রণবীর রাজ কপূর। —ফাইল চিত্র।
পেশোয়ারের ভোলারাম দি গলির চারতলা অট্টালিকায় রসেবশে থাকতেন বশেশ্বরনাথ কপূর। বাবার ধনসম্পদে মৌজ করতে পুলিশের চাকরি ছেড়েছিলেন, স্ত্রী গতাসু হলে নতুন দার পরিগ্রহ করেছিলেন জীবন উপভোগের বাসনায়। হরেক সখী ছিল তাঁর। বিশাল চেহারার এই ক্ষত্রীবংশীয় হিন্দু নিজেকে পাঠান বলেই পরিচয় দিতেন। তিনি কারও বাড়ি গেলে মেয়েরা অন্দরমহলে দৌড় দিত। বলত, “হট নি, পর্দা ডাল দে। লুচ্চে চাচা আ গয়ে।”
কলকাতার হাজরা রোডে বছর দশেকের নীলনয়ন খোকাও এমনই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত সুন্দরীদের দিকে। তার নাম সৃষ্টিনাথ ওরফে চিস্তো বা রণবীর রাজ কপূর ওরফে রাজু। ১৯২৪, ১৪ ডিসেম্বর তার জন্ম পেশোয়ারে, বশেশ্বরের ছেলের ঘরে। বশেশ্বর-পুত্র পৃথ্বীরাজ কপূর কলকাতার নিউ থিয়েটার্সে অভিনয়ের বছরগুলোয় সপরিবার ছিলেন যদু ভট্টাচার্য লেনের বিশাল ফ্ল্যাটে। ১৯৩৯-এ নায়ক পৃথ্বীরাজ কপূর ফিরলেন মুম্বইয়ের ফিল্ম-স্টুডিয়োয়। তখনও ছেলেটির ইংরেজি বিষয় ছাড়া পড়াশোনায় মতি নেই, ভাল পারে বক্তৃতা আর কমেডি। রাজু প্রতি হপ্তায় প্রেমে পড়ছে শুনেই মা রামসরণি বলেছিলেন, ঠাকুরদা বশ্বেশ্বরনাথের রক্তের দোষ। তবে, বিদেশিদের মতো ত্বক আর চোখ সে পেয়েছিল মায়ের কাছ থেকেই। পৃথ্বীরাজ ব্যস্ত হিরো, রাজু ও তার ভাই-বোনেদের কাছে মা-ই পৃথিবী। বিশেষত, রাজুর পরের দুই ভাইয়ের শৈশবে অকালমৃত্যু হলে, চতুর্থ ছেলে শাম্মি ও মেয়ে ঊর্মি জন্মানোর আগে পর্যন্ত বড় ছেলেকে অষ্টপ্রহর বুকে রাখতেন রামসরণি। রাজ নিজমুখে বলেছেন, শৈশবে মায়ের সঙ্গেই স্নান করতেন তিনি, সেখান থেকেই তাঁর কামচেতনা, প্রেমের পবিত্রতার বোধের উন্মেষ। তাঁর এই বিস্ফোরক স্বীকারোক্তিতে যখন সমাজ শিউরে উঠেছিল, ছোট ভাই শশী কপূর বলেছিলেন, “আপনারা ঠিক বুঝছেন না। রাজ ভাই এ যুগের কৃষ্ণ।” নব্য ভারতীয় সিনেমাধারার অগ্রদূত, সমাজবাদী চিন্তক খোয়াজা আহমেদ আব্বাস রাজ কপূরের সিনেমাগুলির লেখক। তাঁর মূল্যায়ন, “বহির্বিশ্বের কাছে এক নব্যনির্মিত জাতিরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক দূত হয়ে উঠেছিলেন তিনি, কারণ যুদ্ধপীড়িত ভাগ্যহতদের স্বপ্ন দেখতে ও স্বপ্নকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় সিনেমার শোম্যান। কারণ, রাজ কপূর এক জন নন, আসলে তিনি দু’জন রাজ কপূর।”
মেরা নাম রাজু
