খাতাভর্তি লাল দাগ। অজস্র বানান ভুল বা হরফগুলি উল্টো করে লেখা...
দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়ার স্কুলের এমন খাতা দেখলেই অভিভাবকেরা মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। রেগে হয়তো জোর বকুনি দেন সন্তানকে। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র বা ছাত্রীর এমন খাতা হলে, সেটা চিন্তার বিষয় ঠিকই। কিন্তু রাগ দেখিয়ে বা বকুনি দিয়ে এই সমস্যা মিটবে না, বরং আরও বাড়বে।
সমস্যার নাম লার্নিং ডিজ়এবিলিটি। পড়া, লেখা, অঙ্ক সমাধান বা একাধিক নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে শিশুদের সাধারণত এই সমস্যা হয়ে থাকে। অভিভাবকেরা প্রথমে হয়তো বুঝতে পারেন না বা বুঝতে পারলেও মানতে চান না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অভিভাবকদের একাংশ এই বিষয়টি মানতে চান না। তাঁদের মনোভাব, ‘আমার ছেলে বা মেয়ে স্লো লার্নার হতেই পারে না।’ আবার আর এক শ্রেণি বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের চিন্তা করে ফেলেন। কোনওটাই কাম্য নয়।’’ পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, ‘‘গুরুতর সমস্যা না থাকলে, লার্নিং ডিজ়এবিলিটিস কিন্তু সাময়িক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওটা কমে যায়। তবে অভিভাবকদের অসীম ধৈর্য রাখতে হবে।’’
কয়েকটি গোড়ার কথা
ব্রিটেনে ‘লার্নিং ডিজ়এবিলিটিস’ বলতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বোঝায়। কিন্তু এখানে যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেটা হল স্পেসিফিক লার্নিং ডিজ়এবিলিটি। এর সঙ্গে আইকিউ বা বুদ্ধ্যঙ্কের (ইন্টালিজেন্স কোশেন্ট) সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ উচ্চ আইকিউ সম্পন্ন এক শিশুরও এই সমস্যা হতে পারে।
দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে পাঠরত কোনও শিশুর লিখতে বা পড়তে সমস্যা হলে, তা চিন্তার বিষয়। কিন্তু প্লে-স্কুলে পাঠরত কোনও শিশুর এই সমস্যা হলে যে সেটা ডিজ়এবিলিটি, তা সব সময়ে না-ও হতে পারে। বয়সের চেয়ে বেশি পরিণত বিষয় দিয়ে তাকে ভারাক্রান্ত করে তুলতে চাইলে, সে শিখতে চাইবে না। আবার অনেক শিশুর প্রথম পর্যায়ে হয়তো সমস্যা ধরা পড়ে না। যত ক্লাস বাড়তে থাকে, তখন হয়তো তার সমস্যা বাড়ছে।
শিশুর সমস্যা বোঝার উপায়
আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘সাধারণত এই সমস্যার সঙ্গে ইমোশনাল বিহেভিয়ার বা আচরণগত সমস্যার সম্পর্ক রয়েছে। সন্তানের অন্য রকম আচরণ দেখেই প্রথম অভিভাবকেরা বিষয়টি খেয়াল করেন।’’ স্কুলে যেতে অনীহা, লেখাপড়ায় ভয় পাওয়া, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার (এডিএইচডি)—এই বিষয়গুলির কারণ খুঁজতে গিয়ে ধরা পড়ে, হয়তো সেই শিশুর লিখতে বা পড়তে সমস্যা হচ্ছে বলেই এমন আচরণ সে করছে। এই বিষয়গুলি পরস্পর সম্পর্কিত। অর্থাৎ যে শিশুর লিখতে সমস্যা হচ্ছে, তার হয়তো ভাষাগত সমস্যাও রয়েছে। গুছিয়ে একটি বাক্যে সে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না।
পরিসংখ্যান শাস্ত্রে বিভিন্ন স্কেল রয়েছে এই সমস্যার গুরুত্ব পরিমাপের। কোন বয়সে কতটা শেখা স্বাভাবিক, তার নিরিখে শিশুর সমস্যা বোঝার চেষ্টা করা হয়।
পেরেন্টিংয়ের পথ দেখিয়ে দিলেন বিশেষজ্ঞরা
• ফ্রি ফ্লোয়িং রাইটিং: তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এই সমস্যার লক্ষণ দেখা যায়। পাঁচ বছরের পরে বেশি প্রকট হয়। এই শিশুদের টানা অনেক বেশি লেখানো যাবে না। তারা লিখবেও না। স্কুলের বাঁধাধরা জায়গায় লিখতে না বলে, ওর মতো করে ওকে লিখতে দিন। রং করতে গিয়ে বর্ডারের বাইরে বেরিয়ে গেলে বকুনি দেবেন না। শেখার ইচ্ছেটা যেন চলে না যায়।
• পোমোদরো টেকনিক: শিশুদের পড়াশোনার জন্য ৫০ মিনিট ধার্য হয়। নাগাড়ে তারা পড়বেই না। তাই এই পঞ্চাশ মিনিটকে প্রথমে ২৫ মিনিট, ৫ মিনিটের বিরতি, ১৫ মিনিট, ৫ মিনিটের বিরতি... এই ভাবে ভাগ করে নিতে হবে।
• ভিসুয়াল ইমপ্যাক্ট: লার্নিং ডিজ়এবিলিটির সমস্যা থাকলে শিশুদের ছবি দেখিয়ে পড়ানো খুব কাজে দেয়।
• ইন্টার্যাকটিভ লার্নিং: খুব ছোট বয়স থেকেই শিশুরা এখন স্মার্টফোনে অভ্যস্ত। এই ধরনের শিশুদের যত বেশি স্মার্ট ফোনে অভ্যস্ত করা হবে, তাদের শেখার হার তত কমবে। কারণ স্মার্টফোন একমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা। শিশু পরপর স্ক্রোল করে ভিডিয়ো দেখে যাচ্ছে। ওকে কোনও নির্দেশ ফলো করতে হচ্ছে না। স্মার্টফোন দিতে হলে, ইন্টার্যাকটিভ লার্নিং প্রোগ্রামগুলির সঙ্গে পরিচয় করান।
• ইনডোর গেমস: ব্লক বিল্ডিং, পাজ়ল সলভিং এই ধরনের গেমস খেললে শিশুর স্প্যাশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বাড়ে। জ্যামিতিক নকশা করা বা সমস্যা সমাধানের পথ বার করার মতো শিক্ষাগুলির অনুশীলন হয়।
• প্রফেশনাল সাহায্য: সন্তানের যখন এই সমস্যা রয়েছে তখন তার অভিভাবকদের ‘পিয়ার প্রেশার’-এ ভুগলে চলবে না। নিজে যদি ধৈর্য রাখতে না পারেন, তবে সময় থাকতেই স্পেশ্যাল এডুকেটর বা রেমেডিয়াল থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়া জরুরি।
• ওষুধ নির্ভর চিকিৎসা: এডিএইচডির ওষুধ দেওয়া হয়। এই ওষুধ দেওয়ার পরে অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে, শিশুর পড়াশোনার মান উন্নত হয়েছে। খুব ছোট বয়সের শিশুর ক্ষেত্রে তার পেডিয়াট্রিশিয়ান অনেক সময়ে সমস্যা বুঝতে পারেন। তিনি তখন হয়তো সাইকোলজিক্যাল হেল্প নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
মনে রাখতে হবে, সময় থাকতে সজাগ হলেই লার্নিং ডিজ়এবিলিটিস নিরাময় করা সম্ভব। আপনার স্নেহের পরশেই শিশু তার বাধা অতিক্রম করতে পারবে।
মডেল: রোমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: শুভদীপ সামন্ত
লোকেশন: ক্লাব ভর্দে ভিস্তা, চক গড়িয়া