জ়ার দ্বিতীয় নিকোলাসের ছেলের ভারি অসুখ। এক বার রক্তপাত শুরু হলে বন্ধই হতে চায় না। প্রচুর ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েও লাভ হল না। বলা হয়, রাসপুটিন এসে নাকি রাজপুত্র আলেক্সেই-র সেই রোগ সারিয়েছিলেন। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাকে। এক সময়ে ইউরোপের বহু রাজপরিবারের সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হতেন। শোনা যায়, ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার ছেলে লিয়োপোল্ডই নাকি পড়ে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান। সাধারণ মানুষ এই অসুখকে বলত ‘রাজরোগ’। অসুখটি, ‘হিমোফিলিয়া’।
হিমোফিলিয়া কী?
হেমাটোলজিস্ট শর্মিলা চন্দ্রের কথায়, ‘‘মানুষের শরীরে রক্ত তরল আকারে বয়ে চলেছে সারা ক্ষণ। কোনও কারণে কেটে গেলে, কিছু ক্ষণ পরে ওই কাটা জায়গায় রক্তটা জমাট বেঁধে যায়। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় ১ থেকে ১২ ফ্যাক্টর প্রোটিন কাজ করে। এ ছাড়া আরও প্রোটিন রয়েছে। এদের কোনওটির অভাবে রক্তক্ষরণের রোগ হতে পারে (ব্লিডিং ডিসঅর্ডার)।’’
হিমোফিলিয়া একটি ব্লিডিং ডিসঅর্ডার। এই অসুখে আক্রান্তদের শরীরে কোথাও কেটে গেলে কিছু ক্ষণ পরে ক্ষত জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধে না, রক্তক্ষরণ হতে থাকে। সাধারণত রক্তে ‘অ্যান্টি হিমোফিলিক গ্লোবিউলিন’ না থাকলে মানুষ হিমোফিলিয়ার শিকার হন। ছোট করে একে ‘এএইচজি’ বা ‘ফ্যাক্টর ৮’-ও বলে। আবার ফ্যাক্টর ৯-এর অভাবেও হিমোফিলিয়া হয়। ডা. চন্দ্র বললেন, ‘‘৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হিমোফিলিয়ার জন্য দায়ী ফ্যাক্টর ৮-এর অভাব (হিমোফিলিয়া এ)। মাত্র ১৫ শতাংশ-এর কাছাকাছি ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর ৯-এর অভাবে এই রোগ হতে পারে (হিমোফিলিয়া বি)।’’ খুব বিরল ক্ষেত্রে অন্য কোনও প্রোটিনের অভাবে হিমোফিলিয়া হতে দেখা যায়।
এটি জিনবাহিত রোগ। সব মানুষের মধ্যেই এক্স ক্রোমোজ়োম থাকে। মেয়েদের মধ্যে থাকে দুটো এক্স ক্রোমোজ়োম। আর ছেলেদের একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজ়োম। এক্স ক্রোমোজ়োমে ত্রুটিযুক্ত জিনের ফলে হিমোফিলিয়া হয়। কোনও ছেলে যদি বংশগত ভাবে ত্রুটিযুক্ত জিন পায়, তা হলে তার হিমোফিলিয়া হবে। আর কোনও মেয়ের একটি এক্স ক্রোমোজ়োমে এই ত্রুটিপূর্ণ জিন থাকলে সে হবে ‘হিমোফিলিয়া ক্যারিয়ার’ বা বাহক। পরে তার পুত্রসন্তান হলে সে হিমোফিলিয়ায় ভুগবে। কন্যাসন্তান হলে সে হবে বাহক। তাই একে বলা হয় ‘এক্স লিঙ্কড ডিসঅর্ডার’।
রোগ নির্ণয়
শিশু হাঁটতে শিখছে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেল। রক্ত জমে ফুলে গেল হাঁটুটা। দেখা গেল, হাঁটুটা তেমনই ফুলেই রয়েছে। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, কান্নাকাটি করছে শিশুটি। পরে এই জমাট রক্তের কারণে শিশুটির ওই জয়েন্টে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের নানা ধরনের জয়েন্টের বিকৃতি দেখা যায়। ডা. চন্দ্রের কথায়, ‘‘কেটে গেলে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না, পড়ে গিয়ে জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা হল, মাথায় আঘাত লেগে মাথা ফুলে গেল, সেই ফোলা কমতে অনেক সময় নিল— এ সবই হিমোফিলিয়ার লক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে হেমাটোলজিস্টের কাছে রক্ত পরীক্ষা করতে দেন। প্রাথমিক পরীক্ষাতেই দেখা যায়, রক্ত জমাট বাঁধছে না। তার পরে ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ অ্যাসে (এক বিশেষ ধরনের রক্তপরীক্ষা) করালেই বুঝতে পারা যায়, শিশুটির হিমোফিলিয়া আছে কি না।’’
নানা ভাগ
এই রোগের বিভিন্ন গ্রেড আছে— সিভিয়ার (রক্তে ১ শতাংশেরও কম ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ রয়েছে বা হয়তো নেই-ই), মডারেট (রক্তে ১-৫ শতাংশ ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ রয়েছে) আর মাইল্ড (রক্তে ৫ শতাংশের বেশি ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ রয়েছে)। যাঁরা সিভিয়ার গ্রেড-এ পড়েন, তাঁদের হিমোফিলিয়ার লক্ষণগুলি জন্মের কিছু পর থেকেই দেখা যায়। আর যাঁরা মাইল্ড, তাঁদের সে ভাবে ধরা না-ও পড়তে পারে। হয়তো কোনও অস্ত্রোপচারের সময়ে দেখা গেল তিনি এই রোগের শিকার।
রক্তক্ষরণের জায়গা
ডা. চন্দ্র বললেন, ‘‘আমাদের শরীরে যে জয়েন্টগুলির ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে, যেমন ধরুন হাঁটু, গোড়ালি, কনুই ইত্যাদি... সেখানে কিন্তু আঘাত বেশি লাগে। আর সেখানেই রক্তক্ষরণ বেশি হতে পারে। যাঁদের সিভিয়ার হিমোফিলিয়া থাকে, তাঁদের ছোটবেলায় দাঁত বেরোনোর সময়েই রক্তক্ষরণ হতে পারে। কখনও আবার খুব সামান্য আঘাতে রক্ত জমাট বেঁধে জায়গাটা ফুলে যেতে পারে।’’
কী করা উচিত, কী নয়
ডা. চন্দ্রের পরামর্শ, যে সব ওষুধ রক্ত তরল করে, সেই ধরনের ওষুধ খাওয়া চলবে না। বিশেষত অ্যাসপিরিন বা অন্য ধরনের পেনকিলার জাতীয় ওষুধ একেবারেই নয়। এই সব ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
হিমোফিলিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে শারীরিক কসরত করাটা জরুরি। বিশেষত সাঁতার কাটা। সাঁতার পেশি শক্ত করে, ফলে জয়েন্টগুলি আঘাত সহ্য করতে পারে বেশি। কিন্তু তা হলেও চোট লাগতে দেওয়া যাবে না। তাই কোনও ধরনের কনট্যাক্ট স্পোর্টস, যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, হকি খেলা চলবে না। জিমে গেলে হাল্কা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ় করা যেতে পারে, কিন্তু ভারী জিনিস একেবারে তোলা যাবে না। প্রথম চোট লাগা অবস্থায় ক্ষত জায়গায় বরফ ঘষতে হবে। এতেও না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
যেহেতু রোগটা বিরল, তাই হিমোফিলিয়ার রোগীদের সব সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। সরকারি, বেসরকারি যে হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগ রয়েছে, তার তথ্য কাছে থাকলে ভাল। নিজের কাছে রাখতে হবে হিমোফিলিয়া কার্ড। কী অসুখ, কোন ব্লাডগ্রুপ, কী গ্রেডে রয়েছে হিমোফিলিয়া ইত্যাদি তথ্য থাকবে কার্ডে। যাঁরা সিভিয়ার হিমোফিলিয়ার রোগী, তাঁদের নিয়মিত ভাবে রক্তে ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ রিপ্লেস (ইনজেকশন দিয়ে) করলে তারা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এই চিকিৎসাকে বলা হয় ‘প্রোফাইল্যাক্টিক ট্রিটমেন্ট’। অনেক সময়ে সিভিয়ার রোগীদের ফ্যাক্টর ৮ দিলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা শরীরে সমস্যা তৈরি। এটা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
রক্তক্ষরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী, ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ ইনজেক্ট করে রক্ত বন্ধ করতে হবে। আগে এই প্রোটিন প্লাজ়মা থেকে তৈরি করা হত, এখন তা গবেষণাগারেই তৈরি হয়। এই চিকিৎসা বেসরকারি হাসপাতালে বেশ খরচসাপেক্ষ। অনেক সময়ে সরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা কম খরচে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী, সরকারের পক্ষ থেকেই ব্যবস্থা করা হয়।
অনেক সময়ে রোগীদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রয়োজনে নিজেদের ইনজেকশন দেওয়ার প্রক্রিয়াটির। আর কোনও শিশুর অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হলেই অভিভাবকদের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে এমনটাই মত ডা. চন্দ্রের।