শারীরিক সমস্যা নিয়ে যতটা সচেতনতা চোখে পড়ে, মানসিক স্বাস্থ্য সেখানে খানিক ব্রাত্যই বলা চলে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
মনের অসুখ নিয়ে কথা বলা সহজ নয়। বলার সুযোগ যে সব সময় মেলে তেমনও নয়। শারীরিক সমস্যা নিয়ে যতটা সচেতনতা চোখে পড়ে, মানসিক স্বাস্থ্য সেখানে খানিক ব্রাত্যই বলা চলে।
মনের অসুখ দৃশ্যমান নয়। তাই তেমন কিছুর অস্তিত্বও যে থাকতে পারে তা অনেকেই ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেন না। মানসিক অসুখ নিয়ে যাঁদের ওঠাপড়া, দিনযাপন তেমনই কিছু মানুষের সমস্যা নিয়ে সোমবার আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক ও ইউটিউবে আলোচনায় বসলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘লোকে কী বলবে! সঙ্গে অনুত্তমা’। এই পর্বের বিষয় ‘মানসিক রোগী’। স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে আন্দোলন খুব কম মানুষের দৈনন্দিন বিষয়। অল্প সংখ্যক মানুষ এই নিয়ে কাজ করেন। এই দেশে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট মুখ মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। এই পর্বে তিনি বিশেষ অতিথি ।
প্রতি পর্বের আগেই অনুত্তমার কাছে পাঠানো যাবে প্রশ্ন। এই পর্বেও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ই-মেলে তেমনই কিছু প্রশ্ন পেয়েছিলেন মনোবিদ।
ঝুমকি জানিয়েছেন, তিনি এক জন অ্যাংজাইটি-ডিপ্রেশনের রোগী। এ কথা প্রকাশ্যে বলতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু কেউ যখন এই অ্যাংজাইটির কারণ জানতে চান, তখন আর সে প্রশ্নের উত্তর থাকে না। কারণ প্রশ্নটা সহজ এবং ছোট হলেও উত্তরটা এত সহজে দিয়ে দেওয়ার মতো নয়। ৩৪ বছর ধরে জীবন কী কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়েছে তা তো একটি বাক্যে ধরা সম্ভব নয়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রায় খুন করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখেছেন চোখের সামনে। এমন বহু ঘটনা তাঁর মনের মধ্যে ট্রমা হিসাবে রয়ে গিয়েছে। কেউ জানতে চাইলে বলতেই বা হবে কেন?
আর পাঁচটি রোগের মতো মনের সমস্যাকেও যে সহজ উচ্চারণে আনতে পেরেছেন, তার জন্য ঝুমকিকে অভিনন্দন জানালেন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় এবং মনোবিদ । মাইগ্রেন বা অন্য কোনও অসুখ হলে তার কারণ কেউ জানতে চান না। কিন্তু মানসিক বিপন্নতার ক্ষেত্রে কৌতূহলের পারদ চড়ে অনেকটা। মন এবং মনের গভীরতা নিয়ে অসম্ভব কৌতূহল দেখা যায়। কিন্তু এই কৌতূহল যে, অপর দিকের মানুষকে অসুস্থতার আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে অনেক সময় খেয়াল থাকে না সে সবের। শারীরিক হোক বা মানসিক— অসুস্থতার ইতিহাস অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা কোথাও নেই। ঝুমকিকে তাই রত্নাবলী রায়ের পরামর্শ, সেই মুহূর্তে ঠিক যতটা বলতে ইচ্ছে করবে ততটাই বলা ভাল। যদি কিছুই না বলতে ইচ্ছে করে চুপ করে থাকাই শ্রেয়।
আসলে এই বিষয়গুলি নিয়ে এখনও পরিপার্শ্ব অসচেতন এবং অনেকাংশে অসংবেদনশীলও। তাঁরা কী প্রশ্ন করবেন, তা সব সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে যাঁর কাছে প্রশ্নবাণ ধেয়ে যাচ্ছে তাকেই এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে হবে। স্পষ্ট বলতে হবে, এই বিষয়গুলি নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না। ঝুমকিকে বোঝালেন মনোবিদ।
বছর ১৯-এর ঐশ্বর্য জানিয়েছেন, বাবা-মা দু’জনেই সরকারি চাকরি করেন। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া সারা দিন বাড়িতে একাই থাকতে হয়। একা থাকাই অভ্যাসে হয়ে গিয়েছে তাঁর। এখন বেশি লোকজন, শব্দ, গল্প গুজব আর ভাল লাগে না ঐশ্বর্যের। এমনকি, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতেও বিরক্তি আসে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতেও অসহ্য লাগে। ঐশ্বর্য বুঝতে পারছেন না, তিনি ক্রমশ মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কি না। যদি তেমন হয় তা হলে লোকে বা কী বলবে? আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তো?
ঐশ্বর্যের এমন আশঙ্কার জবাব দিলেন রত্নাবলী। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের নিজেদের একটু সচেতন হতে হবে। নিজেদের উপর কোনও তকমা আরোপ করব কি না। মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক রোগ এর তো বহু স্তর রয়েছে। কাজেই স্বাস্থ্য থেকে রোগে যাওয়ার পথটাও অনেকটা দূর। তার মধ্যে বিপর্যয় আছে, বিপন্নতা আছে। আমরা ঠিক কোন জায়গায় আছি, সেটা নির্ধারণ করবেন মনোবিদ। এই যে আমরা নিজেদের দাগিয়ে দিই, অন্যরা আমাদের দাগিয়ে দেন— এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসক বা মনোবিদ বলার আগেই সমাজ আমাদের নিদান দিয়ে দেয়। কিংবা নিজেরাই নিজেদের একটা তকমা দিই। এটা আসলে সঠিক সচেতনতার অভাব। তার আগে ঐশ্বর্যকে জানতে হবে যে, একা থাকতে তাঁর ভাল লাগে কি না। একা একা থাকাটা কি তাঁকে অনায়াস করে তোলে, না কি অসুবিধার মধ্যে ফেলে— এটা জানা সবার আগে প্রয়োজন।’’
একই মত মনোবিদ অনুত্তমারও। লোকে মানসিক রোগী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার আগে নিজেই নিজেকে দাগিয়ে দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অনুত্তমা বলছেন, ‘‘মানসিক অসুখ দিয়েই গোটা বিষয়টি দেখতে হবে না। একা থাকতে ভাল বোধ হচ্ছে, না মন্দ বোধ হচ্ছে, সেটা আগে দেখা জরুরি। যদি নিজেকে সকলের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে অস্বস্তি হয়, মন ভাল না থাকে সে ক্ষেত্রে কিন্তু কোনও মনোবিদ বা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।’’