— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ডেন্টিস্ট্রির প্রথম শাখা বলে চিহ্নিত করা হয় অর্থোডন্টিকসকে। অর্থাৎ, দাঁতের স্ফুরণ, চলন বা গড়নে সমস্যা এলে তার যথাযোগ্য চিকিৎসা। শুধু অর্থোডন্টিক্সই নয়, ডেন্টোফেশিয়াল অর্থোপেডিকসও এর অন্তর্গত, যেখানে মুখের সার্বিক গড়ন ঠিক করার উদ্দেশ্যে চিকিৎসা করা হয়। অর্থোডন্টিকসের ইতিহাস প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো।
সমস্যার উৎপত্তি
জেনেটিক ফ্যাক্টর থাকেই। তা ছাড়া ডেভেলপমেন্টাল ইসুর কথাও বললেন চিকিৎসকেরা। যেমন ছোট বয়সে প্যাসিফায়ার খাওয়ার অভ্যেস, পেন্সিল কামড়ানো কিংবা আঙুল চোষার অভ্যেস... সব মিলিয়ে মিশিয়েই আঁকাবাঁকা দাঁত ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
অর্থোডন্টিক ট্রিটমেন্ট কী?
জন্মসূত্রে বা বাহ্যিক পরিবেশগত কারণে অনেকেরই আঁকাবাঁকা দাঁত ওঠে। প্রাথমিক ভাবে ব্রেস অর্থাৎ তারের সাহায্যে তা ঠিক করা হয়। সমস্যা জটিল হলে ওরাল সার্জনের সাহায্যও নিতে হতে পারে। লাগতে পারে পেরিয়োডন্টিস্টদেরও, যাঁরা মাড়ি বা হাড় সংক্রান্ত সমস্যা ঠিক করেন।
দীর্ঘ সময় ধরে এই চিকিৎসাপদ্ধতি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন আধুনিক সরঞ্জামের সাহায্যে সহজ হয়েছে চিকিৎসাপদ্ধতি। অর্থোডন্টিস্ট ডা. প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, এই মুহূর্তে ইন্ডিয়ান অর্থোডন্টিক সোসাইটি যে আপ্তবাক্য মেনে চলে, তা হল— উই আর দ্য স্মাইল কিপার্স টু দ্য নেশন। অর্থাৎ এখন অর্থোডন্টিস্টদের চিকিৎসাক্ষেত্রের পরিধি শুধুই আঁকাবাঁকা দাঁত ঠিক করা নয়। সার্বিক ভাবে মুখমণ্ডলে ঝলমলে হাসি, ব্যালান্সড স্মাইল ফিরিয়ে আনাই তার প্রধান লক্ষ্য।
চিকিৎসার ইতিহাস
ফাদার অব অর্থোডন্টিক্স বলা হয় এডওয়ার্ড অ্যাঙ্গলকে। এই আমেরিকান ডেন্টিস্ট প্রকৃতিদত্ত দাঁত না তুলে চিকিৎসা করারই পক্ষপাতী ছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর ছাত্র, আর এক নামী অর্থোডন্টিস্ট চার্লস টুইড দন্তচিকিৎসার এই বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু বদল আনেন। নীচের সামনের দাঁতের গড়নকে প্রাধান্য দিতে বলেন তিনি। দাঁতের নীচের পাটির বেসের সঙ্গে লোয়ার ইনসাইজ়ার দাঁতটির কৌণিক মাপ ৯০ ডিগ্রি হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি। জ-লাইনের গঠনের সঙ্গে দাঁতের সজ্জা নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় এই সময় থেকে।
দাঁত তুলে ফেলে চিকিৎসা
গোড়ার দিকে যেমন দাঁত না তুলে চিকিৎসার কথা বলা হয়েছিল, তার পরবর্তী কালে শুরু হল দাঁত তুলে ট্রিটমেন্ট করা অর্থাৎ এক্সট্র্যাকশন ট্রিটমেন্ট। ‘‘সাধারণত মিডলাইন থেকে চার বা পাঁচ নম্বর দাঁত তুলে ফেলে বাকি দাঁতে ব্রেস পরিয়ে তা আগুপিছু করে সেট করার চল শুরু হল। উপরের আর নীচের পাটির দাঁত একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে সজ্জিত থাকে। হিসেব করে তা না তুললে ঠিক মতো সেট হবে না দাঁত,’’ বললেন ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়।
— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ব্রেসের হরেক রকম
আশির দশক থেকে ব্র্যাকেট বা ব্রেসের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠল। অর্থাৎ তার বেঁকিয়ে বেঁধে দাঁতগুলিকে আগুপিছু করে তার সেটিং ঠিক করা। আগে এই তার বেশি বাঁকাতে হত, দাঁতগুলিকে ধরে রাখার জন্য। ক্রমে সেটা কমিয়ে দেওয়া গেল। তারের উপকরণেও এল বদল। স্টেনলেস স্টিলের পরে জনপ্রিয় হল বিভিন্ন আধুনিক অ্যালয়ের ব্রেস। স্টেনলেস স্টিলে বেশি ফোর্স দরকার হত। এখন কপার, নাইটাই বা টিএমএ ওয়্যারে তা অনেক কম লাগে।
