করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও অনেকের হার্ট, ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেও কিছু বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন
Corona

সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পোস্ট-কেয়ার জরুরি

করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও অনেকের হার্ট, ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেও কিছু বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন

Advertisement

নবনীতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২১ ০৬:৪১
Share:

করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরে সেরিব্রাল স্ট্রোকে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা বিরল নয়। অন্য দিকে করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও দীর্ঘ দিন ধরে অক্সিজেন সাপোর্টে রয়েছেন বহু রোগী। এই ভাইরাসের দাপটে শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা সেরে যাওয়ার পরেও কিছু কিছু বিষয়ে সাবধানতা প্রয়োজন। এমন অনেক সমস্যা আছে, যা কোভিড টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেও চলতে থাকে, যেমন—

Advertisement

প্রদাহ চলতে থাকে

Advertisement

মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘কোভিড কিন্তু আমাদের শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেই আক্রমণ করছে। এর ফলে শরীরে যে ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ হয়, তা প্রত্যেকটি অরগ্যানেই কমবেশি হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, যাঁদের উপসর্গ কম, তাঁদের ক্ষেত্রে করোনা সারার পরে এই প্রদাহ কমে যায়। কিন্তু যাঁরা গুরুতর আক্রান্ত, তাঁদের শরীরে এই প্রদাহ চলতে থাকে, কোভিড টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেও।’’ এই প্রদাহ হার্টে হলে তা থেকে হার্ট ফেলিয়োরের আশঙ্কাও থাকে বলে জানালেন নিউরোলজিস্ট ডা. জয়ন্ত রায়। তাঁর কথায়, ‘‘হৃদ্‌যন্ত্রের পেশিতে প্রদাহ চলতে পারে। তাই সিভিয়রলি যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, তাঁরা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরেও বিশ্রাম জরুরি। পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে তাঁরা যদি পুরোদমে কাজ শুরু করে দেন, তা হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ সে সময়েও তাঁদের মায়োকার্ডাইটিস চলতে পারে। এর ফলে বুক ধড়ফড়, বুকে চাপ বোধ হওয়া, হার্ট রেট অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। হার্ট ফেল করার আশঙ্কাও থেকে যায়। তাই করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও অক্সিমিটার মনিটরিং করতে হবে, পালস রেট দেখার জন্য।’’ কিন্তু এই প্রদাহ যে সকলের হবেই, তা-ও কিন্তু নয়। মাঝারি থেকে গুরুতর ভাবে যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের সাবধান থাকতে হবে। কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. সুনীলবরণ রায় বললেন, ‘‘শুধু পালস রেট বেড়ে যাওয়া নয়, তা কমেও যেতে পারে। তাই পালস রেট অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে বা ৪০-এর ঘরে নেমে এলে... দু’টি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’’

থ্রম্বোসিসের সমস্যা

কিছু করোনা রোগীর রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে, যাকে বলা হয় থ্রম্বোসিস। শরীরের কিছু বিশেষ অরগ্যানের শিরায় এ রকম থ্রম্বোসিস হলে তা প্রাণঘাতীও। ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘হাতে, পায়ের ছোট ছোট শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে গেলে ততটা সমস্যা দেখা দেয় না। কিন্তু হার্টের কোনও শিরায় বা মস্তিষ্কে এই রক্ত জমাট বাঁধার মতো ঘটনা ঘটলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে।’’ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরে দু’তিন মাসের মধ্যে সেরিব্রাল স্ট্রোকে রোগী মারা গেলেন। তার পিছনেও দায়ী এই থ্রম্বোসিস।

সেরিব্রাল স্ট্রোক কেন হচ্ছে?

ডা. জয়ন্ত রায় বললেন, ‘‘স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে কোভিড। দু’ধরনের স্ট্রোক দেখা যায়। একটি হল ইসকিমিক স্ট্রোক। এ ক্ষেত্রে ব্লাড থ্রম্বোসিস হয়ে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। আর একটি ক্ষেত্রে ব্রেনে হেমারেজ হয়ে স্ট্রোক। কোভিডে ইসকিমিক স্ট্রোক বেশি দেখা যাচ্ছে। তার কারণ কোভিড রোগীদের কোয়াগুলেশন অ্যাবনর্মালিটিস। রক্ততঞ্চন প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্য রোগীদের ডি-ডাইমার টেস্ট করতে দেওয়া হয় এখন। এই ডি-ডাইমারের মাত্রা খুব বেশি হলে বোঝা যায় যে, তাঁদের থ্রম্বোসিসের সম্ভাবনা বাড়ছে। কোভিডে আক্রান্ত অনেক রোগীরই ডি-ডাইমারের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ, তিনগুণ... এমনকি চারগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। তখন সেই রোগীদের অ্যান্টি-কোয়াগুলেশন ট্রিটমেন্টে রাখতে হবে। এমন রোগীও এসেছে, কম বয়স, ব্লাড সুগার, প্রেশার... কোনও সমস্যাই নেই, স্ট্রোক হওয়ার কথাই নয় তার। কিন্তু সে-ও স্ট্রোকে প্রাণ হারাল।’’ তাই প্রথম থেকেই ঠিক মনিটরিং করা জরুরি। প্রয়োজনে গোড়া থেকেই অ্যান্টি-কোয়াগুলেশন চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

আর এই থ্রম্বোসিস হার্ট ও ফুসফুসেও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ব্রেন, হার্ট ও ফুসফুসে এই থ্রম্বোসিস প্রাণঘাতী। তাই করোনা সেরে যাওয়ার পরেও ডি-ডাইমার মনিটরিং করা যেমন জরুরি, তেমনই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টি-কোয়াগুলেশন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে, অনেকর শরীরের গাঁটে ব্যথা হচ্ছে। ডা. তালুকদারের কথায়, ‘‘অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি বিক্রিয়ায় প্রোটিন জমা হচ্ছে গাঁটে। ফলে যাঁদের কোনও দিন আর্থ্রাইটিস ছিল না, তাঁদেরও এ রকম গাঁটে ব্যথার সমস্যা দেখা যাচ্ছে।’’ ফুসফুসও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেকাংশে। ফলে করোনামুক্ত হওয়ার পরেও অনেক রোগীর অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে।

অক্সিজেন সাপোর্ট কত দিন দরকার?

প্রথমে বুঝতে হবে, রোগীর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কতটা রয়েছে এবং ফুসফুসের কতটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত। পালমোনোলজিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘ফুসফুসে ইনফেকশন হলে টিসুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সেখানে ফাইব্রাস টিসু তৈরি হচ্ছে। সেগুলি আসলে ডেড সেল। তিন মাসের মধ্যে কিছু কিছু ফাইব্রাস টিসু চলে যায়। তার পরে আর যায় না। এই ফাইব্রোসিসের ফলে ফুসফুসের কাজ ব্যাহত হয়। তবে তা বুঝতে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট আর অক্সিমিটারের রিডিংয়ে চোখ রাখতে হবে। অন্য দিকে রোগীর বয়স কত, তাঁর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কতটা, হাঁটলে অক্সিজেন লেভেল কেমন থাকছে, এই সব বিষয়গুলো বিবেচনা করে ঠিক করা হয় রোগীকে কত দিন অক্সিজেন সাপোর্টে রাখতে হবে।’’ তবে করোনা সেরে গেলেও ধূমপান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলেন ডা. নিয়োগী। তাঁর মতে, ধূমপান সরাসরি ফুসফুসের কোষ থেকে বেশি মিউকাস সিক্রেশন করায় আর ব্রঙ্কাসে স্প্যাজ়ম ঘটায়। তাই ধূমপান একেবারেই করা যাবে না। বরং ফুসফুস ভাল রাখার জন্য পালমোনোলজি রিহ্যাবিলিটেশন, ফিজ়িয়োথেরাপি, ব্রিদিং এক্সারসাইজ় ও ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রির উপরে জোর দিলেন ডা. নিয়োগী।

শারীরিক অসুস্থতার বাইরে অনেকের মধ্যে বিবিধ মানসিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, রাতে ঘুম না আসা, মানসিক স্থিতির অভাবের মতো অনেক সমস্যাই গ্রাস করছে রোগীকে। মনে রাখবেন, কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসা মানেই কিন্তু চিকিৎসা সম্পূর্ণ নয়। করোনামুক্ত হওয়ার পরেও চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে। নিয়ম মেনে চললে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন অচিরেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement