Health

জীবনের ছন্দে যেন না পড়ে Pause

মেনোপজ় একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন। এর মানে কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়া নয়। মেনোপজ়ের পরেও সুস্থ জীবনযাপন সম্ভবমেনোপজ় নারীজীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। ঠিক যেমন বয়ঃসন্ধিতে ঋতুস্রাব শুরু হয়, তেমনই নির্দিষ্ট বয়সে এই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ ০০:২৭
Share:

বেশ কয়েক দিন ধরেই ভীষণ মুড সুয়িং হচ্ছে পঞ্চাশোর্ধ্ব চন্দ্রিমার। তাঁর স্বামী ভাবছিলেন, স্ত্রীকে নিয়ে হয়তো কোনও সাইকায়াট্রিস্টের দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে তাঁরা বুঝতে পারলেন সমস্যা মনের নয়, শরীরের। মেনোপজ়ের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।

Advertisement

মেনোপজ় নারীজীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। ঠিক যেমন বয়ঃসন্ধিতে ঋতুস্রাব শুরু হয়, তেমনই নির্দিষ্ট বয়সে এই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়টাই মেনোপজ়। অনেকের জীবনে মেনোপজ়ের সময়ে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু মেনোপজ়ের পরেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। কী ভাবে, জেনে নিন...

Advertisement

মেনোপজ় কখন হয়?

একটা বয়সের পরে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, ওভারি ডিম্বাণু উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়, শরীরের ইস্ট্রোজেন হরমোনের লেভেল কমতে থাকে। এই সময়টাই মেনোপজ় হিসেবে চিহ্নিত। ভারতীয় মহিলাদের মেনোপজ়ের সময়টা সাধারণত ৪৮ থেকে ৫০-এর আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। তবে কারও যদি চল্লিশের আগেই মেনোপজ় হয়, তা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কিছু ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল মেনোপজ়ও হয়। কোনও অসুখের কারণে ইউটেরাসের সঙ্গে ওভারি বাদ দিতে হলে সার্জিক্যাল মেনোপজ় হয়। সে সময়ে শরীর সুস্থ রাখতে হরমোনাল ট্রিটমেন্ট করার দরকার পড়ে।

মেনোপজ়ের লক্ষণ

• বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি পৌঁছলে পিরিয়ডসের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পিরিয়ডস অনিয়মিত হতে শুরু করে। অনেকের হেভি ব্লিডিংও হয়। অনেকের আবার এক মাস ধরে অল্প অল্প করে ঋতুস্রাব হতে পারে।

• এ ছাড়াও হট ফ্লাশ, অনিদ্রা, বুক ধড়ফড় করার মতো নানারকমের সমস্যা দেখা দেয়।

• অনেকের মুড সুইং করে। তখন তিনি অস্বাভাবিক রেগে যান বা সব ব্যাপারেই বিরক্তি প্রকাশ করেন।

• তার সঙ্গেই ত্বক কুঁচকে বলিরেখা পড়তে শুরু হয়। কারও আবার চুল উঠতেও শুরু করে।

• ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেসও হয় অনেকের। শারীরিক সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

• জয়েন্ট ও মাসল পেন শুরু হয়।

তবে প্রত্যেকের জীবনেই মেনোপজ়ের অভিজ্ঞতা আলাদা হয়। উপরোক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে দু’একটি করে লক্ষণ সকলেরই প্রকাশ পায়। তবে কারও ক্ষেত্রে তা সামান্য, কারও আবার সিভিয়র।

পেরিমেনোপজ়

এ সময়ে ধীরে ধীরে মেনোপজ়ের লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করবে। অনিয়মিত ঋতুস্রাব এর মধ্যে অন্যতম লক্ষণ। মেনোপজ় শুরু হওয়ার বছর সাতেক আগে থেকেই এই লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। এই সময় থেকেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।

কোনও চিকিৎসা প্রয়োজন?

স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মেনোপজ়ের সময়ে মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ কমে যায়। তার জেরে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। অস্টিয়োপোরোসিস দেখা দিতে পারে। খেয়াল করে দেখবেন, এখন যাঁদের বয়স সত্তর-আশির কোঠায়, তাঁদের অনেকেই হাঁটুর ব্যথায় ভোগেন। হাড়ের সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এইচআরটি করিয়ে নিলে বয়সকালে হাড় ও হার্টের সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আগেকার দিনে হরমোন ট্রিটমেন্টের এত চল ছিল না বলেই আমাদের দেশের বয়স্ক মহিলারা হাড়ের সমস্যায় এত ভোগেন।’’

এইচআরটি কী?

