শীতকাল এবং আমরা। ছবি: সংগৃহীত
সে এক শীতকাল ছিল আমাদের। আমাদের গ্রামে একখানা খ্রিস্টান পাড়া থাকত, যিশু ‘খিসটের’ জন্মদিনে গান বাজত এক সপ্তাহ টানা। খ্রিস্টান কাদের বলে চিনতাম না আমরা। কিন্তু দত্তদের চিনতাম। দত্তবাড়ি থেকে সেই জন্মদিনে বেকারির কেক দিত এক টুকরো। আমরা লাইন দিয়ে কেক খেতাম বছরের সেই এক বার। আনন্দে নাক টানতে টানতে টো টো করতাম দিনকে দিন। ভরা ঠান্ডায় পাশের বাড়ির লতিফ আর আমরা দু’ভাই, ন্যাংটো হয়ে স্নান করতাম মাতলা, ইছামতী কিংবা বিদ্যাধরীতে। গামছা দিয়ে পুঁটি আর কুচো মাছ ধরে আমাদের মাছ খাওয়া হত। তার পর ঘিয়ে রঙের শাল গায়ে এক দিন ইস্কুলের বলাইবাবু, নিখিল স্যার অথবা কমল স্যারেরা ছাত্র খুঁজতে বাড়ি বাড়ি আসতেন। নিজেদের পয়সায় কমলালেবু আর ডিমের লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে যেতেন ইস্কুলে। দু’কোয়া কমলার লোভে আমরা ইস্কুলে যেতাম। আমাদের এক ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত ক্লাস এইটে। আর এক ভাই অদ্ভুত ভাবে ফার্স্ট হতাম। বংশে প্রথম বার আমরা ইস্কুল ফাইনাল পাস করতাম।
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
আমরা কয়েকজন পড়াশোনা করতে আসতাম কলকাতা। আমরা কয়েকজন অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে পড়তাম, মাঙ্কি টুপি আর মাফলার পরে। আমাদের বাবারা কঠিন চোয়ালে চুপ করে থাকতেন। মায়েরা দশ টাকা হাতে গুঁজে দিতেন লুকিয়ে। আমরা কলকাতা শহরে আসতাম হদ্দ গ্রাম থেকে । কেউ ট্রেনে ট্রেনে দাঙ্গা করে, কেউ সিঙ্গুর থেকে বাসে, কেউ কাকদ্বীপ থেকে নৌকায়। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমরা আসতাম এক বুক গনগনে আগুন নিয়ে, অরণির মতো। সঙ্গে আমাদের তিলা পড়া জামা, রিফু করা সোয়েটার, ঘামের আর ভিড় ট্রেন থেকে গায়ে মেখে নেওয়া ছানার জল বা মাছের আঁশ গন্ধ, গলার ভাঁজে শুকিয়ে ময়লা হয়ে যাওয়া সস্তার স্নো পাউডার, জুঁই ফুলের গন্ধের চুলের তেল। শীতকালে চামড়া উঠত ঠোঁটে, আমাদের মায়েরা জোর করে বাড়ির অর্ধেক ফুরিয়ে যাওয়া বোরোলীন ভরে দিতেন ব্যাগে। চামড়া উঠতে উঠতে রক্ত বেরোত, তবুও বোরোলীন বার করা হত না।
কলকাতা শহর স্বীকার করত না আমাদের। অচ্ছুত আমাদের কেউ কেউ মেসে থাকতাম, কেউ হস্টেলে। তেল বাঁচাতে রান্নায় ভাত আর আলু ঘি দিয়ে মেখে নিতাম একসঙ্গে। কনকনে জলে স্নান করে আমাদের ঠান্ডা বসত বুকে, সঙ্গে হাপরের মতো আওয়াজ। তবুও আমরা ধোঁয়া খাওয়া ধরতাম। কফ আর রাগ জমত পাল্লা দিয়ে। অল্প দিনেই বিরোধ উঠত চরমে। আমরাও উঠে পড়ে লাগতাম। পায়ে পা দিয়ে বলতাম ভাষার অধিকার চাই, বড়লোকের সঙ্গে এক পাটিতে বসার অধিকার চাই, পদবির মুখে চুনকালি দেওয়ার অধিকার চাই— আরও কত কী! আমরা তখন শুধু সম্ভাবনা দেখতাম, ওই একই সম্ভাবনায় বিশ্বাস করতে চেয়ে কাটত আমাদের মতো কত নামহীন অজস্র অবুঝের বেলা, আমাদের সেই ঘোর পুরুষজন্ম। ততদিনে আমরা দ্রোহের স্বপ্ন নিয়ে ‘নাম’ হয়ে ওঠার আশায় পেরিয়ে আসতাম কত কত ডাকনাম, গ্রাম, বাড়ি, মায়ের হাত, আম গাছের ছায়া, কালবৈশাখী-হ্যারিকেন দিন।
তার পর এক শীতে আমরা প্রেমে পড়তাম। বড়লোকের মেয়েদের। আমরা শিল্প চিনতাম তাদের হাত ধরে। অ্যাকাডেমি, নন্দন, ময়দান ঘুরে আমাদের রাগ আর নালিশ ক্রমশ বদলে যেত স্বপ্নে। লেপের আরামে অঞ্জন-লেনন-ডিলান আমাদের ভাল লাগতে থাকত। আমরা টিউশন পড়িয়ে টাকা জমাতাম, ইস্ত্রি করা জামা প্যান্টে ‘ইন’ করে প্রথম বার বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটে যেতাম। বুর্জোয়া আদবকায়দা অল্প অল্প ভাল লাগতে শুরু করত আমাদের। শীতে প্রথম বার ঠোঁট চিনতে শিখতাম। এর পর এক দিন আমাদের প্রেমিকারা বাড়িতে নেমন্তন্ন করত। জাঁকজমক দেখে সঙ্কোচে কুঁকড়ে যেতাম আমরা। নাম-ঠিকানা বলতে গিয়ে তোতলাতাম। তার পর বেরোনোর সময় পাশের ঘর থেকে ফিসফিসিয়ে ভেসে আসত, “এ সব ছোটলোকের বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশার দরকার নেই।”
তীব্র ঠান্ডাতেও গরম হয়ে উঠত কান। রাত কাটত ফুটপাথে হেঁটে হেঁটে। আমরা দোষারোপ করতাম, প্রথমে একে অন্যকে, তার পর নিজেকে। তার পর আমরা কয়েকজন একে অন্যকে বিশ্বাসঘাতক ঠাওরাতাম। মুষলপর্বে কাকে নিয়ে অভিমান করতাম, কাদের উপরে করতাম, আমাদের মনে পড়ত না। আমরা ভুলে থাকতাম। আমরা ভুলে যেতাম।
আমরা বাড়ি ফিরতাম না সারা বছর, এক শীত গিয়ে আর এক শীত আসত। হঠাৎ করে খবর আসত বাবাদের শ্বাসকষ্টের। ওই এক দুপুরে আমাদের আচমকা বয়স বেড়ে যেত। বাবার অসুখ-দিদির বিয়ে-বোনের পড়াশোনা-সংসারের দায়িত্বে আমাদের ঠান্ডা ফুরিয়ে আসত। লেপ, বিরহ, বিপ্লব ছেড়ে আমরা চাকরি খুঁজতে বেরোতাম। রঙিন আলো, সুখের গান, কেকের গন্ধ পাশ কাটিয়ে যেতে শিখতাম। ফিরতে ইচ্ছে করত না রাতে। রাস্তার পাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখা রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে বসে আগুনের দিকে তাকিয়ে আমরা রাত কাটাতাম। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, রাতে কী খান ওঁরা? জানতে চাইলে মশকরা করে ওঁরা বলতেন, ‘ঠান্ড’।
এখন অনেক দিন পর আরও একটা শীতকালে দাঁড়িয়ে আছি। বছরখানেকের চেষ্টায় আমাদের চাকরি হয়েছিল একটা। মোটা মাইনের। এতটাই, যে আজকাল কারও সাহস হয় না মুখের উপর ‘ছোটলোক’ বলে ডাকার। এখন আমাদের সন্তানরা স্পষ্ট করে চেনে বড়দিন, এখন গিজারের গরম জল ছাড়া আমাদের স্নান করতে বেশ অসুবিধা হয়। এখন আমাদের সন্তানদের আমরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াই। আমাদের সন্তানদের স্কুলের ফি, আমাদের বাড়ির কাজের লোক কাকলি, রত্নার মা কিংবা মালতিদের মাইনের তিনগুণ ভেবে আমাদের খানিক আত্মশ্লাঘা হয়। আজকাল আমাদের আর শীতে রোজ রোজ ব্রেকফাস্টে কমলালেবুর রস, ডিম সিদ্ধ খেতে ভাল লাগে না।
শেষ কয়েক বছর বড়দিনে আমরা কেউ সপরিবার পার্ক স্ট্রিটে যাই, কেউ উল্লাস করি ছাদে কিংবা বৈঠকখানার হলুদ আলোতে। খাবার বুক করা থাকে অগ্রিম। দামি স্কচ ছাড়া এখন আমাদের নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন কল্পনা করাই মুশকিল। বোরোলীন, মাঙ্কি টুপি দেখলে হাসিতে ফেটে পড়ি মশকরায়। চামড়ার শীতপোশাক ছাড়া এখন আমাদের ঠান্ডা আটকায় না। এখন আমরা ঠান্ডায় আধবোজা চোখে মৃদু গিটার কিংবা য়ুকুলেলে শুনি।
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
এই উদ্যাপনের মধ্যে অবশ্য তাল কেটে যায় মাঝে মধ্যে। এত প্রগাঢ় আনন্দের শীতে হঠাৎ হঠাৎ টিভিতে খবর দেখতে দেখতে আমাদের চোখে পড়ে যায় কয়েকটি খ্রিস্টান পাড়ায় নাকি বাচ্চাদের বড়দিনে কেক খাওয়াতে গিয়ে গণপিটুনি খেয়েছে কয়েকজন লতিফ। লতিফ! আমাদের কিছুটা স্মৃতি ফিরে আসার রোগ দেখা দেয়। একটা নদীর কথা মনে পড়ে। কিন্তু কী যেন নাম? মাতলা, বিদ্যাধরী না ইছামতী ঠিক মনে পড়ে না।
আবছা মনে পড়ে সে এক শীতকাল ছিল আমাদের— ‘কলেজ স্ট্রীটের গায়ে কাকদ্বীপ, ডালহৌসির গায়ে তেলেঙ্গানা, আর রাজভবনের সামনে চট্টগ্রাম’।