খুব বেশি দিন মলত্যাগ করতে গিয়ে কষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রতীকী ছবি।
ঘরে-বাইরে কাজ সামলান বছর ৪৭-এর শর্মিষ্ঠা। দিন শুরু হয় বাড়ির সকলের জন্য চা-জলখাবার তৈরি করা দিয়ে। ঘরের কাজ সেরেই বেরিয়ে পড়েন অফিসে। সকালে বেশি সময় শৌচাগারে কাটানো কিংবা সময় নিয়ে প্রাতরাশ করাটা তাঁর হয়ে ওঠে না। রোজ ভাবেন ভাত, রুটি খাবেন। কিন্তু কাজের চাপে হয়তো শুধু চা খাওয়ার সময় জোটে। সঙ্গে লেগেই থাকে নানা অনুষ্ঠান বাড়ি। এর মাঝেই শর্মিষ্ঠাকে ব্যতিব্যস্ত করে এক গুরুতর সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য।
শর্মিষ্ঠার মতো এই সমস্যা বহু জনেরই কাহিনি। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান সুবীর কুমার মণ্ডল জানাচ্ছেন, যদি সপ্তাহে অন্তত তিন দিন কম-বেশি কিছুটা পরিমাণে মলত্যাগ হয়, তবে তা স্বাভাবিক বলা যেতে পারে। মাঝেমধ্যে খাদ্যের প্রকৃতি কিংবা জীবনধারার পরিবর্তনের সঙ্গে এ বিষয়ে কিছুটা বদল দেখা যেতে পারে। তবে খুব বেশি দিন মলত্যাগ করতে গিয়ে কষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
দু’ধরনের বিপত্তি
পাকস্থলী থেকে খাবার পরিপাক হতে হতে ক্ষুদ্রান্ত্রে যায়। সেখান থেকে তা বৃহদন্ত্রে। ক্ষুদ্রান্ত্র থেকেই খাবারের পুষ্টিগুণ শরীরে গৃহীত হয়। বৃহদন্ত্রে অবশেষে তাতে থাকা জল শরীরে শোষিত হয়। যত বেশি সময় ধরে খাবার বৃহদন্ত্রে থাকে, তত বেশি সময় ধরে তা শক্ত হতে থাকে। মলত্যাগের সময়ে এটিই মাঝেমধ্যে সমস্যা তৈরি করে। ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, কোষ্ঠকাঠিন্য মূলত দু’ধরনের—
অ্যাকিউট কনস্টিপেশন: অনেক সময়ে নতুন কোনও জায়গায় বা অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে জল ও খাবারের ধরনে পরিবর্তন হয়। তখন কোষ্ঠের সমস্যা দেখা দেয়। তবে এই সমস্যা সাময়িক।
ক্রনিক কনস্টিপেশন: বেশ কিছু সময় ধরে যখন কোষ্ঠের সমস্যা চলতে থাকে, তখন বলা যেতে পারে রোগটি ‘ক্রনিক’ পর্যায়ে রয়েছে।
যে কারণে সমস্যা
বয়সে নজর: মূলত ৪৫ বা তার বেশি বয়সের মহিলাদের এবং ৫০ বা তার বেশি বয়সি পুরুষদের মধ্যে কোষ্ঠের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মধ্যেই নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার প্রবণতা কমে আসে। এক জায়গায় বসে টানা কাজ করা, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শৌচাগারে না যাওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। এগুলির ফলে বাড়তে পারে কোষ্ঠের সমস্যা।
মায়েদের ক্ষেত্রে: মায়েদের মধ্যে ৪৫-এর পরে এই সমস্যা দেখা যায় বেশি। গর্ভাবস্থায় তাঁদের বিভিন্ন পেশি যান্ত্রিক কারণে ঠিক মতো কাজ করে না, রেকটামে চাপ পড়ে। হরমোনের ভারসাম্যে পরিবর্তনও কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ।
শিশুদের ক্ষেত্রে: অনেক সময়ে দেখা যায়, দুধ খাওয়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে শিশুরা মলত্যাগ করে ফেলছে। অভিভাবকেরা ভাবছেন, ‘পেটে কিছুই থাকছে না হয়তো’। অনেক সময়ে এ-ও দেখা যায়, সপ্তাহে এক দিন মলত্যাগ করছে শিশু। এ ক্ষেত্রেও অভিভাবকেরা চিন্তা করেন সন্তানদের নিয়ে। তবে এ ধারণা ঠিক নয়। ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, শিশুদের খাদ্যতালিকায় প্রাথমিক ভাবে দুধটাই থাকে। তাই তাদের শরীরে ‘রাফেজ’ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি হয় না। সে কারণেই বড়দের মতো অনেক সময়ে নিয়ম মেনে রোজ মলত্যাগ তারা করে না।
অন্য রোগের সঙ্গতে
দীর্ঘ দিন ডায়াবিটিসে ভুগলে স্নায়ুর উপরে নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে মলত্যাগে।
পারকিনসন্স রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে কোষ্ঠের সমস্যা দেখা দেয়। ডা. সুবীর মণ্ডল জানাচ্ছেন, বাকি সব পেশির মতোই খাদ্যনালিও শরীরের এক ধরনের পেশি। পারকিনসন্সে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের পেশির উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে, তাঁদের খাদ্যনালিও ঠিক ভাবে কাজ করে না। নিয়ন্ত্রণ থাকে না মলত্যাগের উপরেও।
পাইলস বা ফিসচুলায় যাঁরা ভোগেন, তাঁদের দু’ধরনের সমস্যা। ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, এ ধরনের রোগীরা মলত্যাগের সময়ে ব্যথার ভয় পান। তাই তাঁদের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য বেশি দেখা যায়। আবার কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা থাকলেও অনেক সময়ে পাইলসের সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে ল্যাক্সেটিভ নিয়মিত খাওয়াযেতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজ়ম, হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজ়ম, অ্যানোরেক্সিয়া রোগীদের ক্ষেত্রেও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।
ইঙ্গিত অন্য কিছুর
ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, ক্রনিক কোষ্ঠকাঠিন্য কিছু ক্ষেত্রে অন্য রোগের ইঙ্গিত দেয়। কোনও সংক্রমণের কারণে মলদ্বার সঙ্কুচিত হতে পারে। ক্রনিক কোষ্ঠকাঠিন্য আবার অন্ত্রের ক্যানসার বা টিউমরেরও ইঙ্গিত দেয়। তাই মলত্যাগের সময়ে শরীরে বেশি অস্বস্তি হলে বা মলের সঙ্গে রক্ত এলে, অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তপরীক্ষা, এক্স-রে বা কোলোনোস্কপির মতো পরীক্ষাকরা দরকার।
ডায়েটে সচেতনতা
অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীদের অনেকেরই খাওয়াদাওয়ার প্রতি অনীহা থাকে। বহু খাবার বাদ থাকে তাঁদের খাদ্যতালিকা থেকে। ফলে, বাড়তে থাকে কোষ্ঠের সমস্যা। আমাদের রোজকার খাদ্যতালিকায় অনেক সময়ে স্বাস্থ্যকর খাবার থাকে না। ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, দ্রবণীয় বা সলিউবল ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যদি রোজকার খাদ্যতালিকায় থাকে, তবে তা স্বাভাবিক মলত্যাগের পক্ষে সহায়ক। ভাতের মধ্যে এই উপকারী ফাইবার থাকে, কিন্তু রুটিতে থাকে না। তাই ভাত মলত্যাগের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখে, কিন্তু আটা মলের পরিমাণ বাড়ায়।
পাশাপাশি, পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, ফাইবার জাতীয় খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারে। খাদ্যতালিকার বিষয়ে সুবর্ণার পরামর্শ—
ওটস, আটার রুটি চলতে পারে।
খোসা-সহ আপেল, পেঁপে, কমলালেবু খাওয়া যেতে পারে। তবে ফলের রস চলবে না।
পাতে থাকুক ফাইবারে ভরপুর ডুমুর, রাঙা আলু, শাক ও নানা রকমের আনাজ।
নানা ধরনের ডাল, মটরশুঁটি, চিয়া সিড, ফ্ল্যাকসিড শরীর ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
নিয়মিত ভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান অবশ্য জরুরি।
কোন অভ্যেসে না
অনেকেরই অভ্যেস ফোন বা বই নিয়ে শৌচাগারে যাওয়া। এটি কিন্তু একেবারেই চলবে না।
এ ধরনের সমস্যা থাকলে কোল্ড ড্রিঙ্কস, মদ্যপান থেকে দূরে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।
চলবে না অতিরিক্ত কফি।
এ সব নানা খুঁটিনাটি দিক মেনে চলার পাশাপাশি, সুবীরের পরামর্শ, দিনের নানা ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের জন্য কিছুটা সময় রাখতেই হবে। তাতে মানসিক চাপ কমবে। স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হবে। দিনে দু’বার মলত্যাগের চেষ্টা করুন। নিজেকে ‘সক্রিয়’ রাখলে খাবার হজম ও নীচের দিকে পাচিত খাদ্য সঞ্চরণে সুবিধে হবে। কমবে আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও।