বয়সের ভারে হতাশা বাড়ে। কিন্তু তাকে জাঁকিয়ে বসার সুযোগ দেওয়া যাবে না। আধুনিক জীবনেই সে রসদ মজুত রয়েছে। খুঁজে নিতে হবে হতাশা কাটানোর ওষুধ
Mental Health

মনের বয়স যেন না বাড়ে

বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই শারীরিক সমস্যার বাড়বাড়ন্ত, তার সঙ্গেই বাড়ছে হতাশা।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২১ ০৫:৩২
Share:

ছেলে, পুত্রবধূ, নাতিকে নিয়েই সুমিত্রার সংসার। অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও রয়েছে। তবুও হতাশা গ্রাস করছে সুমিত্রাকে। ক্রমশ যেন একাকিত্ব ঘিরে ধরছে। সংসারে অপাঙ্‌ক্তেয় মনে হচ্ছে নিজেকে।

Advertisement

অন্য দিকে বীরেনবাবুর একার সংসার। ছেলে-মেয়ে দু’জনেই বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। বহু বার ছেলে-মেয়ে নিজেদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে চাইলেও এক-দু’মাস থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। ক্রমশ যেন আরও খিটখিটে হয়ে পড়ছেন।

এই চিত্রটা এখন অস্বাভাবিক নয়। বরং এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ছবি আছে হতাশার। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই শারীরিক সমস্যার বাড়বাড়ন্ত, তার সঙ্গেই বাড়ছে হতাশা।

Advertisement

কেন বাড়ছে হতাশা?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবির মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এর পিছনে অনেক কারণ কাজ করে। প্রথমত, রোগ মানুষকে হতাশ করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এত রকম সমস্যা দেখা দেয় শরীরে, তা থেকে বিরক্তি আসে। বিশেষত মহিলাদের মেনোপজ়ের পর থেকে নানা সমস্যা শুরু হয়। হাঁটুর ব্যথা, চোখে কম দেখা, বদহজমের সমস্যা তো কমন। তার সঙ্গে অনেকেরই নানা রকম রোগভোগ থাকে। শারীরিক অক্ষমতায় অন্যের উপরে নির্ভর করার বিরক্তি। তার সঙ্গে রয়েছে একাকিত্ব। এখন অনেকের সন্তানই বিদেশে বা ভিনরাজ্যে বা জেলায় কর্মসূত্রে বসবাস করে। এক ছাদের তলায় থাকলেও মা-বাবার সঙ্গে বসে বেশ খানিকটা সময় গল্প করে, আনন্দ করে কাটাচ্ছে, এমনও তো নয়। ফলে তারা ক্রমশ একা হয়ে পড়ে। তার থেকেও হতাশা দানা বাঁধে।’’

তার উপরে প্রত্যেক মানুষই বাহবা, প্রশংসা পছন্দ করেন। ধরুন, একজন সারাজীবন চাকরি করেছেন। বিশেষ পদমর্যাদা ভোগ করেছেন। সেই সুবাদে অনেক মানুষ তাঁকে ঘিরে থেকেছে, তাঁর কাজের প্রশংসা করেছে। কিন্তু অবসরগ্রহণের পর থেকে সেই বৃত্ত ছোট হয়ে আসে। সেখানে প্রশংসা তো দূরের কথা, ন্যূনতম স্বীকৃতি পাওয়াও বেশ দুর্লভ। প্রত্যেক মানুষই স্বীকৃতি চান। কিন্তু সেটা হয়তো সব সময়ে পান না।

এর পরে রয়েছে সাংসারিক অশান্তি। কিছু পরিবারে হয়তো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আকাঙ্ক্ষিত নন। তাই নিয়ে রোজকার কলহ। একটা মানুষ প্রতি মুহূর্তে যদি বুঝতে পারেন যে, তাঁকে কেউ চাইছে না, এ দিকে তাঁর অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই— সেই অনুভূতি থেকেও অবসাদ গ্রাস করে। ডা. আবির মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘একটা বয়সের পরে হতাশা কমে না। ক্রমশ তা বেড়েই চলে। কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতাও অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে কোনও দম্পতি যদি খুব সুখী জীবন কাটান, তার মধ্যে হঠাৎ একজন চলে গেলে অন্য জন ভেঙে পড়েন। বয়সকালে একা থাকার ভয়, অনিশ্চয়তা থেকে এক ধরনের অবসাদ তৈরি হয়। আবার যাঁদের হয়তো দাম্পত্যে তেমন মিলমিশ ছিল না, তা-ও কাজেকর্মে একসঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন, তাঁদেরও কিন্তু এই বয়সে এক ছাদের তলায় থাকতে থাকতে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে যায়। তার থেকেও হতাশা তৈরি হয়। তবে এই অসুখের সুবিধে হল, এটা যার সমস্যা, সে নিজেই বুঝতে পারে। নিজের মনখারাপ হলে, তা কিন্তু বোঝা যায়। হতাশা গ্রাস করছে বুঝতে পারলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’’ তবে তাঁদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ। অনেকেই যেতে চান না। কিন্তু দরকার হলে চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। তার আগে আশপাশের মানুষেরও কিছুটা সচেতনতা জরুরি। প্রাথমিক ভাবে ওঁদের পাশে থাকার মাধ্যমেই অনেকটা হতাশা কাটানো সম্ভব।

হতাশা কাটাতে

nসংসারে বৃদ্ধ মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ি থাকলে তাঁদের সময় দিন। বিদেশে বা অন্য রাজ্যে থাকলেও এখন দূরত্বটা বাধা নয়। ভিডিয়ো বা ফোন কলে তাঁদের সঙ্গ দিন। তিনি কী খেলেন, সারা দিন কী করলেন, ছোটবেলার সুখস্মৃতির আলোচনা... এগুলো জরুরি। সুখস্মৃতি মানুষের মনে আলো দেখায়। দূরে থাকলেও কথাবার্তায় তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানো কঠিন নয়।

একটি শিশুর যেমন যত্ন দরকার, বাড়ির প্রবীণদেরও ঠিক ততটাই যত্ন দরকার। এক দিন শাশুড়ি বা মায়ের চিরুনিটা হাতে নিয়ে যত্ন করে তাঁর চুল বেঁধে দিন। দেখবেন, খুশি হবে। স্পর্শ খুব জরুরি। এই স্পর্শই তাঁদের জীবনের দিকে ফেরাবে।

প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু শখ থাকে। ধরুন, গাছ লাগানোর, বই পড়ার, সেলাইয়ের বা ভাল সিনেমা দেখার... একটু কথা বললেই সেই শখের কথা জানা যায়। সেই শখপূরণের ব্যবস্থা করুন।

উৎসাহ দিন নতুন কাজে। অনেক সময়েই বাড়ির প্রবীণ মানুষটিকে গুটিয়ে যেতে দেখা যায়। ‘তোরা যা, আমি যাব না’, ‘ওরে বাবা! আমি পারব না’... এগুলো ওঁদের মুখে খুব পরিচিত। ‘‘কথাগুলো থেকে ‘না’-টা সরানোর দায়িত্ব নিতে হবে। ধরুন, কেউ এক সময়ে খুব ভাল রাঁধতেন, এখন কনফিডেন্স পান না। একদিন বলুন, ‘তোমার হাতে পায়েস খেতে খুব ইচ্ছে করছে, তোমার মতো কেউ পারে না।’ তিনি রাঁধলে সেটা ভালবেসে খান। ‘এই তো তুমি পেরেছ’ এইটুকু আশ্বাসই তাঁদের মন ভাল রাখার অব্যর্থ দাওয়াই।’’ বললেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবির।

অনেকেই বলেন, মা-বাবা নতুন জামা-কাপড় চান না। উপহার কী দেবেন বুঝতে পারেন না। ওঁদের এমন জিনিস দিন, যাতে ওঁদের সময় কাটে। হতে পারে সেটি আধুনিক জীবনের সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু ওঁদের প্রিয়। যেমন রেডিয়ো উপহার দিতে পারেন। একটা বয়সের পরে টানা টিভি দেখলে বা বই পড়লে অনেকেরই চোখে কষ্ট হয়। রেডিয়োয় কিন্তু সেই কষ্ট নেই। বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে রেডিয়োর হৃদ্যতাও রয়েছে। গাছ উপহার দিতে পারেন। ফুল-ফল ধরলে তার যত্নেই সময় কেটে যাবে। শৌখিন ময়শ্চারাইজ়ার বা সুগন্ধি কিনে দিতে পারেন।
মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ির বন্ধুদের গেটটুগেদারের ব্যবস্থা করা যায়। ঠিক যেমন বাড়িতে সন্তানের জন্মদিনের আয়োজন করেন, ওঁদের আনন্দের জন্যও একটা দিন না হয় ওঁদের মতো করে সাজিয়ে দিন। দেখবেন, সেই এক দিনের আনন্দ নিয়েই কত দিন আলোচনা করবেন ওঁরা।

অনেকেই ঘুরতে গেলে বা রেস্তরাঁয় গেলে প্রবীণ সদস্যকে বাড়িতে রেখে যান। কখনও-সখনও ওঁদেরও সঙ্গে নিন। অনেকের খাওয়ার সমস্যা থাকে, হয়তো সব খেতে পারেন না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তিনি যে আপনাদেরও একটা অংশ, এটুকু অনুভব করানোই জরুরি।

একটি শিশু যেমন জীবন শুরুর সময়ে সাহচর্য চায়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও সেই সঙ্গসুধা চান। সেই যত্ন, সেই সময় বয়স্কদের জন্যও বরাদ্দ করুন। েদখবেন, তাঁদের কুঞ্চিত, অশক্ত হাতের উপরে আপনার হাতের স্পর্শ আবার প্রাণসঞ্চার করবে।

মডেল: ভারতী লাহা ও

অঙ্কিতা মজুমদার পাল

ছবি: জয়দীপ মণ্ডল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement