অতিমারিতে খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ বাড়াতে বলছেন চিকিৎসকেরা। অথচ বাজারে নাকি মাংসের চাহিদা ক্রমশই কমছে। প্রোটিন সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারের দিকে ঝুঁকছেন মানুষ। এর কারণ খুঁজতে চিন্তায় পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের আশঙ্কা, মানুষ কি তবে আমিষ থেকে নিরামিষাশী হয়ে উঠছেন? যদি তা-ই হয়, তবে গোটা বিশ্বের বৃহৎ এই মাংসের বাজারের কী হবে?
একদিকে যেমন চাহিদা কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তেমনই মাংসের দাম বাড়ারও প্রবণতা দেখা গিয়েছে। মাস খানেক আগেও এক কেজি মুরগির মাংস দেড়শো টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল কলকাতার বাজারে। সেই মাংসের দামই এখন প্রতি কেজি ৩০০ টাকা ছুঁইছুঁই।
কারণ হিসাবে বিক্রেতারাও জানাচ্ছেন চাহিদা কমার কথাই। তাঁদের কথায়, ‘‘মাংসের চাহিদা কমেছে। অথচ মুরগীর দেখভালের খরচ একই রয়েছে।’’ এর উপর লকডাউনে দোকানে দোকানে সরবরাহের খরচও বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি। এগুলোই দাম বাড়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন মাংস বিক্রেতাদের একাংশ।
অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের বাজার পর্যবেক্ষকদের যুক্তি, অতিমারির আগে বিয়েবাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়িতে মাসের মোট বিক্রির একটা বড় অংশ যেত। কিন্তু লকডাউনে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানও ঘরোয়া ভাবেই সারা হচ্ছে। কমেছে আমন্ত্রিতের সংখ্যাও। ফলে ৩০০-৪০০ অতিথি নিয়ে বিপুল আয়োজনের জোগান আপাতত প্রয়োজন হচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই তার প্রভাব পড়ছে মাংসের সার্বিক চাহিদায়।
মাংসের দামের এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া বা চাহিদায় ঘাটতির এই ধারা অবশ্য গোটা বিশ্বেই নজর টেনেছে বিশেষজ্ঞদের। যা নিয়ে রীতিমতো আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরাও।
বাজার পর্যবেক্ষকদের মত, মাংস খাওয়ার প্রবণতা কমছে, সেটা যেমন চিন্তার বিষয়, তেমনই আরও একটা বিষয় উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। তা হল, মানুষের মধ্যে নিরামিষ খাওয়ার প্রবণতাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মাংসের বদলে প্রোটিন সমৃদ্ধ নিরামিষ খাবার বিকল্প হিসাবে বেছে নিচ্ছেন তাঁরা।
মূলত গত এক বছরে অতিমারির সময় থেকেই এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে বাজার বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিষয়টিকে পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়েছেন তাঁরা।
সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে অতিমারীর সময় থেকে এ পর্যন্ত মাংসের বিক্রিবাটা ১২ শতাংশ কমেছে আমেরিকায়। ইউরোপে শুধু বিফ বা গোমাংসের চাহিদা গত বছর অনেকটা কমেছিল। এবছর তা আরও এক শতাংশ কমবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন বাজার বিশারদরা। এমনকি যে আর্জেন্তিনা বিশ্বের মাংসাশী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম, সেখানেও গত এক বছরে চার শতাংশ কমেছে মাংস কেনার প্রবণতা।
সংখ্যাগুলো দেখতে অল্প মনে হলেও তা না কি অর্থনৈতিক ভাবে আশঙ্কা জাগানোর মতোই। কেন না অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মাংসের বাজার হল এমন একটি বাজার, যেখানে চাহিদা কমে না। বরং মাঝে মধ্যেই বেড়ে গিয়ে রেকর্ড উচ্চতা ছুঁয়ে ফেলে। এতদিন তা উত্তরোত্তর বেড়েছেও। মাংসের দাম কমা বা বৃদ্ধি পাওয়ার সে রকম কোনও প্রভাব এতদিন পড়েনি বাজারে। কিন্তু এখন তা পড়ছে।
মাংসের চাহিদায় এই সামন্য অবনমনও তাই বেশ বিরল। অর্থনৈতিকভাবে আশঙ্কা জাগানোর মতোই।
অর্থনীতিবিদদের কথায়, অতিমারির পর থেকে তৈরি হওয়া এই প্রবণতার দু’টো কারণ থাকতে পারে। এক, মাংসের দাম বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতার অবনতি। অতিমারি অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। ফলে যে পরিবারের রাতের খাবারের থালায় নিয়মিত মাংস থাকত, তারা নিয়মিত মাংস কিনতে পারছেন না। আমিষ খেলে বেছে নিচ্ছেন অল্প দামের বিকল্প। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরামিষ বিকল্পই বেছে নিতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের।
দ্বিতীয় কারণটি বেশি চিন্তার। সার্বিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এমনও অনেকে রয়েছেন যাঁরা স্রেফ পরিবেশ সচেতন হয়েই মাংস খাওয়া বন্ধ করছেন। প্রাণি হত্যা, প্রাকৃতিক ভারসম্য নষ্ট হওয়ার মতো নানা কারণে তাঁরা সম্পূর্ণ নিরামিষাশী হচ্ছেন। এমনকি অনেক কমবয়সিদের মধ্যেও এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা চিন্তায় ফেলেছে বাজার অর্থনীতিবিদদের।
পরিসংখ্যান বলছে গত অক্টোবর থেকেই ব্রাজিল থেকে ফিলিপিন্স পর্যন্ত দেশগুলিতে মাংসের বিক্রি কমেছে। অতিমারি ও তার জেরে হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটে ডিমের মতো বিকল্প প্রোটিনও কিনতে পারছেন না অনেকে। বদলে ভাত, রুটি, ন্যুডলস দিয়েই নিরামিষে পেট ভরাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি।
অতিমারির পর থেকে আমেরিকাতেও গোমাংসের দাম ৬ শতাংশ বেড়েছে। মুরগির মাংসের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ। পর্ক বা শূকরের মাংসের দাম ১৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ৪৮ বছর বয়সি নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা ইউডেলিয়া পেনা জানাচ্ছেন, এই বিপুল দাম বৃদ্ধির কারণে মাংস খাওয়া ভুলতে বসেছে তাঁর পরিবার। অতিমারিতে কাজ হারিয়ে এখন তাঁদের পরিবারে রোজগেরে বলতে একজন। ফলে অতিমারির খাবারের জন্য তাঁরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যায় করতেন, তার অর্ধেকও খরচ করতে পারছেন না এখন। পেনার কথায়, ‘‘আগে প্রতিদিন দু’টো মুরগির মাংস আনতাম। এখন সপ্তাহে একটা মুরগির মাংস এনে সেটা অর্ধেক কেটে খরচ করি।’’
তবে পেনাদের নিয়ে বেশি চিন্তিত নন অর্থনৈতিক বিশারদরা। তাঁদের আশঙ্কা নিরামিষাশীদের নিয়ে। গত এক বছরে আমিষ না খেতে পেরে এখন বহু গ্রাহকই মাংস ছেড়ে নিরামিষ বিকল্প বেছে নিচ্ছেন। এবং তাঁরা জানাচ্ছেন, এভাবে তাঁরা আগের থেকে বেশি সুস্থ এবং ভাল আছেন।
শহরতলিতে তো বটেই লন্ডন, নিউ ইয়র্কের মতো শহরেও অনেকে বাড়ির লাগোয়া এক ফালি জায়গায় সবজি ফলিয়ে সেই সবজি খাচ্ছেন অনেকে। বাজারেও সবজি এবং প্রোটিনের নিরামিষ বিকল্পের চাহিদা ৭০ শতাংশর বেশি বেড়েছে।
বাজার নজরদার এবং পরিবেশবিদরাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। তাঁদের কথায় এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে ভাল ফলদায়ী হতে পারে না। কারণ কৃষি অনেক ক্ষেত্রে পরিবহণের থেকে বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়ায়। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই হঠাৎ করেই মাংস ছেড়ে বিশ্ববাসীর এমন ডাল-ভাতে ফেরার প্রবণতা পরিবেশের পক্ষে উপকারী না-ও হতে পারে।
অন্য দিকে, রাষ্ট্রপুঞ্জের পুষ্টি বিষয়ক প্রধান নাওকো ইয়ামামোতোর কথায়, ‘‘বিশ্বের বহু দেশে এখনও শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। প্রাণিজ প্রোটিন তাদের দ্রুত সুস্থ করতে সক্ষম। নিরামিষ প্রোটিন বিকল্প খারাপ তা বলছি না। তবে প্রাণিজ প্রোটিন এক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর। তাই প্রাণিজ প্রোটিন থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না। ’’
তবে প্রবণতা যেমনই হোক, অতিমারিই যে এর জন্য দায়ী, তা এক বাক্যে মানছেন মাংস বিক্রেতারা। বুয়েনস আইরেসের একটি এলাকার নামই হয়েছিল নুয়েভা শিকাগো। মাংস বিক্রির কেন্দ্র বলা হয় ওই এলাকাটিকে। সেখানকার এক বিক্রেতার কথায়, ‘‘অতিমারি আমাদের শেষ করে দিয়েছে। এর আগে মাসে চার থেকে পাঁচহাজার কেজি মাংস বিক্রি করতাম। এখন মাসে দু’হাজার কেজিও বিক্রি হয় না!’’
অতিমারি কি তবে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে নিরামিষাশী করে তুলবে? সময়ই বলবে। তবে তার আগেই বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কট আমাদের খাবারের অভ্যাসে পুরোপুরি বদল না ঘটনায়, সেটাই ভাবার।