স্কুলের এক্সকারশনে গিয়ে, হোটেলের ঘরে দরজা বন্ধ করে দল বেঁধে মদ্যপান এবং বন্ধু-বান্ধবীরা ‘ঘনিষ্ঠ’ অবস্থায় থাকার অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছিল শহরের এক নামী স্কুলের নবম শ্রেণির আট ছাত্রছাত্রী। পরে জানা গিয়েছিল, বাড়ির ফ্রিজ থেকেই পানীয় নিয়ে গিয়েছিল তারা। বহিষ্কৃত সেই ছাত্রের বাবা-মায়ের প্রশ্ন, দোষ কার?
স্বচ্ছল পরিবারের, পড়াশোনায় ভাল, শান্ত স্বভাবের ছেলেটা যে মনে মনে কী কঠিন পরিকল্পনা করছে, তা আধ ঘণ্টা আগেও বুঝতে পারেননি বাবা-মা। বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে অষ্টম শ্রেণির ওই পড়ুয়ার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল রাতে। তখন আর অবকাশ নেই প্রশ্ন করার, অবকাশ নেই আফশোস করার। অসহায় বাবা-মায়ের প্রশ্ন, দোষ কার?
যথেষ্ট শাসনে ও আদরে বড় হওয়ার পরেও ‘হাতের বাইরে’ বেরিয়ে গিয়েছে ষোলো বছরের মেয়ে। নিজের পছন্দের এতটুকু এ দিক-ও দিক হলেই রাগ-অভিমান-চিৎকার-জেদ-হুমকি। বাবা-মায়ের গায়ে হাত তুলতেও আটকায় না কখনও কখনও। বিধ্বস্ত কৈশোর সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত বাবা-মা আজ মনোবিদের দ্বারস্থ। তাঁদেরও প্রশ্ন, দোষ কার?
এমন নানাবিধ প্রশ্ন ও সমস্যা নিয়ে, পার্ক সার্কাসে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল মনোবিদদের সংগঠন ‘সংস অব মাইন্ড’ এবং ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির পশ্চিমবঙ্গ শাখা। রবিবার সন্তানের ভাল-মন্দ এবং সন্তানপালনের ঠিক-ভুল নিয়ে চলল আলোচনা, প্রশ্ন, বিতর্ক। পেশাদার মনোবিদদের পাশাপাশি বক্তব্য রাখলেন অভিভাবকেরাও।
সন্তানপালনের কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশিকা হয় না। কিছু সাধারণ ঠিক-ভুলের কাঠামো সমাজে খাড়া থাকলেও, তা সব ক্ষেত্রে কার্যকরী হয় না। তা শিখে নেওয়ার সুযোগও হয় না বহু বাবা-মায়ের। এক জন সন্তানের মতোই বাবা-মাও বড় হন, অভিজ্ঞ হন, ভুল করতে করতেই শেখেন।
এই প্রসঙ্গেই মনোবিদ প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য জানালেন, সন্তানপালন আসলে ‘কোচিং’-এর মতোই। প্রশিক্ষকের কাজ যেমন শিক্ষানব শের ক্ষমতা ও চাহিদা বুঝে ধীরে ধীরে তাকে শেখানো এবং তার মধ্যে থেকে সেরাটা বার করে আনা, বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও তেমনটাই জরুরি। ‘‘অনেক সময়েই দেখা যায়, বাচ্চা অত্যন্ত শান্ত, কোনও কিছু নিয়েই অসুবিধার কথা জানাচ্ছে না। তার মানে কিন্তু এই নয়, সন্তানের কোনও সমস্যা নেই। মৌনতা সব সময়ে সম্মতির লক্ষণ নয়। তাই শুধু সন্তানের মুখের কথা দিয়ে নয়, তার আচরণ, হাসি, মন খারাপ— সব দিয়ে তাকে বোঝার দায়িত্ব বাবা-মায়ের,’’ বললেন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের শিক্ষক পৃথা মুখোপাধ্যায়ও জানালেন, সন্তানকে ভাল রাখা বা শান্ত রাখার অর্থ শুধুই উপহার-উৎসব নয়। কী করলে কী মিলবে জাতীয় শর্ত দিয়ে দিনের পর দিন শিশুর থেকে সেরাটা আদায় করে নেওয়ার অভ্যেস পরে বিপদ ডাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘সন্তান কোন বয়সে কতটা পারবে, সেই বোঝাপড়াটা দরকার। উপহারের বিনিময়ে দিনের পর দিন তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল ‘আদায়’ করার অভ্যেস বিপজ্জনক। একটা সময়ের পরে এই পদ্ধতি ব্যর্থ হতে বাধ্য। নানা মানসিক সমস্যা হতে পারে এর থেকে।’’
কিন্তু শিশুর চাহিদা ও ক্ষমতা বুঝে তাকে সেই মতো পরিবেশ দেওয়া বা়ঞ্ছনীয় হলেও, তা সব সময়ে সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ইদানীং ছোট পরিবারে বাবা, মা দু’জনেই চাকরিজীবী হওয়ায় সন্তানের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় একাকীত্ব। সময় দিতে না-পেরে অপরাধবোধে ভোগেন বাবা-মাও। পরিবারে স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব ঘটে। প্রভাবিত হয় শৈশব। এবং সময় দিতে না-পারার ঘাটতি পোষাতে বেড়ে চলে উপহারের স্তূপ।
মনোবিদ প্রশান্ত রায় আবার বললেন সেই বাবা-মায়েদের কথা, যাঁরা সন্তানকে ব়ড় করার লড়াইয়ে ক্লান্ত। বিপর্যস্ত কৈশোরের মুখে দাঁড়িয়ে যাঁরা প্রতিনিয়ত সহ্য করেন দুশ্চিন্তা এবং আশপাশের মানুষের গঞ্জনা। ‘‘সন্তানের ভাল-খারাপের মতোই জরুরি, বাবা-মায়ের ভাল থাকাও। সন্তানের সমস্যা সামলাতে গিয়ে নিজেদের অবহেলা করা কারও জন্যই বাঞ্ছনীয় নয়।’’