‘ফুলস প্যারাডাইস’-এর সম্ভার। ছবি: সর্বজিৎ সেন।
গড়ে বছরে কতগুলো জামা কেনা হয়? সেগুলো ক’বারই বা পরা হয়? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন তিন-চার বছর বাদে সেই পোশাকগুলো কি আদৌ পরা হয়? ফলে তা থেকে তৈরি হচ্ছে পাহাড়সমান বর্জ্য। এটাই ফাস্ট ফ্যাশনের নেতিবাচক দিক। অন্য দিকে দাম কম রাখার জন্য সিন্থেটিক ফ্যাব্রিকের ব্যবহার বাড়ছে, যা পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর।
আবার পুঁজিবাদ এমন ভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে যে, আজ যা ফ্যাশন, কাল তা-ই হয়ে যাচ্ছে পুরনো বা ব্যাকডেটেড। আবার চার-পাঁচ বছর পরে সেই ফ্যাশনই ঘুরেফিরে আসছে। কিন্তু তত দিনে প্রত্যেকের পোশাকের সংগ্রহ পাল্টে গিয়েছে। ফলে একই জিনিস ক্রেতারা ফের কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কয়েক বছরের ব্যবধানে। কিন্তু স্লো ফ্যাশন ঠিক এর বিপরীত। এখানেই স্লো ফ্যাশন তৈরি করছে সাজপোশাকের নতুন সংজ্ঞা।
প্রদর্শিত সম্ভারে মাটির ছোঁয়া
সম্প্রতি টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা এমনই কিছু পোশাকের সম্ভার প্রদর্শন করেছিল। সেখানে যেমন ছিল প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার, তেমনই ছিল হাতের কাজে ফুটিয়ে তোলা পোশাকের নকশা। কিছু নব্য ডিজ়াইনার বেছে নিয়েছিলেন আর্দি কালার, অন্য একদল আবার পোশাক তৈরির জন্য বেছে নিয়েছিলেন অসমের গামছা বা গামোসা। পোশাকে কৃত্রিম কোনও জিনিসের ব্যবহারও করেননি তাঁরা। তার বদলে কাপড়ের টুকরো জুড়ে-জুড়েই বানিয়েছেন পোশাকের বোতাম, বেল্ট, পকেট... এমনকি পোশাকের সঙ্গে মানানসই গয়নাও। আর সেই পোশাক পরে র্যাম্পে হেঁটেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রীরা।
পোশাকে স্বচ্ছ চিন্তা
যদিও এই সম্ভার প্রদর্শন অনেকটা প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই আয়োজন করেছিলেন উদ্যোক্তারা, তবুও শো শেষে দেখা গেল প্রত্যেকেই স্বীয় সৃষ্টিতে জয়ী। প্রতিযোগিতার ফরম্যাটে অবশ্য প্রথম স্থান পেল ‘ফুলস প্যারাডাইস’ সম্ভার। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের তাঁতিরা যাঁরা গোদাবরী উইভারস নামে পরিচিত, তাঁদের হাতে বোনা কাপড়ে এই সংগ্রহ তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যেই গাঢ় রঙের ব্যবহার নজর কেড়েছে। দ্বিতীয় স্থানে ‘আর্থরুটস’। বাংলার তাঁতিদের বোনা কাপড়ে পরিবেশবান্ধব ভাবে এই পোশাকের সম্ভার সাজানো। আর তৃতীয় স্থানে ছিল ‘শ্যাবি শিক’। এই সংগ্রহে প্যাটার্ন, ফ্যাব্রিক ও টেক্সচারে মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছেন পোশাকশিল্পীরা। মুর্শিদাবাদের তাঁতিদের তৈরি কাপড়ে কান্ট্রি-কটেজ থিমে ডিজ়াইন করেছেন তাঁরা। আবার পোশাকের উপরে এমবেলিশমেন্টও রয়েছে, মূলত বর্জ্য থেকেই তা আপসাইকল করে তৈরি। একই সঙ্গে পুরনো ও সমসময়ের চিন্তা ধরা পড়ে এই সম্ভারে।
এ ছাড়াও অসমের গামছা বা বিহুয়ানও ব্যবহার করা হয়েছে পোশাকে। ‘নটিকাল’ নামের আর একটি পোশাকের সম্ভারে আবার সমুদ্রযাত্রার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণত জাহাজে ক্যাপ্টেনদের যে ইউনিফর্ম দেখা যায়, তা থেকেই খানিক অনুপ্রাণিত এই পোশাকের সংগ্রহ। ফ্যাশন যেমন স্রোতের মতো এক দিক থেকে আর এক দিকে বয়ে চলেছে, ঠিক সেই ধারাটাই যেন ধরা পড়েছে এই সংগ্রহে। আর ছিল মিশমিশে কালো ‘র্যাভেন’ কালেকশন। ‘গেম অব থ্রোনস’ভক্তদের এই ভাবনা বুঝতে সময় লাগবে না। গল্পগাথায় র্যাভেন অনেক সময়ে এই নশ্বর জগতের সঙ্গে আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলের কালা কটন দিয়েই তৈরি হয়েছে এই পোশাক। পোশাকের রং ও তার কাট যেন সেই গল্পগাথার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে বাস্তবের সৃষ্টিশীলতাকে। অন্য দিকে ‘ভিন্টেজ কালেকশন’-এ আবার তুলে ধরা হয়েছে উনবিংশ শতকের কলোনিয়াল পোশাক। খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এখানে ঔপনিবেশিক ও দেশজ পোশাকের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে।
পোশাকশিল্পের নতুন ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা ও পরিশ্রমের ফসলই সে দিন তুলে ধরার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক পোশাকের পিছনের গল্পে দেখা মেলে তাঁদের গভীর চিন্তাভাবনার।