ফিটনেসের নয়া মন্ত্র পিলাটেস

শরীর ফিট রাখাই শুধু নয়, তাকে নানা আঘাত থেকে মুক্তি দিতে পিলাটেস হয়ে উঠছে জনপ্রিয় পেশির আঘাত আবার বাইরে থেকে দেখে বোঝাও যায় না। এ সবের পাশাপাশি জোসেফকে ভাবিয়েছিল জেলখানায় বন্দি থাকা মানুষদের কথাও। তাঁদের সে ভাবে শারীরচর্চার উপায় ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৫১
Share:

গ্রিপ-সহ বিশেষ ধরনের পিলাটেস মোজা পরে করা যায় ব্যায়াম

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে ফিট থাকার কায়দা, নিয়ম, ধরন। কখনও যোগব্যায়াম, কখনও কেটলবেল এক্সারসাইজ়, কখনও কার্ডিয়োয় ফোকাস করে শরীর সুস্থ রাখার কথা ভাবা হয়। সে ভাবে দেখতে গেলে পিলাটেস হয়ে উঠছে একুশ শতকের নতুন মন্ত্র। রিহ্যাবিলিটেশন এক্সারসাই‌জ় হওয়ার দরুন বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। যদিও শুরুটা কিন্তু এখন নয়। গত শতকের গোড়ার দিকে জোসেফ পিলাটেস শুরু করেছিলেন ফিট থাকার এই নয়া উপায়। তাঁর নাম থেকেই পরে নামকরণ হয়। জোসেফ এক সময়ে সার্কাসে ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন ট্রাপিজ়ের খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক সময়েই আঘাত পান মানুষ। পেশির আঘাত আবার বাইরে থেকে দেখে বোঝাও যায় না। এ সবের পাশাপাশি জোসেফকে ভাবিয়েছিল জেলখানায় বন্দি থাকা মানুষদের কথাও। তাঁদের সে ভাবে শারীরচর্চার উপায় ছিল না। তাই জোসেফ চেষ্টা করেন এমন কিছু ব্যায়ামের, যা খালি হাত-পায়ে ইনস্ট্রুমেন্ট ছাড়াই করা যায়। আবার তাতে ফিটও থাকে শরীর। এ ভাবেই শুরু হয় পিলাটেসের প্রথম যাত্রা।

Advertisement

পাখির চোখ

Advertisement

পিলাটেস শুধু শরীর ফিট রাখে না, এর কাজ আরও বেশি। পিলাটেস স্পেশ্যালিস্ট ও ইনস্ট্রাক্টর গৌরব বসু বলছেন, ‘‘ইদানীং বিশেষ কিছু আঘাতে প্রায়ই ভোগেন নানা মানুষ। স্লিপ ডিস্ক, ফ্রোজ়েন শোল্ডার, স্পন্ডিলোসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস... এই ধরনের সমস্যা, ব্যথা থেকে পিলাটেস অনেকাংশে মুক্তি দেয়। পিলাটেস কোনও রোগকে নির্মূল করে সারিয়ে তোলে না। কিন্তু হাড়, অস্থিসন্ধি, পেশিগত নানা আঘাতের কষ্ট কমিয়ে সুস্থ জীবনে ফেরাতে সাহায্য করে পিলাটেস। তাই এই ধরনের ব্যায়ামের লক্ষ্য হল রিহ্যাবিলিটেশন।’’ এ ছাড়া কোর স্ট্রেংথও বাড়ায় পিলাটেস। স্পাইন, অ্যাবডোমেন, লোয়ার অ্যাবডোমেন এবং পেলভিক ফ্লোর— এই সমস্ত অংশের জোর বাড়িয়ে গোটা শরীরের ব্যালান্স বাড়াতে সাহায্য করে। বসার ভুল ভঙ্গির ফলে নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়। সেগুলিও শোধরানোর চেষ্টা করে এই ব্যায়াম। এ সবের পাশাপাশি মেন্টাল অ্যালার্টনেস, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যন্ত্রণায় কাবু যে মানুষটি হাঁটতে-চলতে কষ্ট পেতেন, শুয়ে কাটাতেন দিনের বেশির ভাগ সময়, তিনিই নিয়মিত পিলাটেস চর্চার মাধ্যমে ফিরে পান আত্মবিশ্বাস।

এ ছাড়াও আছে ফ্যাট বার্নিং। শরীরের মধ্যে ফ্যাটের অংশকে বার্ন করিয়ে, অনেক সময়েই ওজন কমায় এই ব্যায়াম। কিন্তু পিলাটেসের লক্ষ্য কখনও ক্যালরি বার্ন করানো নয়। ৪৫ মিনিটের পিলাটেস সেশনের পরে হয়তো দেখা গেল কারও ক্যালরি বার্ন হয়েছে মাত্র ৩৫০-৪০০ কিলোক্যালরি। কিন্তু তার মাঝেই ফ্যাট কমে। মাসলের জোর বাড়ে। আবার ফ্যাট কমার দরুন শরীরের গড়নও সুন্দর হয়। পিলাটেস করলে ওজন মারাত্মক কমবেই, তার মানে নেই। কিন্তু ফ্যাট বার্ন ও টোনিং করিয়ে শরীরের শেপ ফিরিয়ে আনে তা, জানাচ্ছেন পিলাটেস ট্রেনার দেবত্রী বসু।

নানা ধরন

এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, খালি হাত-পায়ে শারীরচর্চা করে নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে জুড়েছে নানা কায়দা। বদলে গিয়েছে ধরন। ক্লাসিক ম্যাট, কনটেম্পোরারি স্টুডিয়ো, ক্লিনিক্যাল ও গ্রুপ রিফর্মার— নানা ধরন।

ক্লাসিক ম্যাট পিলাটেস: গোটা বিশ্ব জুড়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এই ক্লাসিক ম্যাট পিলাটেস। শুধু একটি ম্যাট থাকলেই যথেষ্ট। রোজকার ফিটনেস রেজিমে যাঁরা ব্যায়ামটি রাখতে চান, শুরু করতে হবে ক্লাসিক ম্যাট পিলাটেস দিয়েই। তার পরে করা যেতে পারে অন্যান্য ধরনের পিলাটেস।

কনটেম্পোরারি স্টুডিয়ো পিলাটেস: এতে যোগব্যায়াম, ফিটনেস ট্রেনিং, ফিজ়িয়োথেরাপিও জুড়ে যায়। রেসিস্ট্যান্স ব্যান্ড, ফোম রোলারস, বল লাগে এতে।

গ্রুপ রিফর্মার পিলাটেস: এটি আদতে রিফর্মার নামে এক ধরনের ইকুইপমেন্টের উপরে করা গোটা শরীরের এক্সারসাইজ়। এই পিলাটেস পারফর্ম করার সময়ে রিফর্মারের উপরে একাধিক ব্যায়াম করতে হয়। শরীরের স্ট্রেংথ, ফ্লেক্সিবিলিটি এবং ব্যালান্স বাড়ানোর কাজ করে গ্রুপ রিফর্মার পিলাটেস। পাঁচ-দশ জনের বেশি লোককে নিয়ে সাধারণত এই ব্যায়াম করা হয় না।

ক্লিনিক্যাল পিলাটেস: নাম থেকেই বোঝা যায় যে, এই ব্যায়াম আসলে রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ করে। কখনও ম্যাটের উপরে, কখনও ছোট প্রপ ব্যবহার করে এটি করা হয়। মাসলকে শান্ত করে কার্যকর করে তোলাই এর লক্ষ্য।

শুরুটা করতে হবে ক্লাসিক ম্যাট পিলাটেস দিয়েই। পরে শরীরের ক্ষমতা বাড়লে এগোনো যায় অন্যান্য ধরনেও। ক্লিনিক্যাল পিলাটেসের ক্ষেত্রে রোগের ধরন ও রোগীর অবস্থার উপরে নির্ভর করে ব্যায়াম দেওয়া হয়।

পিলাটেস করার সময়ে

এই ধরনের ব্যায়াম করার সময়ে কিছু জিনিস মাথায় রাখা জরুরি।

শ্বাস-প্রশ্বাস: রক্ত সঞ্চালন ঠিক রেখে শরীরের অভ্যন্তর পরিষ্কার করার কাজ করে পিলাটেস। ঠিক মতো শ্বাস গ্রহণ ও পুরোপুরি ত্যাগ করার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ফিট থাকার চাবিকাঠি। টেনে শ্বাস নিলে অনেকটা অক্সিজেন ভিতরে প্রবেশ করে, যা ফ্যাট বার্ন করতে সহায়ক। একই ভাবে শ্বাস ছাড়তে হয় পুরোপুরি।

মনোযোগ: পিলাটেস করতে গেলে মনোযোগের দরকার বেশি। কারণ অনেক সময়ে শরীরের বিশেষ কোনও অংশে, মাসলের উপরে চাপ দিয়ে, শ্বাস আটকে ব্যায়াম করা হয়।

নিয়ন্ত্রণ: মাসল বা পেশিকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যায়াম করা হয়। অনেক সময়ে গ্র্যাভিটির বিপরীতে পেশি উত্তোলন করা হয়। ফলে নিয়ন্ত্রণও গুরুত্বপূর্ণ।

সেন্টারিং: সেন্টারিং বা কেন্দ্রিকতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। অ্যাবডোমেন, লোয়ার ও আপার ব্যাক, হিপ, ইনার থাই— এই

সমস্ত কিছু অর্থাৎ ‘পাওয়ার হাউস’-এর কেন্দ্র থেকে শুরু হয় পিলাটেসের ব্যায়াম। এ ছাড়াও ভঙ্গি, পেশি ও শরীর সঞ্চালন, শারীরিক জোরের ভূমিকাও রয়েছে।

গৌরব বসু বলছেন, ‘‘একদম প্রাথমিক পিলাটেস মুভমেন্টের মধ্যে পেলভিক কার্ল, দ্য হান্ড্রেড, সিঙ্গল লেগ স্ট্রেচ, সুইমিং, টিজ়ার ইত্যাদি রয়েছে। তবে সেগুলি দেখে খুব সহজ মনে হতে পারে এই ব্যায়াম। কিন্তু কোথায়, কী ভাবে শ্বাস নিতে ও ছাড়তে হবে এবং কী ভাবেই বা নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে পেশির উপরে, তা একমাত্র বলতে পারেন প্রশিক্ষকই।’’ ফলে পিলাটেস শুরু করতে চাইলে অবশ্যই যাওয়া উচিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কাছে। তাঁরাই নির্দেশ দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন কী ভাবে কোন মুভমেন্ট করতে হবে।

এই ব্যায়াম খালি পায়ে করা যায়। তবে গ্রিপ-সহ বিশেষ ধরনের পিলাটেস মোজা পরেও করতে পারেন। ফ্ল্যাটফুট থাকলে বিশেষ ধরনের জুতো পরেও করা যায়।

পিলাটেস এমন এক ধরনের ব্যায়াম, যাতে শরীর ফিট থাকার পাশাপাশি নানা রোগবালাই থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। ফলে নিত্যদিন যন্ত্রণায় না ভুগে স্বচ্ছন্দে সঙ্গী করতে পারেন পিলাটেসকে।

মডেল: সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, মেলেনি ধর; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল

মেকআপ: সৌমেন সেনগুপ্ত

লোকেশন: ওয়েলনেসম্যানিয়া ইন্টারন্যাশনাল, গড়িয়া শ্রীরামপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement