উৎসব শেষে পড়াশোনায় মন নেই? কী ভাবে ছন্দে ফিরবে জীবন? ছবি: সংগৃহীত।
দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটা— এ বছরের মতো মিটে গিয়েছে। অনেক স্কুল আগেই খুলছে। কিছু স্কুল খুলছে ভাইফোঁটার পর দিনে। সামনেই পরীক্ষা। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসে কই?
এমনিতে বারো মাসে তেরো পার্বণ হলেও, দুর্গাপুজো থেকে ভাইফোঁটা পর্যন্ত টানা উৎসবের মরসুম চলে। তার পরে পড়তে বসতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয় অনেকেই। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় কিশোর-কিশোরীদের। কারণ, তাঁদের মনে উৎসবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। এই সময়ে করা আনন্দ-হুল্লোড়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করাতেই মন আটকে থাকে।’’ মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় মনে করাচ্ছেন, এই বয়সটা কিন্তু প্রেমে পড়ারও। পুজোর সময়ে নতুন বন্ধু বা সম্পর্ক হলে কিংবা কাউকে একটু বাড়তি ভাল লাগলে মন জুড়ে সে-ই থাকে। ফলে বইতে মন বসে না।
তা হলে কী ভাবে ছন্দে ফেরা সম্ভব?
পড়ুয়াদের বয়স অনুযায়ী মনের উপর উৎসবের প্রভাব পড়ে। অনিন্দিতার কথায়, ‘‘একেবারে ছোট যারা, ৩-৫ বছর বয়সিদের নিয়ে বিশেষ সমস্যা নেই। তবে পায়েল বলছেন, ‘‘পড়ার চাপ না থাকলেও রুটিনে ফিরতে হয়। এ জন্য বাড়িতে শান্ত পরিবেশ তৈরি করা দরকার। খুদে পড়ুয়াদের স্কুল, বন্ধুদের কথা বলে ছন্দে ফেরানো যেতে পারে। ক্রিসমাসের আগে আবার একটু পড়াশোনা করতে হবে বলে বুঝিয়ে তাদের পড়তে বসানো দরকার।’’
বয়স যখন ৬ থেকে ১২
তবে ৬ থেকে ১২ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে উৎসবের আবহে মন কিছুটা চঞ্চল হয়ে পড়ে। ফলে, তাদের পড়তে বসতে বললেই তারা বই খুলে বসবে না। পায়েলের পরামর্শ, অভিভাবকদের উদ্যোগী হয়ে এই বয়সের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পড়াতে বসাতে হবে। তবে শুরুতে কঠিন বিষয় না পড়িয়ে কিছু লিখতে দেওয়া যেতে পারে। অঙ্ক কষতে বলা যেতে পারে। পাশাপাশি, বাড়িতে উৎসবের আলোচনা থামিয়ে বড়দেরও প্রতি দিনের কাজ করাটা প্রয়োজন।
কৈশোর
কৈশোর এবং তার পরবর্তী বয়সের পড়ুয়াদের জন্য মন বসানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাদের জন্য কী উপায়?
রুটিন
পড়াশোনায় ফিরতে হলে দৈনন্দিন রুটিন অনুসরণ করা প্রয়োজন। উৎসব মানে খাওয়া, ঘুম সবেতেই কম-বেশি অনমিয়ম হয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ও বদলে যায়। প্রথমে ঘুম, সঠিক সময়ে খাওয়া দিয়ে শুরু করতে হবে। পাশাপাশি, সময় ধরে পড়তে বসতে হবে। প্রথমে এক, দু’দিন বা এক সপ্তাহ সময়টা কিছুটা কম রাখলেও ধীরে ধীরে তা বাড়াতে হবে।
পড়াশোনার লক্ষ্য
উৎসবের আবহে নিয়মিত পড়াশোনা হয় না। হয়তো সামনেই পরীক্ষা। তাই পরীক্ষার কত দিন বাকি আছে, তার মধ্যে কী কী পড়া বাকি, সেগুলি একটি বোর্ডে বা কাগজে লিখে দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মনোবিদ অনিন্দিতার কথায়, ঘুরতে-ফিরতে চোখের সামনে কতটা পড়া বাকি দেখলে পড়তে বসার তাগিদ তৈরি হবে।
মনঃসংযোগ
উৎসবের আনন্দের মুহূর্ত এই সময় ভিড় করে থাকে। ফলে, কারও কারও পড়ায় মনঃসংযোগে অভাব হতে পারে। মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ধ্যান বা প্রাণায়ামের অভ্যাস করা যেতে পারে। শরীরচর্চা বা সকালে উঠে হাঁটহাটির অভ্যাসও কার্যকর হতে পারে। অঙ্ক করলেও মনঃসংযোগে সুবিধা হতে পারে।
চঞ্চলতা
মোবাইল, ইন্টারনেটে মজে থাকলে পড়ায় মন বসবে না সেটাই স্বাভাবিক। সমাজমাধ্যমে ছবি পোস্ট, তাতে কে, কি প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তায় ডুবে থাকলে পড়াশোনার ক্ষতি অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন।
পায়েল ঘোষের পরামর্শ, এই সময়ে ‘ডিজিটাল ডি-টক্সিফিকেশন’ শুধু পড়ুয়া নয়, বাড়ির অন্যান্য সদস্যদেরও প্রয়োজন। অর্থাৎ, কাজের বাইরে বিনোদনের জন্য মোবাইল ব্যবহারের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে ফেলতে হবে। পড়ুয়ারা না মানতে চাইলে, তাদের বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে একটু কড়াও হতে হবে।
তবে ১৩-১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় অমনোযোগের ভিন্ন কারণও হতে পারে। মনোবিদ অনিন্দিতা বলছেন, এই বয়সে জীবনে নতুন অনেক আকর্ষণ থাকে। হরমোনের তারতম্যে শরীর এবং মনে বদল আসে। কাউকে বিশেষ ভাবে ভাল লাগে, শারীরিক এবং মানসিক আকর্ষণ তৈরি হয়। তা নিয়ে নিরন্তর ভাবনা চলতে থাকলে পড়াশোনাতেও প্রভাব পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক।
প্রেম এবং পড়াশোনা একসঙ্গে চলতে পারে?
প্রেমে পড়লে অনেকের যেমন পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কেউ আবার মন দিয়ে পড়াশোনাও করে। এক-এক জনের জীবনে এক-এক রকম প্রভাব পড়ে। মনোবিদের পরামর্শ, পড়ুয়াদের সঠিক যৌনশিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রেম নিয়েও ধারণা দেওয়া দরকার। তাদের বোঝানো যেতে পারে, প্রেম জীবনে আসতেই পারে। তবে সেটা জীবনের একটা অংশ মাত্র। বড় হতে গেলে পড়াশোনা করে স্বনির্ভর হওয়াটাও জরুরি। কড়া শাসনে এ ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে। এ নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে, ছেলেমেয়েরা ভুল পদক্ষেপও করতে পারে।