সেলফ লাইগেটিং ব্রেসের ব্যবহারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আগে ইলাস্টিক ব্যান্ড দিয়ে তারটাকে ব্রেসের সঙ্গে আটকানো হত। এখন প্রত্যেক ব্রেসের একটা করে দরজা থাকে। ওয়্যারটা ভিতরে দিয়ে ডোরটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর সুবিধে হল, আর্চটাকে ট্রান্সভার্সলি বাড়ানো যায়। ওরাল হাইজিনও ভাল থাকে। এখন নন-এক্সট্র্যাকশন পদ্ধতিতে, অর্থাৎ দাঁত না তুলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার চেষ্টা করা হয়।’’
শুধু ব্রেস নয়, এখন নানা ধরনের অ্যালাইনারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্লাস্টিক অ্যালাইনার অনলাইনে কিনে অনেকে নিজেরাই ব্যবহার করা শুরু করে দেন। ব্যবহারের শুরু আর শেষের ছবি দেখিয়েই এ ধরনের অ্যালাইনারের বিক্রি বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করাই ভাল।
গজদাঁতের ক্ষেত্রে
এক্সপ্যানশনের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে। জ-এর বেসাল বোন একই থাকে। গজদাঁত মিডলাইন থেকে তিন নম্বর দাঁত। উপরের পাটিতে সেন্ট্রাল ইনসাইজ়ার আর ল্যাটেরাল ইনসাইজ়ারের পরের ক্যানাইনটি যদি ওঠার জায়গা ঠিকমতো না পায়, তবে তা গজদাঁতের আকার নেয়। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘প্রাইমারি ডেন্টিশন থেকে পার্মানেন্ট ডেন্টিশনে যাওয়ার সময়ে, উপরের ক্যানাইন শেষের দিকে ওঠে। যদি চোয়ালের মাপ আর দাঁতের মাপ না মেলে, তা হলে ক্যানাইন জায়গা পাবে না ঠিক মতো ওঠার। উপরের পাটিতে আটকে যায়, কিংবা তালু দিয়ে বেরোয়। জায়গার অভাব থাকলে ওরাল সার্জনরা দাঁতটা এক্সপোজ় করবে, অর্থোডন্টিস্টরা সেই জায়গা তৈরি করে দেবে।’’
সময় ও সচেতনতা
অর্থোডন্টিক ট্রিটমেন্টে সময়টা বড় ফ্যাক্টর। সাধারণত এক-দেড় বছর লাগে এই ট্রিটমেন্টে। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করলেন, ‘‘ধরা যাক, আমার কাছে কোনও ১২-১৩ বছরের ছেলে বা মেয়ে এল চিকিৎসার জন্য। দু’বছরে তার চিকিৎসা শেষও হয়ে গেল। যদি তার দাঁত তুলে চিকিৎসা করা হয়, তা হলে বোন লস, টুথ মাস লস হবেই। তখন তা সেই রোগীর ফেশিয়াল অ্যাস্থেটিক্সকে বড়সড় ভাবে এফেক্ট করবে। যখনই বয়স বাড়বে, তখনই সেটা বোঝা যাবে বেশি করে।’’
দাঁত তুলে ফেলে চিকিৎসা করা এখন অনেক কমে গিয়েছে। শুধু দাঁতের গড়নই নয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় মাড়িকেও। দাঁত ও মাড়ির মধ্যে যোগসূত্র পাতলা পেরিয়োডন্টাল লিগামেন্ট। এটা যদি ঠিক থাকে, যে কোনও বয়সে এই অর্থোডন্টিক ট্রিটমেন্ট করানো যায়। তবে বিদেশে এ নিয়ে সচেতনতা বেশি। তাই দুধের দাঁত থেকে স্থায়ী দাঁত ওঠার সময়েই র্যাপিড প্যালেটাল এক্সপ্যানডার ব্যবহার করে দাঁতের গড়ন ঠিক করার ব্যাপারটি সুনিশ্চিত করেন অনেকে। ‘‘স্বাভাবিক জ-গ্রোথ না হলে, এই এক্সপ্যানডারের কাজ হল যে নতুন স্থায়ী দাঁতগুলি বেরোতে চলেছে, তার জন্য আগে থেকেই জায়গা তৈরি করে দেওয়া,’’ বললেন ড. বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে তিনি এ-ও মনে করিয়ে দিলেন, এখনকার সেলফি-নির্ভর প্রজন্ম আগের চেয়ে নিজেদের ‘লুক’, ‘স্মাইল’ নিয়ে অনেক সচেতন। তাই অর্থোডন্টিস্টদের কাছে এখন সময় থাকতেই চিকিৎসা করাতে আসেন। আধুনিক পদ্ধতিতে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে এই চিকিৎসাপদ্ধতি।
মডেল: অনন্যা দাস,
ছবি: জয়দীপ মণ্ডল