার নেই,’ এই ধারণাকে আক্রমণ করে বলেন, “এর ফলে মনে হয়, স্বাস্থ্যে টাকা বিনিয়োগের দরকার নেই। কিছু যে হবে না, তা তো জানাই আছে।” স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে টেনে আনার বরাবরই বিরোধিতা করেছেন তিনি। এ দিনও মনে করিয়ে দেন, পাশ্চাত্য বা এশিয়ার বহু দেশ সর্বজনীন সরকারি চিকিৎসায় যে ভাবে এগিয়েছে, ভারত তা পারেনি। পুরনো হাসপাতালের হাল ফেরানোর সঙ্গে নতুন হাসপাতাল তৈরির জন্য যে বিপুল খরচ দরকার, তা করতে হবে।
কম খরচে ভাল চিকিৎসা গরিবকে যে দিতে হবে, সে বিষয়ে জোর দিচ্ছেন অভিজিৎবাবুও। তবে দেশের নানা রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে সমীক্ষার পর খানিকটা উদ্বিগ্ন তিনি। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপস্থিতির হার এত বেশি, এবং চিকিৎসার মান এত খারাপ, যে গরিবের উপকার হচ্ছে সামান্যই। “কী করে উপস্থিতি, চিকিৎসার মান নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। নতুন হাসপাতাল তৈরি করার আগে সে সম্পর্কে অন্তত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে অপচয় হবে, স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না।” কিন্তু কী ব্যবস্থা কাজ করবে, তা নির্ণয় করা সহজ হচ্ছে না। অভিজিৎবাবু জানান, ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নানা রাজ্যে পরীক্ষামূলক ভাবে বায়োমেট্রিক যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, তাতে কাজের কাজ হচ্ছে না। “ডাক্তারদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যায় কী ভাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়,” জানান তিনি।
অমর্ত্যবাবু অবশ্য দায়বদ্ধতার চাইতে জোর দিচ্ছেন যার উপর, তা দায়িত্ববোধ। “দায়বদ্ধতা বাইরে থেকে চাপানো হয়। দায়িত্ববোধ আসে ভিতর থেকে।” এ কেবল শিশুপাঠ্য নীতিকথা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন যে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধনী-গরিবকে এক জায়গা দিয়েছিল, সেটা সবার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে। একতার সংস্কৃতি, দায়বোধের মানসিকতা, এগুলো ধর্মের শিক্ষা থেকে যেমন আসতে পারে, তেমনই আসতে পারে স্কুলের শিক্ষা থেকেও। দুর্নীতি, অসাম্য দূর করতে না পারলেও অন্তত যেখানে মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, সেখানে সকলকে সমান পরিষেবা দিতে পারা সম্ভব, বলেন অমর্ত্যবাবু। তিনি বলেন, কেবল স্বার্থ দিয়ে মানুষের সম্ভাব্য আচরণের বিচার করা অর্থনীতির পক্ষে ভাল নয়, সমাজের পক্ষেও নয়।
দায়িত্ববোধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংশয় নেই অভিজিৎবাবুরও। তাঁকে ভাবাচ্ছে এই প্রশ্ন, “আজ পর্যন্ত যাঁর মধ্যে দায়িত্ববোধ দেখা যায়নি, কাল কী করে তা আসবে?” পশ্চিমবঙ্গ-সহ নানা রাজ্যে সমীক্ষার মাধ্যমে তিনি উত্তর খুঁজছেন, কী করে ডাক্তারের প্রশিক্ষণের সুফল বাস্তবিক রোগীর কাজে লাগে। “দায়িত্ববোধ কী করে আনা যায়, তা নিয়ে আরও চর্চা দরকার। হয়তো আমরা ধরে নিই ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্বশীল করা যাবে না। তাই তাঁরাও দায়িত্ব নেন না,” বলেন অভিজিৎবাবু।