বর্ষবরণের ফুর্তি কি একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শনি মন্দিরের পাশে ডিজে বক্স। বাঁশের খুঁটিতে বেলুন, রঙিন কাগজের শিকল, চকচকে কাগজের ফুলের তোড়া। সন্ধে থেকেই তোড়জোড়। মন্দিরের কয়েক কদম দূরের ক্লাবঘরের বারান্দায় মহা হান্ডায় বগবগিয়ে ফুটছে মাংস। মুরগি নয়, মটন। তন্দুরি রুটি বানাতে কারিগর আর বিশেষ উনুন এসেছে। রাত বাড়ছে। ক্লাবঘরে হাতছিপ্পু কড়া পানীয়ের নিপ। ক্লাবের খুদে মেম্বারদের রুটি-মাংস খাইয়ে বিদেয় করার পরেই খোলা হবে বড় বোতল। ফুলটুস মস্তি। ১০টা থেকেই ডিজে। ১১টায় উড়ান… শুধু তরল নয়… আরও কিছু… তার পর ১১টা ৫৫ থেকে উলটি গিনতি। জিরো আওয়ারে দোদমা, হাউই, চকোলেট— সব রেডি।
এ দৃশ্য শুধু শহর কলকাতা নয়, উপকণ্ঠ, মফস্সল, মায় গ্রাম পর্যন্ত একই। ইংরেজি নববর্ষের ছাঁদটা সম্ভবত সারা ভারতেই একই রকম। পাড়ার বালক সংঘ থেকে অভিজাত ক্লাব, অফিস পার্টি, গঙ্গাবক্ষে প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, পাহাড়চূড়ায় কার্নিভাল— সর্বত্র ছবিটি হালকা ফারাক বাদ দিলে একই রকম। বাঙালির নববর্ষ দুটো। পয়লা বৈশাখে বাবু সেজে সম্প্রসারিত পরিবার (আসলে স্রেফ শ্বশুরবাড়ি) নিয়ে পাঞ্জাবিতে মাঞ্জা দিয়ে বেঙ্গলি ব্যুফে— ডাব-চিংড়ি, রসমালাই আর থার্টি ফার্স্ট নাইট থেকে ফার্স্ট জানুয়ারি হালকা ‘বে-আদবি’, ঈষৎ স্খলিত চরণ আর বাজি ফাটানো। একটা যদি আধা-সাত্ত্বিক হয়, অন্যটা ঘোর তামসিক, একটা যদি বানিয়ে তোলা স্মৃতির (সৌজন্যে বাংলা মেগা) উদ্যাপন হয়ে থাকে, অন্যটা সামনের দিকে তাকিয়ে খানিক সুশৃঙ্খল উচ্ছৃঙ্খলতার কসরত।
জর্জ ডার্বির তুলিতে সাহেবি কলকাতার বর্ষবরণ। ছবি: সংগৃহীত।
তবে চিরদিনই কি এমন ছিল? কোলকেতা শহরের সেই সব বাবুয়ানির দিনে সাহেবপাড়ায় নিউ ইয়ার উদ্যাপনে বাঙালি অপাঙ্ক্তেয়ই ছিল বলে মনে হয়। উনিশ শতকের কলকাতার আমোদ নিয়ে লিখতে গিয়ে নকশাকার হুতোম প্যাঁচা কিন্তু সাহেবসুবোর উৎসব বা উদ্যাপনের ব্যাপারটা এড়িয়েই গিয়েছেন। হিন্দু বাঙালির রথ বা দুর্গাপুজো নিয়ে বাঁকা নজরের রসিকতা করলেও বড়দিন বা ইংরেজি নববর্ষের হুল্লোড় নিয়ে তাঁর তেমন কোনও বক্তব্য নজরে পড়ে না। সে কালের সাহেবভোগ্য নতুন বছর আর বাঙালির হালখাতার নববর্ষ একপাতে বসত না, সন্দেহ নেই। কিন্তু সাহেবপাড়ায় আমোদ তো কিছু কম ছিল না ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ারগামী সপ্তাহে। ১৮৫৭ সালে, অর্থাৎ কিনা মহাবিদ্রোহের বছরেও রীতিমতো চাপে থাকা ব্রিটিশ সমাজ যে কলকাতায় মহা ধুমধামে সপ্তাহটি কাটিয়েছিল, তার উল্লেখ রয়েছে ‘বেঙ্গল হরকরা’র মতো সংবাদপত্রের প্রথম পাতাতেই। সে কালের জাঁদরেল হোটেল উইলসনে যে সপ্তাহব্যাপী দেদার ফুর্তির বন্দোবস্ত ছিল, তা পরিষ্কার জানানো হয়েছিল। এক জন ‘লেডি’ ও এক জন ‘জেন্টলম্যান’-এর রসনা ও বাসনা তৃপ্তির জন্য সব রকমের বন্দোবস্তই যে উইলসন রাখত, তার সগর্ব উল্লেখ ছিল তাদের বিজ্ঞাপনে।
উনিশ শতকীয় সাহেবি কলকাতা নিয়ে চর্চা করেন দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়। ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার পালন বিষয়ক এক নিবন্ধে তিনি সে কালের বম্বের এক যুবাসাহেবের কলকাতায় বৎসরান্তের সপ্তাহ যাপনের ছবি তুলে এনে দেখিয়েছিলেন, লন্ডনি কেতায় চুল কাটিয়ে, দাড়ি কামিয়ে নতুন জামা-পেন্টুল, হ্যাট-কোট পরে হাভাতে সাহেবরাও মোচ্ছবে শামিল হতেন। খিদমদগারেরা ‘ব্র্যান্ডি শরাব বিলেতি পানি’র ফোয়ারা খুলে দিত, আর সাহেব তাতে চুবে চুরচুর হয়ে মধ্যরাতে ঠাকুরদা-ঘড়ির ব্যারিটোন ঢং ঢং শুনে স্খলিত গলায় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। ক্রিসমাস থেকে বয়ে আসা মোচ্ছবের সেখানেই পরিসমাপ্তি। পরের দিন পয়লা জানুয়ারি হ্যাংওভার থাকলে আলিস্যি আর গড়িমসি করে কাটিয়ে তার পরের দিন থেকে যাও সব নিজ নিজ কাজে।
আমোদ-ফুর্তির রাত বড়ই গুলজার! ছবি: সংগৃহীত।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে? না কি এই পরম্পরার মধ্যে কোথাও ছেদ ছিল? পঞ্চাশের দশকের ক্লাব কালচারে অভ্যস্ত বাঙালি এতখানি না হলেও সাহেবি কেতার অনুসরণেই নিউ ইয়ার পালন করতেন। ষাটের দশকে শহর থেকে দূরের শিল্পাঞ্চলের কলোনি, কি অফিসার্স ক্লাবে একটু পালন-জুলন হত, আম পাবলিক তাতে খুব বেশি লিপ্ত হত না। সত্তরের দশকের ফুটপাথ বদল হওয়া মধ্যরাতের হৃদিকমলে ফুর্তির ধুম লাগত কি না জানা যায় না। কারণ, সে বড় সুখের সময় ছিল না, আনন্দের সময় ছিল না। কিন্তু আশির দশকে আপাতত শান্তিকল্যাণের জমানা শুরু হলে কলকাতার জাঁকালো হোটেল আর ক্লাবগুলিতে যে সেই ‘ব্র্যান্ডি শরাব বিলেতি পানি’র ফোয়ারা ছুটত, তার সাক্ষ্য দিলেন অমিতাভ সরকার। ফ্রন্ট অফিস ম্যানেজার হিসাবে দীর্ঘ কাল চাকরি করেছেন গ্র্যান্ড হোটেলে। সেই সময়ে টেলড কোট আর ভারিক্কে চশমায় অমিতাভবাবু যেন ‘চৌরঙ্গি’র স্যাটা বোস। আপাতত অবসরপ্রাপ্ত। সে দিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা আর মায়াবী রাতের প্রসঙ্গ তোলায় খানিক আনমনা হলেন বোধ হয়। জানালেন, গ্র্যান্ডের বলরুমে এক সময় নিউ ইয়ার্স ইভ পালনে দেদার নাচাগানার বন্দোবস্ত হত। বিদেশ থেকে নর্তকীরা আসতেন। ১৯৮৬-৮৭ নাগাদ লাতিন আমেরিকার কেতায় সালসা নাচের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মোচ্ছবে অংশগ্রহণকারীরা প্রায়শই বেলাগাম হয়ে বিবিধ গোলমাল বাধাতে থাকায় এক সময়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় বলরুমের উদ্যাপন। ফুর্তি গুটিয়ে চলে আসে রেস্তরাঁ আর পানশালায়। খানাপিনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে শুরু করে সেলিব্রেশন। কিছু পরে গ্র্যান্ডের নাইট ক্লাব ‘পিঙ্ক এলিফ্যান্ট’ চালু হলে আবার নাচগান ফিরে আসে বটে, কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল এক বিশেষ শ্রেণির যুবক-যুবতীদের মধ্যেই। সেই ‘পিঙ্ক এলিফ্যান্ট’ও অধুনালুপ্ত। নাইট ক্লাবও আজ কলকাতায় বিরল নয়।
স্মৃতিকে পিছনে হাঁটিয়ে যদ্দূর নিয়ে যাওয়া যায়, ততখানি দূরত্বে গেলে আজকের পঞ্চাশ পেরোনো প্রৌঢ়েরা মনে করতে পারবেন, দূরদর্শনের ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে আশির দশকের শেষ আর নব্বইয়ের গোড়ার দিকে আয়োজিত হত বিশেষ অনুষ্ঠান। বাঙালির একান্ত নিউ ইয়ার তদ্দিনে জাতীয় স্তরে মিশে গিয়েছে। বলিউডি গান আর স্ট্যান্ড আপ কমেডির উপকরণ দিয়ে সাজানো সেই অনুষ্ঠানে কাউন্টডাউন হত। বারোটা বাজলেই দুম ফটাস করে ঝালর-চুমকি-ফেনা উথলে উঠে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে দু’-একটা গানটান গেয়ে অনুষ্ঠানে ইতি টানা হত। মধ্যবিত্ত বঙ্গজন সেই আবেশটুকু হৃদয়নন্দনবনের নিভৃতে রেখে লেপ-কাঁথা চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
পরের দিন অবশ্য দেদার বন্দোবস্ত। এক দল ম্যাটাডরে মাইক লাগিয়ে ডায়মন্ড হারবার অথবা সবুজ দ্বীপ গোছের জায়গায় পিকনিকে যেত আর অন্য দল পয়লা জানুয়ারির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য শিরোধার্য করে দক্ষিণেশ্বর বা কাশীপুর উদ্যানবাটী-মুখো হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু উৎসবে গিয়ে মনের ভার লাঘব করার চেষ্টায় ব্রতী হতেন। ম্যাটাডোরে মাইক লাগিয়ে হু-লা-লা-লা পিকনিক পার্ট আজ শহরাঞ্চলে খানিক বিরল। পাড়ার ক্লাবেই ‘সেটিং’ ঝক্কাস। কিন্তু আধ্যাত্ম-সন্ধানীরা আজও রয়েছেন। কল্পতরু উপলক্ষে উপরোক্ত দুই স্থানেই ভিড় বেড়েছে বই কমেনি।
বিশ্বায়ন আর ‘পরিবর্তন’-এর পরের কলকাতায় অবশ্য সরকারি বন্দোবস্ত ভালই। সকল রসের ধারা গিয়ে একাকার হয়ে যায় কার্নিভালের পার্ক স্ট্রিটে। মাথার উপর আলোর চাঁদোয়া, বল্গা হরিণ আর তারায় তারায় খচিত পার্ক স্ট্রিট যেন মহামানবের মিলনক্ষেত্র এ দিন। সদর স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট জংশনে কমবেশি ছয় দশক পার করে ফেলেছে ‘ভাইব্রেশন’ নামের বিপণি। এক সময়ে পশ্চিমি গানের রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডির ব্যাপারে সে দোকান যেন ছিল অন্তিম স্টেশন। আজ গানবাজনাও মানুষের কানসই হয়ে বিনেপয়সার সামগ্রী। কিন্তু ‘ভাইব্রেশন’ তার স্পন্দন হারায়নি। মহম্মদ ইমতিয়াজ আর তাঁর বড় ভাই মহম্মদ মুমতাজের পর ব্যবসা এখন মহম্মদ শাহনওয়াজ ওরফে গুড্ডুর তত্ত্বাবধানে। শিশু বয়স থেকে গুড্ডু দেখেছেন নিউ ইয়ারের সাহেবপাড়া। তাঁর চোখে উদ্যাপন তেমন বদলায়নি। কেবল পার্ক স্ট্রিটে ভিড় খানিক বেড়েছে। সদর স্ট্রিটের অপেক্ষাকৃত কম খরচের হোটেল বা গেস্ট হাউসগুলিতে এক সময়ে ভিড় লেগে থাকত সাহেব-মেমদের। এখন বিভিন্ন কারণে সেই শ্বেতাঙ্গ-পীতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গেরাও সরে গিয়েছেন নিউ টাউন বা রাজারহাটের এয়ার বিএনবি বা রুম রেন্টের দিকে। ফলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের নিউ ইয়ারের জৌলুস প্রায় নেই। শুধু ঘর সাজানোর দোকানগুলিতে ভিড় দেখা যায় বড়দিনের আগে থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। উপকরণে সাম্প্রতিকের ছোঁয়া অবশ্যই লেগেছে। টুনি বাল্বের জায়গা নিয়েছে এলইডি লাইট। কিন্তু ফিনফিনে কাগজের ল্যাম্পশেড, কাগজ বা প্লাস্টিকের মুখোশ বা রঙিন কাগজে তৈরি শিকলের বিক্রিতে ভাটা পড়েনি। রিপন স্ট্রিট থেকে বো ব্যারাক কতিপয় খ্রিস্টান পল্লিতে আজও লেগে আছে সাহেবি কলকাতার নিউ ইয়ার পালনের ছাপ।
রাত পোহালেই কিন্তু বছর পুরনো। ছবি: সংগৃহীত।
রাত বারোটার পরে রাস্তা সুনসান। পার্ক স্ট্রিটও আস্তে আস্তে জনবিরল হতে শুরু করে। বৎসরান্তের ক্লেদ, গ্লানি, ম্লানিমা ঝেড়ে ফেলে পাড়ার ক্লাবও নিশুত। কিছু মদ্যপের স্খলিত পদধ্বনি আর প্রলাপ সম্বল করে শীতের রাত পার করে কলকাতা। আঁধারে ডুবে থাকা ভিক্টোরিয়ার পরির পাশটিতে কি ডানা মুড়ে বসেন শ্রীহুতোম? ৩৬০ ডিগ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে গোটা শহর মায় রাজ্যটিকে এক বার মেপে নিয়ে বঙ্কিম হাসি হাসেন আর মনে মনে বলেন— “হুজ্জুতে কোলকেতা আরেকটু বুড়োটে মাল্লো হে, সামনে একখান গোটা বচ্ছর। সেই তো পুনর্মুষিক আর পৌনপুনিক…! তার চে’ চলো দু’জনেই ডানা মেলি।” ক্ষয়াটে চাঁদের হিম গায়ে মেখে পরি আর হুতোম ডানা মেলেন শহরের আকাশে। সে ডানার ছায়া কে দেখল আর কে দেখল না, তাতে কিছু যায়-আসে না। পয়লা কাটলেই দোসরায় তো বছর পুরনো! ক্যালেন্ডারে কেবল পাতা উলটে যাবে।