মেনোপজ়ের সময়ে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট ট্রিটমেন্টের (এইচআরটি) মাধ্যমে শরীরে ইস্ট্রোজেনের জোগান বজায় রাখা হয়। শরীর যদি যথেষ্ট পরিমাণে প্রোজেস্টেরন ও টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদনে অক্ষম হয়, তখন এই দুই হরমোনও সরবরাহ করা হয় এইচআরটির মাধ্যমে। ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরনের ভারসাম্য বজায় থাকলে শরীরের অনেক সমস্যার মোকাবিলা করাও সহজ হয়। যেমন শুধু ইস্ট্রোজেন হরমোন দেওয়া হলে অনেকের ক্ষেত্রে তা ইউটেরাসের লাইনিং মোটা করে দেয়। এতে ব্লিডিং বাড়তে পারে। তাই প্রোজেস্টেরন ট্যাবলেট দেওয়া হয়, ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। কিন্তু কারও যদি হিস্টেরেক্টমি করানো থাকে, সে ক্ষেত্রে শুধু ইস্ট্রোজেন-এইচআরটি করা হয়ে থাকে।

মেনোপজ়ের সময় থেকে অনেকের শারীরিক সম্পর্কের চাহিদা কমে যায়। তখন টেস্টোস্টেরন দেওয়া হয়। এতে সেই মহিলা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

তবে এইচআরটি শুরু করার আগে এই চিকিৎসার শর্ট-টার্ম (পরবর্তী পাঁচ বছর) ও লং টার্ম (পাঁচ বছরের বেশি) সুবিধে ও ঝুঁকির ব্যাপারে জেনে নিতে হবে।

সুবিধে, অসুবিধে

এইচআরটির সুবিধে হল মেনোপজ়ের সাইড এফেক্টস কমিয়ে দেওয়া। শরীরে যেহেতু হরমোনাল পরিবর্তন দেখা দেয়, তা ব্যালান্স করে এইচআরটি। সুতরাং হরমোনের ইমব্যালান্সের জন্য হট ফ্লাশ, খারাপ মুড ইত্যাদি সমস্যার সুরাহা হয়। মহিলাদের হাড়ের সুরক্ষাও দেয়। কার্ডিয়োভাসকিউলার ডিজ়িজ় কম হয়। ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘এইচআরটির ফলে পরবর্তী কালে এন্ডোমেট্রিয়াল ও ব্রেস্ট ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। তবে তা খুব সামান্য। পোস্ট-মেনোপজ়াল মহিলাদের মধ্যে ১০০০ জনের মধ্যে এক জনের ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। আর বছর পাঁচেক কম্বাইনড এইচআরটির ফলে ১০০০ জনে ১৫-২০ জনের মধ্যে এই আশঙ্কা দেখা যায়। ক্যানসারের আশঙ্কা কমাতে এখন এইচআরটি ট্রিটমেন্টে ইস্ট্রোজেনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনেক সময়ে টিবোলনও দেওয়া হয়। এটি এক ধরনের সিন্থেটিক হরমোন, যা ইস্ট্রোজেনের মতো কাজ করে। কিন্তু স্তন ও ইউটেরাসে ইস্ট্রোজেনের বিপরীত ধর্ম পালন করে। ফলে এর ব্যবহারে এই দু’ধনের ক্যানসারের আশঙ্কাও অনেকটা কমে।’’ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েই এই হরমোন ট্রিটমেন্ট শুরু করা উচিত। আর কোনও কারণে ট্রিটমেন্ট হুট করে বন্ধ করবেন না। মনে রাখতে হবে, এটি হরমোন ট্রিটমেন্ট। তাই তা বন্ধ করার আগেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ট্রিটমেন্ট শুরুর পরে কোনও সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসককে জানান।

মেনোপজ়ের পরে যত্ন

এ সময়ে অনেকেই বয়স বেড়ে যাচ্ছে বলে ভেঙে পড়েন। তার সঙ্গে শরীর ভাঙতে শুরু করে। মুখের চেহারা বদলাতে শুরু করে। সার্বিক ভাবে নিজের শরীরের এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সমবয়সি মানুষের সঙ্গে মনের কথা ভাগ করে নিতে পারেন। খুব হতাশা হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শও দেওয়া হয়ে থাকে।

মেনোপজ়ের পরে অনেকের নানা সমস্যা দেখা দেয়। তার মধ্যে স্তন ও জরায়ুতে ক্যানসারের প্রবণতা বাড়তে পারে। তাই নিয়মিত পরীক্ষা করা দরকার। যেমন ব্রেস্টে লাম্প আছে কি না, তা বাড়িতে পরীক্ষা করতে পারেন। বছরে একবার ম্যামোগ্রাফি ও জরায়ুর পরীক্ষাও করাতে হবে।

মনে রাখতে হবে, এটি কোনও রোগ নয়। বরং একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, মেনোপজ় পরবর্তী সময়ে সুস্থ থাকার জন্য ঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement