— নিজস্ব চিত্র।
‘ক্রমশ একলা হলে, কমে এল সব গুঞ্জন...’
বয়স, এক আশ্চর্য সামাজিক নিয়ামক। শৈশব, কৈশোর, যৌবনে শুনতে হয়— এটাই তো বয়স! আর যৌবন অস্তরাগে ঢলে পড়লেই হাওয়া পাল্টে যায়, তখন ‘যা কিছু বয়সোচিত’-র জয়জয়কার। এমন মানুষ কিন্তু চারপাশে রয়েছেন, সমাজের এই চলনের জেরে যাঁরা অজান্তেই বৈষম্যের শিকার হন।
বয়স-বৈষম্য বা ‘এজিজ়ম’-এর অন্যতম কারণ, সমাজের পূর্বনির্ধারিত কিছু ধারণার বশবর্তী হয়ে সেই অনুসারে মানুষকে বিচার করা। সেই ধারণাগুলো কী? বয়স ৫০-এর ও পারে ঢলছে... অতএব সাজপোশাক পরিমিত, প্রেম-বিয়ে যদিও বা কষ্ট করে মেনে নেওয়া যায়, একত্রবাস বা সন্তান নৈব নৈব চ। আর এর ব্যতিক্রম হলেই কানাঘুষো ফিসফাস। যদিও এই বয়স-বৈষম্যের ধারণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বহু মানুষই নিজের ছন্দে বাঁচেন। আবার অনেকে ইচ্ছা থাকলেও বাঁচতে পারেন না।
এই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক উপল চক্রবর্তী বললেন, “আসলে পুরো বিষয়টাই পুঁজিবাদী সমাজের প্রোডাক্টিভিটির প্রশ্ন। পুঁজিবাদী সমাজের কাছে বয়স্ক মানেই তার প্রয়োজনীয়তা ও উৎপাদনশীলতা ফুরিয়েছে। নাৎসি জার্মানিতেও বয়স্কদের মূল্য ছিল না, সাম্প্রতিক কোভিডকালেও আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে শোনা গিয়েছে প্রায় একই কথা। মজার ব্যাপার হল, এই পুঁজিবাদী সমাজই আবার বয়স্কদের একটি নতুন গ্রাহক শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের কাছে বয়সকে নস্যাৎ করার উপায় বিক্রি করছে।”
অর্থাৎ শাঁখের করাত। এক দিকে পুঁজিবাদী সমাজের প্রভাবে মানুষের মাথার মধ্যে গেঁথে গিয়েছে ‘বয়সোচিত’ হয়ে ওঠার বিষয়টি। অন্য দিকে, সেই পুঁজিবাদই ৪০ বছরের ও পারের মানুষগুলোর কাছে বিক্রি করছে ‘এজ শেমিং’-কে নস্যাৎ করার টোটকা।
‘বয়স হওয়া মানেই বোধহয় স্বচ্ছতাকে বিদায় দেওয়া...?’
কর্মক্ষেত্রে একটা বয়সের পরে কোনও কর্মী নতুন কিছু শিখতে পারবেন না বলেই ধরে নেওয়া হয়। ফলে, গতানুগতিকতার বাইরে অন্য রকম কাজের ক্ষেত্রে মানুষটি হয়ে পড়েন ব্রাত্য। এই বৈষম্য কিন্তু ধীরে ধীরে আক্রান্ত মানুষটির মনোরোগেরকারণ হয়ে ওঠে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় জানালেন, সামাজিক ভাবে বা কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের বৈষম্যের শিকারে মানুষের উদ্বেগ, অবসাদ আসতে পারে। তার প্রভাব পড়ে তাঁর শরীরেও— এ এক দুষ্টচক্র। প্রথমে বৈষম্য, তাতে তিনি যখন মানসিক বা শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখন বাড়তে থাকে বৈষম্য ও অসাম্য।
প্রাবন্ধিক সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমেরিকার বেশ কিছু সংস্থায় হ্যারাসমেন্টের তালিকায় ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে এজিজ়মকে। বিগত কয়েক দশকে শিল্পোদ্যোগে কমবয়সিদের জয়জয়কার। ফলে পুরনোদের কোণঠাসা করার প্রবণতা বাড়ছে।বয়স বেশি হলে আসলে হারানোরকিছু নেই। ওটা বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্ট। এটা লোককে বোঝাতে পারলেই সমস্যা কমবে।”
এজিজ়মের প্রতিবাদে অ্যাফারমেটিভ বিহেভিয়ার কী হওয়া উচিত, তা দেখিয়ে দেওয়া একটা ভাল কৌশল। নিজের জন্য প্রতিবাদ করা ছাড়াও কেউ বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হলে প্রকাশ্যে তার প্রতি সদর্থক আচরণ করাটা জোরদার উত্তর হতে পারে। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা দূর্বা বসুর কথায়, ‘‘নতুন কিছু শুরু করার ক্ষেত্রে বয়স কোনও প্রতিবন্ধকতা হতেই পারে না। কর্মক্ষেত্রে অনেক সময়েই আমাকে আমার বয়সটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দেখেছি, যাঁরা সেটা করেছেন, তাঁরা সম্ভবত আমার যোগ্যতা মেনে নিতে পারেননি।” লিপস্টিক ও পোশাক নিয়ে নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট করেন দূর্বা। নিজের তোলা ছবির প্রদর্শনীর দিকে মন দিয়েছেন এখন।
“পড়ে আসা বেলা ওই, নয়নের আকুলতা বোঝে...?”
৪০ পার হয়ে মা হওয়ার সিদ্ধান্ত... সমাজের ফিসফাস, বিস্ময় আর উপদেশের বন্যা। আর ৫০ পার হয়ে যাওয়ার পরে প্রেম, বিয়ে... সঙ্গী বা সঙ্গিনীর বয়স অনেকটাই কম... জোটে স্রেফ কটাক্ষ ও সমালোচনা। এমনকি, সাজপোশাকে বেশি পারিপাট্য থাকলে সেটা নিয়েও হাসাহাসি হয় আড়ালে।
চলচ্চিত্র সম্পাদক ও নির্মাতা অর্জুন গৌরীসারিয়ার সঙ্গে তাঁর সঙ্গিনী ময়ূরাক্ষী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়সের পার্থক্য ৩৪ বছরের। অর্জুনের বয়স এখন ৫৯। তিনি স্পষ্ট বললেন, “আমি যত না কথা শুনেছি, তার চেয়ে বেশি কটাক্ষ, ঘৃণ্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে ময়ূরাক্ষী। আমার মা অবশ্য এই ৮৩ বছর বয়সেও বিষয়টাকে গ্রহণ করেছেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর ভাবনাচিন্তা অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা, কিন্তু মা সম্পূর্ণ নন-জাজমেন্টাল।”
বাস্তবিক, পুরুষ নারী নির্বিশেষে ‘বয়সোচিত’ না হলে বেশ বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। ৫০ পার হয়ে যাওয়া মহিলা যদি ঝলমলে রঙের শাড়ি পরেন, আধুনিক পোশাক পরেন, লিপস্টিক, নেলপলিশের রং যদি লাল-গোলাপি ঘেঁষা হয়... সামনে প্রশংসা হলেও আড়ালে চলতে থাকে কটাক্ষ। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে? ষাটোর্ধ্ব কোনও পুরুষ বডিহাগিং টি শার্ট বা উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি পরলে, বাইক চালিয়ে নিজের বয়সকে নস্যাৎ করার কথা ভাবলে, সমাজের চোখ তা নিতে পারে না। ঠারেঠোরে মন্তব্য শুরু হয়ে যায়।
কোন বয়সে মা হলে সেটি ঠিক সিদ্ধান্ত, সমাজ নির্ধারণ করে দেয় সে মাপকাঠি। যে কারণে বিয়ের পরে দম্পতির উপর চাপ আসে সন্তানধারণের, আর বিয়ে করতে না চাওয়া মেয়েটিকে কথা শুনতে হয়। ৪০ না ছুঁয়েই কবি অদিতি বসুরায়ের এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি জানান, “৩৬ বছর বয়সে মা হয়েছি। বন্ধুদের মায়েদের অনেকেই কটাক্ষ করে বলেছেন, এই বয়সে মা হচ্ছিস!”
একটু আলাদা অভিজ্ঞতা অবশ্য বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা ঈপ্সিতা সেনগুপ্তের। ৪০ পার হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মা হওয়ার, ৪১ বছর বয়সে তাঁর সন্তানের জন্ম। তিনি জানালেন, “৪০ পার হয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন। তবে, যেহেতু আমার আত্মীয় প্রায় নেই, তাই সন্তানজন্ম নিয়ে কটাক্ষের সম্মুখীন হতে হয়নি। বরং, প্রভূত সমর্থন পেয়েছি। আমার পাড়ার রিকশাওয়ালা থেকে সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব সকলে প্রায় পক্ষীমাতার মতো আগলে রেখেছিলেন। পিছনে ফিসফাস হয়তো চলেছিল, আমার সামনে কেউ কিছু বলেননি।” সেই সময় অফিস যাতায়াতের পথে মেট্রোয় একটি বিষয় লক্ষ করেন ঈপ্সিতা। তাঁকে গর্ভাবস্থায় দেখে তাঁর বয়সি বা তাঁর কাছাকাছি বয়সের মহিলারা একটু অস্বস্তিতে পড়ছেন। তাঁকে বসার আসন ছাড়ছেন না। উল্টো দিকে, কমবয়সি প্রজন্ম তাঁকে দেখলে হাসিমুখে আসন ছেড়ে দিচ্ছেন। ঈপ্সিতার কথায়, “হয়তো আমি শাখা সিঁদুর পরি না বলে এই অস্বস্তি। তবে, নতুন প্রজন্ম এই সব ব্যাপারে অনেক খোলা মনের।”
‘মুখ ফিরিয়ে ভাবব আমি কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে...’
সাজতে ভালবাসেন সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সদ্য ছবি আঁকতেও শুরু করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রত্যেকটি মানুষের চরিত্রের একটা বয়স রয়েছে। এখন একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যায় যে, প্রত্যেকেই চান তাঁকে কমবয়সি দেখতে লাগুক। এটা আসলে ধনতান্ত্রিক সমাজের ফাঁদ। মানুষ তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরিণত হন। বয়স অনুসারে তিনি মন-মানসিকতায় যে পর্যায়ে রয়েছেন, সমাজের চাপে সেটা যদি প্রকাশ করতে না পারেন, তবে সেটি তাঁর প্রতি সাঙ্ঘাতিক অবিচার। তাই এই পরিস্থিতি দেখলে নিজেদের দৃঢ় হতেই হবে।
মুখের রেখায় বয়স জমে আজব ত্রিকোণমিতি শেখাবেই। তা-ও লোকের হাসির তোয়াক্কা না করে সাধ্য, সামর্থ্য ও ইচ্ছেকে সহায় করে বয়স-বৈষম্যের সঙ্গে লড়ে যেতে হবে। তার কারণ, বারে বারে আর আসা হবে না...