চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে শাখাগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা বেশ কম বা অনেকটাই ভ্রান্ত, তার মধ্যে একটি হল ফিজ়িয়োথেরাপি। অনেকে যেমন মাসাজের সঙ্গে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেন। হাঁটুতে ব্যথা বা কাঁধে যন্ত্রণা হচ্ছে, তাতে খানিক মাসাজ করিয়ে নিলেন। এতে সাময়িক আরাম হয়তো হল কিন্তু রোগ নিরাময় হল না। আবার অনেকে ভাবেন ফিজ়িয়োথেরাপিস্টরা শুধু কিছু ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম করান। বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবই কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণাগুলির কারণ। তবে ফিজ়িয়োথেরাপির ব্যবহার অনেক দিনের। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুইডেনে জিমন্যাস্টদের ট্রিটমেন্টের জন্যও ফিজ়িয়োথেরাপির প্রচলন জনপ্রিয় হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আহত সৈনিকদের সুস্থ করতে এই পদ্ধতি কাজে এসেছিল। এখন ফিজ়িয়োথেরাপি আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই শাস্ত্রের কার্যকারিতা
নার্ভ, বোন এবং মাসল— এই তিনটির উপরে ফিজ়িয়োথেরাপি মূলত কাজ করে, যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত। জেনে নেওয়া যাক, সাধারণত কোন কোন সমস্যার ক্ষেত্রে এই চিকিৎসাবিজ্ঞান কাজ করে। নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, অর্থোপেডিক, গাইনিকলজিক্যাল, জেরিয়াট্রিক, পেডিয়াট্রিকস, লাংস, হার্ট এবং স্পাইনাল কর্ড... তালিকা লম্বা। স্পোর্টসম্যানরা যেমন ফিজ়িয়োথেরাপি ছাড়া অচল। ডিজ়িজ়, ইনজুরি, ডিফর্মিটি, ডিসএবিলিটি— প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ জীবনযাপনের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার জন্য ফিজ়িয়োথেরাপি প্রয়োজন। ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সোনালি সেনগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘একটা সোজা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই, কেউ এলেন তাঁর কোমরের সমস্যা নিয়ে। দেখতে হবে তাঁর সমস্যার উৎস কোথায়? নার্ভ, হাড় নাকি মাসল? সেটা বুঝে শুরু হবে চিকিৎসা। আমরা রোগীর বয়স এবং লাইফস্টাইল সব কিছু বিবেচনা করে ট্রিটমেন্ট করি। রোগ যদি দীর্ঘ দিনের হয়, তা হলে সারাতেও সময় লাগবে। কিন্তু দুর্ঘটনা ছাড়া হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনও সমস্যার সমাধানে বেশি সময় লাগে না।’’
• আমাদের দেশে অর্থোপেডিকের সমস্যার সমাধানের জন্য ফিজ়িয়োথেরাপির প্রচলন সবচেয়ে বেশি। আর্থ্রাইটিস, জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, গাউট, জয়েন্ট পেন— প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফিজ়িয়োথেরাপি করিয়ে রোগী আগের চেয়ে ভাল রয়েছেন, এমন উদাহরণ বিস্তর। কোনও দুর্ঘটনার পরে কারও সার্জারি হয়েছে কিন্তু তার পরেও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না, হাঁটা-চলা বা শরীরের কোনও অঙ্গ সঞ্চালনায় সমস্যা হচ্ছে— এ সব ক্ষেত্রে ফিজ়িয়োথেরাপি প্রয়োজন।
• নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরি, বলছিলেন ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সুরজিৎ রায়। তাঁর কথায়, ‘‘নিউরোর চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি ফিজ়িয়োথেরাপি করলে অনেক দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়। সার্জারির পরে রিহ্যাবিলিটেশনের জন্য ফিজ়িয়োথেরাপি করলে রোগী সহজেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।’’ স্ট্রোক পেশেন্টদের জন্য ফিজ়িয়োথেরাপি জরুরি। প্যারাপ্লেজিয়া, কোয়াড্রিপ্লেজিয়ার রোগীদের সুস্থ করতে এই থেরাপি ছাড়া গতি নেই।
• স্পাইনাল কর্ডের চিকিৎসায় ফিজ়িয়োথেরাপি জরুরি। স্পাইনের সমস্যা নিউরো এবং অর্থো দু’রকমের হতে পারে। কিন্তু সেরে ওঠার জন্য ফিজ়িয়োথেরাপিস্টের সাহায্য লাগবে।
• কার্ডিয়ো রিহ্যাবিলিটেশনের ক্ষেত্রেও ফিজ়িয়োথেরাপিস্টদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। কারও লাংসে এতটাই কফ জমে যে, তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে চেস্ট ফিজ়িয়োথেরাপি কাজে আসে। ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সোনালি সেনগুপ্ত নিজের অভিজ্ঞতার কথায় বলছিলেন, ‘‘পনেরো বছর একজনের কফের সমস্যা ছিল। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারতেন না। পালমোনোলজিস্টের ওষুধ এবং চেস্ট ফিজ়িয়োথেরাপি তাঁর সেই জমে থাকা কফ বার করেছিল।’’ নিউমোনিয়া, চেস্ট ইনফেকশন বা আইসিইউ-তে ভর্তি রোগী যখন স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না, তখন এই থেরাপি কাজে দেয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেক রোগী চেস্ট ফিজ়িয়োথেরাপিতে উপকার পাচ্ছেন, জানালেন সুরজিৎ রায়। কোভিড-১৯ সরাসরি আঘাত হানে লাংসে। চেস্ট থেরাপি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা স্বাভাবিক করতে এবং কফ বার করে দেওয়ার কাজে অব্যর্থ।
আর একটি বিভাগ হল পেডিয়াট্রিক ফিজ়িয়োথেরাপি। ছোট শিশুর শ্বাসের সমস্যায় চেস্ট ফিজ়িয়োথেরাপি কাজে আসে। বা কোনও শিশুর যদি ডিফর্মিটি থাকে, তার সমাধানও এই চিকিৎসার মাধ্যমে সম্ভব। স্পেশ্যাল চাইল্ডদের হাঁটা-চলা ও অন্যান্য মুভমেন্টের সমস্যায় এই থেরাপি কাজে লাগানো হয়।
• গাইনিকলজিক্যাল ট্রিটমেন্টে ফিজ়িয়োথেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়। ‘‘আমাদের দেশে গাইনিকলজিক্যাল কারণে ফিজ়িয়োথেরাপি ট্রিটমেন্টের প্রচলন খুবই কম। অথচ বিদেশে পোস্ট এবং প্রি-নেটাল কেসে ফিজ়িয়োথেরাপিস্টরা সাহায্য করেন। নর্মাল ডেলিভারির আগে ফিজ়িয়োথেরাপি করালে মায়ের প্রসবের সময়ে সুবিধে হয়। ডেলিভারির পরে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যইও এই থেরাপি কার্যকর,’’ মন্তব্য ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সুরজিৎ রায়ের। পিসিওডি-র ট্রিটমেন্টে ফিজ়িয়োথেরাপির পরামর্শ দিচ্ছেন সোনালি সেনগুপ্ত। ‘‘ফিজ়িয়োথেরাপির মাধ্যমে অ্যাবডমিনাল, পেলভিক মাসলগুলো স্টিমুলেট করানো হয়। পেলভিকের আশপাশে যে ছোট ছোট মাসল থাকে, এক্সারসাইজ়ের মাধ্যমে সেগুলো টাইট করানো হয়। একে বলা হয় পেলভিক ফ্লো এক্সারসাইজ়। পিসিওডি তো বটেই, যাঁরা টয়লেট সামলাতে পারেন না বা টয়লেট পাচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না— এ ধরনের কেসও সারানো সম্ভব,’’ বললেন তিনি। এখন অনেক ফিটনেস বিশেষজ্ঞই পিলাটিসের দিকে ঝুঁকেছেন। এটিও এক ধরনের ফিজ়িয়োথেরাপির মধ্যেই পড়ে।
• জেরিয়াট্রিক সমস্যার সমাধানের জন্যও ফিজ়িয়োথেরাপি বিশেষ জরুরি। বয়সজনিত কারণে অনেকেরই হাঁটাচলায় সমস্যা তৈরি হয়, হাতের মুভমেন্টে সমস্যা হয়, জোর কমে যায়— এ সব ক্ষেত্রে এই থেরাপি কাজে আসে।
• স্পোর্টসের সঙ্গে ফিজ়িয়োথেরাপির যোগসূত্রের কথা সকলেই জানি। খেলোয়াড়দের চোট-আঘাত নিত্যদিনের সমস্যা, যে কারণে একটি স্পোর্টস টিমের সঙ্গে সারাক্ষণ ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট থাকেন।
• মাসলজনিত রোগের চিকিৎসায় ফিজ়িয়োথেরাপি প্রয়োজন। অনেক সময়ে ছোট বাচ্চাদের মাসল গ্রো করে না। এ দিকে তার হাড় স্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে, তখনও ফিজ়িয়োথেরাপির সাহায্য লাগে।
কোন পদ্ধতিতে সুরাহা
ফিজ়িয়োথেরাপিস্টরা মূলত দু’টি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে থাকেন। ইলেকট্রো-ফিজ়িয়ো এবং এক্সারসাইজ় ফিজ়িয়ো। প্রথমটির ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইস যেমন আলট্রা সাউন্ড, টেনস, আইএফটি প্রভৃতি দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করা হয়, দ্বিতীয় পদ্ধতির ক্ষেত্রে থেরাপিস্টরা অনেক সময়ে রোগীকে এক্সারসাইজ় দেখিয়ে দেন। তার পর রোগী সেই মতো করতে থাকেন। এটা বেসিক থেরাপির মধ্যে পড়ে। অ্যাডভান্সড থেরাপিতে ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট নিজের হাতে অনেক রকমের ব্যায়াম করান রোগীকে। ইন বিটুইন জয়েন্ট মুভমেন্টস, ইন বিটুইন স্কিন অ্যান্ড মাসল, মাসল স্টিফনেস— এগুলো থেরাপিস্ট নিজে করান।
সমস্যা হলে ফিজ়িয়োথেরাপিস্টের কাছে যাই ঠিকই। কিন্তু আগে থেকে সাবধান হলে কিছু সমস্যা এড়ানো যায়। লাইফস্টাইলের কারণে অনেক সমস্যা হয়। দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ হলে থেরাপিস্টের কাছে যেতে পারেন। পশ্চার কারেকশন ও বেসিক ব্যায়াম তাঁদের সুস্থ রাখবে। কমবয়সিদের জুতো বাছাইয়ে সতর্ক হতে হবে। ভাল কোম্পানির আরামদায়ক জুতো পরবেন। হিল জুতো পরে বেশি হাঁটাহাঁটি ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। শরীর সুস্থ-সচল রাখতে ফিজ়িয়োথেরাপিস্টরা নিয়মিত হালকা এক্সারসাইজ়ের পরামর্শ দেন।