ফাইল চিত্র।
ফিরে আসার আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে ফের বাড়ছে করোনা। বঙ্গে দৈনিক করোনা আক্রান্তের লেখচিত্রই বলে দিচ্ছে, ধারাবাহিক ভাবে তা ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতিতে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দিলে তা উপেক্ষা করার প্রবণতা ছাড়তে হবে বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘আমার তো করোনা হয়নি— এক শ্রেণির মানুষের এ রকম ভাবার প্রবণতাই বড় বিপজ্জনক। কারণ, ওই সমস্ত মানুষের একটা বড় অংশের অসচেতনতাই অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।’’
ধীরে ধীরে হলেও রাজ্যে যে করোনা বাড়ছে, তার প্রমাণ মিলতে শুরু করছিল জুনের গোড়ার দিক থেকেই। এখন অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সেই সংখ্যাবৃদ্ধির গতি ক্রমবর্ধমান। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৯ জুন (১০ জুনের বুলেটিনে প্রকাশিত) রাজ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০৭। তৃতীয় ঢেউয়ের পরে নতুন করে ফের দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছিল সে দিন থেকেই। তার মাত্র ১২ দিন পরেই সেই সংখ্যা ৪০০-র ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। ২০ জুন (২১ জুন প্রকাশিত) রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০৬।
একই ভাবে সংক্রমণের হার বা পজ়িটিভিটি রেট-ও ঊর্ধ্বমুখী। দৈনিক করোনা পরীক্ষায় কত জন আক্রান্ত, তার আনুপাতিক হিসাবই হল এই পজ়িটিভিটি রেট। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ধীর গতিতে হলেও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে, আর তাতেই বোঝা যাচ্ছে যে, পজ়িটিভিটি বেশি। যেমন, ৯ জুন রাজ্যে পজ়িটিভিটি রেট ছিল ১.৩৯ শতাংশ। পরের ১২ দিনে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৭৪ শতাংশে (২০ জুনের হিসাব)।
আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগেরই উপসর্গ মাঝারি। তবে সেই জ্বর, সর্দি-কাশি হলে এখনও হোম আইসোলেশনে থাকার নির্দেশিকা সারা বিশ্বে জারি রয়েছে বলেই জানাচ্ছেন সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজ রায়। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ ভাবে সকলকে পরীক্ষা করাতেই হবে, তেমন না-ও হতে পারে। কিন্তু কোমর্বিডিটিতে আক্রান্ত এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা করাতেই হবে। তবে জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলে সচেতন হয়ে নিজেকে কয়েক দিন বাড়িতে আলাদা করে রাখাই বাঞ্ছনীয়। তাতে অন্যের ঝুঁকি কমবে।’’
বহু রোগী এখনও চিকিৎসা করাতে এসে কিছুতেই জ্বরের কথা বলতে চাইছেন না বলে জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। তিনি বলেন, ‘‘গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা, দুর্বলতা নিয়ে যে সব রোগী আসছেন, তাঁদের বার বার জিজ্ঞাসা করার পরে স্বীকার করছেন যে, দিন কয়েক আগে জ্বর ছিল। কিন্তু প্রথমেই সেটা বলতে নারাজ। কোভিড নিয়ে এখনও মানুষের মধ্যে এমন সঙ্কোচ থাকা কাম্য নয়।’’
তাঁর মতে, জ্বরে আক্রান্ত হলেই করোনা, ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। কয়েক দিন অপেক্ষা করে দেখার প্রবণতা সবার আগে ছাড়তে হবে। কারণ, ওই অপেক্ষা-পর্বে সকলের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে সংক্রমণ ছড়ানোর মারাত্মক আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। উপসর্গ থাকলেও ন্যূনতম নিয়ম না মানার নেপথ্যে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করছে বলেই মনে করছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার।তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিষেধক নিয়েছি, তাই আর করোনা হবে না— একাংশের এই ধারণা মারাত্মক ভুল। আর সেই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে কিছু মানুষ জ্বর-সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত হলেও পরীক্ষা করাতে চাইছেন না। এমনকি, বাড়িতে ন্যূনতম আলাদা থাকাতেও তাঁদের প্রবল অনীহা।’’ আর এই অনীহাই কোমর্বিডিটিতে আক্রান্ত কিংবা বয়স্কদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে বলে জানাচ্ছেন অরুণাংশুবাবু।
খুব বেশি সংখ্যায় না হলেও, মাঝারি উপসর্গে আক্রান্তদের অনেকের আচমকা শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার ঘটনাও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অনির্বাণ বলছেন, ‘‘আমার কিছু হয়নি, এই ভাবনা নিয়ে উপসর্গকে উপেক্ষা করার ফল হিসেবেই কয়েক দিন পরে এমন ঘটনা ঘটছে। যেটা বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’
চিকিৎসকদের একাংশ এ-ও জানাচ্ছেন, বিগত বছরগুলিতে দীর্ঘ লকডাউনের পরিস্থিতি কাটিয়ে এখন জনজীবন স্বাভাবিক। বহু জায়গাতেই বাড়ি থেকে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেখানে আবার করোনায় আক্রান্ত হলে আদৌ ছুটি মিলবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সংশয়ে রয়েছেন। যদিও চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘করোনা ধরা পড়লে সাত দিন বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার দরুণ কর্মক্ষেত্রে ছুটি পাওয়ার সরকারি নির্দেশিকা এখনও জারি রয়েছে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।