বশেশ্বরের থেকেই কপূররা আর একটি রক্তবীজকে উত্তরাধিকারে বইছেন। পিতা-পুত্রের সমস্যা। ছেলে পৃথ্বীর প্রতি ভীষণ কড়া ছিলেন বশ্বেশ্বর। পৃথ্বীরাজ সন্তানদের প্রতি স্নেহবৎসল হলেও, রাজ মনে করতেন, স্কুলে তাঁর নিগ্রহের মূলে বাবার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ। তিনি বাবার গ্রিক দেবতা-সম চেহারা, মেঘমন্দ্র ধ্বনি পাননি। ছোট্টখাট্টো, নাদুসনুদুস, চিকন স্বর। বন্ধুরা ‘ডিব্বা’ বলে, শিক্ষকেরা বাবার তুলনা টেনে ভর্ৎসনা করেন। প্রতিবাদের পরিবর্তে রাজ নিজেকে নিয়েই ঠাট্টা-ইয়ার্কি শুরু করলেন। নাটকে খুচরো পার্ট পেয়েছেন, স্টেজে এমন ধড়াম করে উল্টে গেলেন যে লোকে নায়ককে ভুলে তাঁকেই হাততালিতে ভরিয়ে দিল। বোনকে বলেন, “ভাইকো কিসি দো।” ছোট্ট ঊর্মি এগিয়ে এলে দাদা পলকে মুখ ঘুরিয়ে চেটে দিয়েই চম্পট। পরিত্রাহি কান্না আর দমাদ্দম মারের আওয়াজে পাড়া মাত। লোক বলত, চিস্তোর কীর্তি।
ছোট থেকেই বাবার সূত্রে পর্দায় ও মঞ্চে নামগোত্রহীন পার্শ্বচরিত্রে মুখ দেখিয়েছেন রাজ। পাপাজি তাঁকে বড় সিনেমা পেতে সাহায্য করেননি, তবে স্টুডিয়োর মেঝে পরিষ্কার, ট্রলি ঠেলা থেকে প্রোডাকশনের সব কাজ শিখতে পাঠিয়েছিলেন। পরিচালক কেদার শর্মার থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন রাজ। ক্ল্যাপবোর্ড আনতে বললেই চুল-টুল আঁচড়ে নিজেকে আয়নায় দেখে আসতেন। সকলে বলত, ‘নার্সিসিস্ট’ ছোকরা। এক বার ক্ল্যাপ মারতে গিয়ে অসাবধানে অভিনেতার নকল দাড়ি উপড়ে দিয়েছিলেন। কেদার দিলেন এক চড়। রাজ পালালেন। কেদার শুনলেন, রিলগুলোয় ওঠা নিজের ছবি পরে দেখেন পৃথ্বী-তনয়। পর দিন ছেলেটি আসতেই ‘নীলকমল’ ছবিতে নায়ক হতে বললেন কেদার। কেঁদে ফেললেন রাজ। বললেন, ‘‘ভায়োলেন্সে ব্যথা লাগে না সাহাব। কোমলতাতেই মন মেদুর হয়।’’
সিনেমাই রাজ কপূরের জীবন, জীবনটাই তাঁর সিনেমা। সব ছবিতেই ছড়িয়ে রেখেছেন নিজের অভিজ্ঞতা আর অনুভব। সত্তর-আশির অ্যাকশন যুগেও মারদাঙ্গাকে ব্রাত্য করে পেলব প্রেমে স্থিত থেকেছেন। শিক্ষিকার প্রতি অনুরাগ, সহপাঠীদের হাসাহাসি দেখিয়েছেন ‘মেরা নাম জোকার’-এ। কৃষ্ণ সেজে কাপড় চুরি করেছেন ‘সঙ্গম’-এ। ‘আগ’-এর অনেকটাই পৃথ্বীরাজের মঞ্চজীবন। রাজকে নিয়ে যে সব বিস্ময়-কাহিনি আজও ফিল্মমহল্লায় সজীব, তার থেকেই নাকি গড়ে উঠেছে ভবিষ্যকালের বহু সিনেমার থিম আর হিট ডায়লগ।
রাজের ঈর্ষাও কিংবদন্তি-তুল্য। বম্বে টকিজ়ে কিছু দিন কাজ করেছিলেন। কিন্তু পারিবারিক বন্ধু ইউসুফকে (দিলীপ কুমার) নিয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন স্টুডিয়োর সম্রাজ্ঞী দেবিকা রানি। তাই বম্বে টকিজ় থেকে বেরিয়ে এসে আরকে ফিল্মস তৈরি করেন রাজ।
রুশি টুপির হিন্দুস্তানি বাদশা
পৃথ্বী থিয়েটারের সোশ্যালিস্ট আবহাওয়া এবং জ্ঞানীগুণী সংযোগ রাজের চিত্তজগৎ ও ঘনিষ্ঠবৃত্ত গঠন করেছিল। ১৯৪৮-এ প্রথম সিনেমা ‘আগ’ তৈরি করে রাজ হলেন দেশের কনিষ্ঠতম ফিল্মনির্মাতা। ছবির কাহিনিবুনট ও লাইটিং উচ্চপ্রশংসিত। নজর কাড়ল মূল ভাবনা— শারীরিক সৌন্দর্যের ঊর্ধ্বে আত্মার ঐশ্বর্যের অনুসন্ধান। ঠিক এই তত্ত্বকে কেন্দ্র করে ত্রিশ বছর পরে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ তৈরি করেন তিনি।
‘আগ’ থেকেই রাজ-নার্গিসের জুটির যাত্রা শুরু, কিন্তু পরের সিনেমা ‘বরসাত’-এ যুবসমাজ তাঁদের প্যাশন প্লে-র স্রোতে ডুবে গেল একেবারে। আর বিশ্বজয় হল ‘আওয়ারা’ এবং ‘শ্রী ৪২০’-এ।
ভারতের চার্লি চ্যাপলিন সেজে সিনেমার নতুন ভাষা তৈরি করলেন তিনি। পৃথ্বীরাজ পর্দায় ঐতিহাসিক চরিত্র বা দেবতা, জজ-ব্যারিস্টার সাজতেন। তাঁর পর্বতপ্রমাণ ছায়া রাজের শৈশব-কৈশোরে আঁধার এনেছে। তাই কি ছেঁড়া জুতো, ফাটা জামা, লাঠিতে ঝোলা নিয়ে গরিব, সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে গেলেন রাজ? ছোট থেকেই রাজের প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন, লরেল-হার্ডি। ‘আগ’ আর ‘বরসাত’-এ নিজের লুক ও ক্যামেরার আলো-আঁধারি, ওয়াইড অ্যাঙ্গলের ব্যবহারে ছিল অরসন ওয়েলসের প্রভাব। ১৯৫২-র ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সত্যজিতের মতোই রাজের মননেও রেখাপাত করে। মজেছিলেন ইটালিয়ান ছবিগুলির কারিগরিতে। ফ্রাঙ্ক কাপরার সিনেমায় যেমন ‘আন্ডারডগ’-এর ফ্যান্টাসি বাস্তবে সত্যি হয়ে যায়— সেই আশাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পাল্টে দিয়েছিলেন সঙ্গীতের ঘরানা। পৌরাণিক সিনেমার ধারা ভেঙে জওহরলাল নেহরুর সাম্যবাদী ভারতকেই দেখালেন সিনে-পর্দায়। চ্যাপলিনের ছবির মতো দুর্নীতিবাজ ধনীর দুর্দশা, তড়বড়িয়ে চলনবলন দেখে দেশভাগের বেদনাবিদ্ধ আমজনতা চোখের জল মুছে হাসলেন খুব। রাজের জীবনবোধে ভরা সুনীল চোখের তারায় দেশবাসী দেখলেন, কষ্টের শেষ হবে, সৎ সাধারণ মানুষের জিত হবে। রাস্তার চায়ের ঠেকেও নার্গিসের মতো স্বপ্নসুন্দরী এসে বসবে, যে বুকে মাথা রেখে গাইবে ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’। ‘আওয়ারা হুঁ’ গানের অ্যাকর্ডিয়ান তুফান তুলল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দীর্ণ সোভিয়েত রাশিয়া ও হিন্দুকুশ পর্বত সংলগ্ন দেশগুলির শরণার্থী ও সাধারণ বাসিন্দাদের সরল প্রাণে। রাশিয়া তখন সোশ্যালিস্ট জমানার বিধিনিষেধ থেকে সদ্য মুক্ত হয়েছে। রুশ চেহারার ভারতীয় নায়কের নাচাগানার ক্লাসিক সিনেমা আবার জীবনকে ভালবাসতে শেখাল তাঁদের। ‘দি ইডিয়ট’-এর স্রষ্টা ফিয়দর দস্তয়েভস্কির দেশ বরণ করে নিল এই বুদ্ধুরামকে। ‘আওয়ারা হুঁ’ গাইলেন বুলগানিন, শুনলেন মাও সে তুং। পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় সিনেমায় স্বর্ণযুগ আনলেন বিমল রায়, ভি শান্তারাম, মেহবুব খান, গুরু দত্ত, রাজ কপূররা।
নয়নের ভুলভুলাইয়া
পর্দায় স্পষ্ট হল শ্বেতবসনা প্রেয়সীর প্রতি রাজ-অনুরাগ। তারও শিকড় কলকাতায়, শৈশবে। সাদা শাড়ি পরনে পৃথ্বীরাজের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন এক অভিনেত্রী। জোকার রাজু তাঁকে ফুল দিয়েছিল। আজীবন সেই ঊর্বশীকেই খুঁজেছেন রাজ, রিল ও রিয়েলে। খুঁজেছেন সেই নারীকে, যে তাঁর সৃষ্টিশীলতার হৃদ্স্পন্দন শুনতে পাবে। জড্ডনবাইয়ের মেয়ে নার্গিসের মধ্যে সেই নর্মসহচরীকে পেয়েছিলেন, বলেছেন সহযোগীরা। রাজের স্টুডিয়োও সামলাতেন নার্গিস। কৈশোরে রাজের দুটো জোরদার প্রেম হয়েছিল। তার পরই প্রেমনাথের বোন, ষোড়শী কৃষ্ণা মলহোত্রর সঙ্গে ঘটা করে একুশের রাজের বিয়ে দিয়ে দেন তাঁর পাপাজি। দূরসম্পর্কের পিসি কৃষ্ণাকে সাদা রঙে দেখেই রাজ রাজি। তার চার মাস পরে কৃষ্ণার গর্ভে যখন সদ্য এসেছেন রণধীর কপূর, তখন রাজ ও নার্গিসের প্রথম সাক্ষাৎ, যাকে সেলুলয়েডের পর্দায় রাজ পুনর্নির্মাণ করেছেন ‘ববি’-তে, ঋষি-ডিম্পলের প্রথম মোলাকাতে। ঋষি সেখানে রাজেরই তারুণ্যের ভূমিকায়, নামও রাজ। ডিম্পল কাপাডিয়া ববি (নার্গিসের ডাক নাম বেবি)। প্রায় এক দশক একত্র পথচলার পর নার্গিস ছুটে গিয়েছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে। হিন্দুধর্মের এক-বিবাহের আইনে বদল চেয়েছিলেন, কারণ, তিনি রাজ কপূরকে বিয়ে করতে চান। প্রধানমন্ত্রী গর্জে উঠেছিলেন। বুদ্ধিমতী নার্গিস তাঁর এক বান্ধবীকে বলেছিলেন, “রাজু (এ নামেই ডাকতেন) কৃষ্ণাকে ছাড়বে না। নইলে, ওদের পরিবারের কলেবর এ ভাবে বাড়ত না।” তত দিনে রণধীর, রিতু, ঋষি বাবাকে যমের মতো ডরাচ্ছেন। কারণ, বাবার মেজাজ, মায়ের সঙ্গে তুলকালাম ঝগড়া। কৃষ্ণার গর্ভে যখন রিমা, তখনই এক দিন নার্গিস পুণের রাজবাগ ফার্মে এলেন হিলজুতো পরে। নিজের উচ্চতা নিয়ে সংবেদনশীল রাজ কপূর নিশ্চিত হলেন, ‘মাদার ইন্ডিয়া’র সেটের গুঞ্জন সত্যি। নার্গিসের জীবনে অন্য কেউ এসেছে। সুনীল দত্ত ছ’ফুট লম্বা ছিলেন।
শম্ভু মিত্র-অমিত মৈত্র পরিচালিত ‘জাগতে রহো’-র পর আর রাজের সঙ্গে জুটি বাঁধেননি নার্গিস। তাঁর ও রাজের ষোলোটি সিনেমায় (ছ’টি আরকে-র ব্যানারে) নায়িকার সিক্ত রূপ, তিরতিরে পাখির মতো সমর্পণে ছিল শিল্পিত শৃঙ্গার, অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্য। কিন্তু নার্গিসহীন রাজের জীবন ও দৃষ্টিপাত বদলে গেল। তিনি মদ্যপানে মাত্রা ছাড়ালেন। অনেকের মতে, নেশার রাক্ষস গোপন সব ফ্যান্টাসির বাঁধ ভেঙে দিল। নার্গিসের সঙ্গেই সোশ্যালিস্ট ছবির মানবতাও বহুলাংশে অস্ত গেল। পদ্মিনীকে নিয়ে তৈরি ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহেতি হ্যায়’ বিনোবা ভাবের সমাজবিপ্লবে প্রাণিত ঠিকই। কিন্তু সব ছাপিয়ে গিয়েছে দেশোয়ালি ভবঘুরের সাজে রাজের ‘জি’ উচ্চারণের প্রখর ম্যানারিজ়ম আর পদ্মিনীর দেহবল্লরী। নায়িকার অত সুন্দর মুখখানির বদলে ক্যামেরার নজর কেবলই অন্যত্র! রাজকে এড়াতে তড়িঘড়ি পদ্মিনীর বিয়ে দেন আত্মীয়রা। আরও বিভীষিকাময় ‘সঙ্গম’-এ বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে রসায়ন। রাজকে চরিত্রহীন বলতেন বৈজয়ন্তীর দিদিমা ইয়েদুগিরি। বিদেশে আউটডোরের সময়ে উপহারের উপঢৌকন পেয়ে বলেছিলেন, “ইয়ে তো রাজাসাহাব হ্যায়।” বৈজয়ন্তী-কাণ্ডের সময় পাঁচ সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে হোটেলে চলে যান কৃষ্ণা। আর কোনও স্ক্যান্ডাল ঘটবে না, এই শর্তে আত্মহত্যার চিন্তা ছাড়েন। অবশ্য বৈজয়ন্তীও হঠাৎ বিয়ে করেন রাজের চিকিৎসক ড. বালিকে।
নায়িকাদের সঙ্গে রাজের কী সম্পর্ক ছিল— অদ্যবধি রহস্য। তবে দুটো বিষয় সত্যি। শৈশবে দেখা সুন্দরী ছিলেন দময়ন্তী সাহনি, বলরাজ সাহনির প্রথম স্ত্রী। আর সম্প্রতি করণ জোহরের শোয়ে এসে জ়িনত আমন যে বলেছেন, নীতুদের পরিবারের এক জন তাঁকে বলেছিলেন, জ়িনি, বল তোমার কোর্টে— তিনিও সম্ভবত রাজ কপূর।
পেয়ার কী ধুন
শুধু স্নানদৃশ্যের সৌজন্যেই কিন্তু রাজ কপূর চার দশক শীর্ষে থাকেননি। তাঁর নিজের কথায়, রিগিং করে ইলেকশন জেতা যায়, দর্শকের হৃদয় নয়। শশী বলেছেন, ভাই মেঝেতে শুয়ে শুধু খবরের কাগজ, কমিকস পড়তেন (প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, স্থূল রুচির পত্রিকাও!)। তাতেই ভারতবাসীর মনটাও পড়ে ফেলতেন। ছেলেমেয়েরা বলেছেন, হয়তো সিনেমার খাতিরেই নায়িকাদের সঙ্গে প্রেমও করেছেন। না হলে, তিনি বলেন— “কৃষ্ণা আমার স্ত্রী, সন্তানদের মা। নার্গিস আমার নায়িকা, সিনেমা-সন্তানের মা!” নেশার ঘোরে নাকি এর চেয়েও অবমাননাকর কথা বলতেন। আবার বন্ধুরা বলেছেন, সাহিত্য, পুরাণ, বিশ্বসিনেমায় অগাধ পাণ্ডিত্য। সিনেমাই তাঁর ভগবান। শুটিং, সম্পাদনার সময়ে পানীয় ছুঁতেন না। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ধোঁয়া দেখে সেটের আগুনের মধ্যেও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ‘আওয়ারা’-র বিখ্যাত স্বপ্নদৃশ্যে মেঘ তৈরির কৌশল পেয়ে গিয়েছেন। যে লোক পিতৃতন্ত্রের উগ্র নিদর্শন, বাড়ির মেয়েদের সিনেমার চৌহদ্দিতে আসতে দিলেন না, ‘প্রেমরোগ’-এ তিনিই শোনান নারীমুক্তির আখ্যান! হোলি, জন্মদিন ও নানা অনুষ্ঠানে খানাপিনার ফোয়ারা আজ রূপকথা। অথচ, নিজের পোষা মুরগির ডিম ছেলেদের কখনও দিতেন না। পর্দায় মাটির মানুষ সাজতেন। এ দিকে, বৈজয়ন্তীমালা তাঁকে তেল মাখানোয় চেঁচান— দ্রাবিড়গোষ্ঠী আমার সোনালি চুল কালো করে দিচ্ছে। অন্যদের প্রযোজিত সিনেমায় অভিনয়ের সময় বাড়তি কথা না বলে প্রশংসা পেয়েছেন। ও ভাবেই আরকে ফিল্মসের অস্ত্রগুলি লুকিয়েছেন— এই নিন্দাও রটেছে। ইন্দর রাজ আনন্দ, রামানন্দ সাগররা বলেছেন, তাঁর সৃষ্টির বৃত্তে ঢুকলে আর বেরোনো যায় না। রাজ কপূর চরম বৈপরীত্যের উদাহরণ, হ্যামলিনের জাদুকর।
তাই বার বার মতানৈক্যের পরও আরকে-তে ফিরে এসেছেন আর এক শুভ্রবসনা দেবকন্যা। লতা মঙ্গেশকর। ১৯৮৮-তে রাজের মৃত্যুর পর সার কথাটিও ফাঁস করেছিলেন তিনিই।
এসি চালিয়ে হুইস্কি গলায় ঢেলে হাঁপানি রোগে পড়ে কর্মক্ষমতা, আয়ু খুইয়েছিলেন রাজ কপূর। তবুও দাদাসাহেব ফালকে নিতে জোর করে দিল্লি গেলেন। ২ মে অডিটোরিয়ামেই অ্যাস্থমা অ্যাটাক হল। প্রোটোকল ভেঙে প্রেসিডেন্ট শোম্যানের আসনের কাছে এসে তুলে দিলেন সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান। রাষ্ট্রপতির অ্যাম্বুল্যান্সে করে এইমস-এ গিয়ে ভর্তি হলেন। এক মাস যমে-মানুষে ট্রাপিজ় খেলা, রাজবন্দনায় বিহ্বল জনতা, মিডিয়ায় চলল সার্কাস।
তখনই যশ চোপড়া ও মনমোহন দেশাই বলেন, শরীর প্রদর্শন করে ছবি হিট করাননি। রাজ লোককে হলে টেনে এনেছেন গান দিয়ে, তার পর কাহিনি দিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে মনোরঞ্জন করেছেন। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণই রাজের মৃত্যুর কারণ— ‘রাম তেরি গঙ্গা ময়লি’। যেখানে তারকাশক্তি ছাড়াই মাত্র একটি গানের মোহে আসমুদ্রহিমাচলকে ভুলিয়ে হলে এনেছেন। দশ বছরের রাজ কলকাতার নিউ থিয়েটার্সে রাইচাঁদ বড়াল, কানন দেবী, পঙ্কজ মল্লিকের কাছে সঙ্গীতের দীক্ষা নিয়ে গিয়েছেন। ডাফলি, ব্যাগপাইপ, ট্রাম্পেট-সহ দশ-বারোটি যন্ত্র অনায়াসে বাজাতে পারতেন। তিনি নিজেই তাঁর সিনেমাগুলোর প্রায় সব গানের সৃষ্টিকর্তা। পঞ্চাশের দশকেই শঙ্কর-জয়কিষণের সঙ্গে বসে আরকে ফিল্মসের যাবতীয় ধুন টেপ করে রেখেছিলেন। পরে লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, রবীন্দ্র জৈনরা গানগুলিকে ‘ফাইনাল’ রূপ দিয়েছেন শুধু। ওঁর সিনেমায় লোগোর বাজনা, নেপথ্যসঙ্গীত মন দিয়ে শুনলেই প্রমাণ মিলে যাবে।
বাতিল হয়ে যাওয়া ‘অজন্তা’ সিনেমায় নার্গিসের জন্য তৈরি একটা গান রাজ তিন দশক তুলে রেখেছিলেন। তার পরে হঠাৎ একদিন লতাকে ডেকে গাওয়ালেন আর সেই গান প্রৌঢ় লতার বয়স কমিয়ে দিল অনেকখানি। অ্যাস্থমা-কবলিত রাজ সেই গান নিয়ে সিনেমা বানাতে ও অকালমৃত্যুকে ডাকতে গঙ্গোত্রী গেলেন। রাজ-প্রয়াণের পরেই, রবীন্দ্র জৈনের উপস্থিতিতেই এ কথাটি জানিয়ে লতা গেয়েছিলেন— ‘সুন সাহিবা সুন...’
মৃত্যুতে সম্ভবত তাঁর আত্মা নার্গিসকেই অনুসরণ করেছে। ৩ মে নার্গিসের মৃত্যুদিন, ২ মে দাদাসাহেব ফালকে নেওয়ার পরে হল-এই পড়ে যান তিনি। ১ জুন বেবিজির জন্মদিন। পর দিনই, ২ জুন তাঁর উপর্যুপরি পাঁচবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের খবরে ঘোর ‘বরসাত’-এও হাসপাতাল লোকে লোকারণ্য। সে রাতেই সব শেষ, বস্তুত ইতি আরকে ফিল্মসেরও।
যদিও যত দিন দর্শক বাঁচবেন, তত দিন তাঁর সিনেমা চলবে টিভির পর্দায়। আর জোকারের মৃত্যু হবে না শতবর্ষ পেরিয়ে আরও বহু দিন।
ঠিক যে ভাবে আরকে ফিল্মসের প্রতীকে চিরন্তন করে গিয়েছেন রাজ-নার্গিসের প্রেমালিঙ্গন।