বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হচ্ছে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হওয়া সমস্ত রকম টীকাকরণ। ছবি: আইস্টক।
কোভিড-১৯ অন্যান্য সঙ্কটের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যকেও এক বড় সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সব দেশের মতো আমাদের দেশেও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে রুটিন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে এমন টীকাকরণ কর্মসূচি।
বন্ধ করতে হয়েছে নিতান্ত নিরুপায় হয়েই। সাধারণ ভাবে এক জন শিশু যখন ভ্যাকসিন নিতে যায় ,সঙ্গে থাকেন বাড়ির একাধিক মানুষ। ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় একাধিক স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্যের দরকার হয়। এই পুরো কর্মকাণ্ড কখনওই ‘সোশ্যাল ডিস্টান্স’ মেনে করা সম্ভব না। আর করনা প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই এই ‘সোশ্যাল ডিস্টান্স’ বা সামাজিক ভাবে দূরত্ব রচনা। তাই বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হচ্ছে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হওয়া সমস্ত রকম টীকাকরণ।
কেন শঙ্কা?
২৬ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এক বুলেটিন প্রকাশ করে জানিয়েছে টীকাকরণ সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথা। তাদের শঙ্কা, পৃথিবীব্যাপী টীকার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়, এমন অসুখ— অর্থাৎ ভ্যাকসিন প্রিভেন্টেবল রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব আগামী দিনে মানবসভ্যতাকে গ্রাস না করে বসে! একটা সময় হয়তো করনার আগ্রাসন থেকে পৃথিবী মুক্তি পাবে, কিন্তু তখন হাম, হুপিং কাফ, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, মেনিনজাইটিস, ফ্লু-র মত মারন রোগগুলোর কাছে মানব সভ্যতা কে আবার না মাথা নত করতে হয়।
আরও পড়ুন: স্যানিটাইজার মিলছে না? হাত ধুতে এর চেয়েও ভাল বিকল্প কী?
এক জন শিশু প্রথম তার হামের ভ্যাকসিনটি নেয় ন’মাস বয়সে। এই সময় এই ভ্যাকসিনটা দেওয়ার কারণ, মায়ের শরীর থেকে পাওয়া হামের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া আন্টিবডিগুলো সে সময় একদম কমে যায়। তাই তখন বাইরে থেকে ভ্যাকসিন না দিলে বাচ্চাটির হামে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই থেকে যায়। এখন এই সোশ্যাল ডিস্টান্সিংয়ের ফলে যদি ভ্যাকসিনগুলো ঠিক সময়ে না দেওয়া যায়, তা হলে বেশ ভবিষ্যতে অনেক শিশুই এতে আক্রান্ত হবে।
এমনিতেই এই হাম রোগটি শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে একদম তলানিতে এনে হাজির করে। প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে তার ভবিষ্যতে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।
বড়দেরও ভয়?
ছোটদের সঙ্গে বৃদ্ধ মানুষদের এবং গর্ভবতী মহিলাদের যে ভ্যাকসিন এই মরসুমে ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া ভীষন জরুরি। কারণ এঁদের সকলেরই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা বেশি। করোনার রোগের লক্ষণ অনেকটাই ফ্লুর মতো। এবং ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা পৃথিবীব্যাপী খুব একটা কম নয়।
আমেরিকার ‘সেন্টার অব ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি)-র তথ্য অনুসারে ওই দেশে গত বছর অক্টোবর মাসের ১ থেকে এই বছর ২০ মার্চ পর্যন্ত— এই ছ’মাসের মধ্যে ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩৪-৫৪ লক্ষ। আর এই রোগে মৃত্যু হয়ছে প্রায় ২৪-৬২ হাজারের। এমন রোগের যদি ভ্যাকসিন যদি না দেওয়া যায়, তবে তাও আর এক মৃত্যুমিছিল তৈরি করতে পারে।
আরও পড়ুন: মোবাইলেও ঘাপটি মেরে থাকে করোনাভাইরাস, কী ভাবে ব্যবহার করলে দূরে থাকবে অসুখ?
এক জন শিশু প্রথম তার হামের ভ্যাকসিনটি নেয় ন’মাস বয়সে।
ভ্যাকসিন কেন অসম্ভব?
বেশির ভাগ ভ্যাকসিন তৈরি হয় বিদেশি কোম্পানিগুলোতে। লকডাউনের ফলে অন্য দেশের সঙ্গে এবং নিজের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গেও এখন যোগাযোগ করা খুব মুশকিল। লোকজনের অপ্রতুলতা ও জিনিসপত্র সরবরাহে সমস্যা হওয়ায় কমে গিয়েছে ভ্যাকসিনের উৎপাদনও। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও বেশ কিছু দিন পর পর্যন্ত ভ্যাকসিন জোগানের অপ্রতুলতা থাকবে।
সমস্যা বাড়ছে যেখানে
আমাদের দেশের প্রত্যেক শিশুকে ভ্যাকসিনেশন দেওয়া হয় নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট মেনে। সরকারি ব্যবস্থায় দেওয়া হয় ‘ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম’ (UIP)-এর নির্ঘণ্ট মেনে। বেসরকারি ভাবে শিশুচিকিৎসকরা সাধারণত দেন ইন্ডিয়ান অ্যাক্যাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স (IAP)-এর নির্ধারিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী। কিন্তু এক-দু’মাসের একটা বিরতি তৈরি হয়ে গেলে এই নির্ঘণ্ট যাবে তালগোল পাকিয়ে। পরের ভ্যাকসিনগুলো দেওয়াতেও মুশকিলে পড়তে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের। আর বাকি পড়ে যাওয়া ভ্যাকসিনগুলো কী ভাবে দেওয়া হবে, সে নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে।
আরও পড়ুন: সংক্রমণের সম্ভাবনা সব থেকে বেশি প্রবীণ নাগরিকদের, জেনে নিন কোন কোন সতর্কতা জরুরি
উপায় কী?
আপাতত কোনও উপায় নেই। লকডাউন বন্ধ করতে বলাও এই সময়ে দাঁড়িয়ে মূর্খামি। এমন এক পরিস্থিতিতে আমাদের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দিশাহারা হয়ে সমাধান ভাবতে বলেছে জাতীয় স্তরের এজেন্সিগুলোকে। চাইছে এমন এক ব্যবস্থা, যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে। এও বলা হয়েছে, যদি কেউ এমন রোগে আক্রান্ত হন, তা হলে যেন যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই ভ্যাকসিনের পরিবর্তে ওষুধপত্র ও প্রয়োজনীয় যত্নের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। কিন্তু ভ্যাকসিন ছাড়া রোগের সঙ্গে এই অসম লড়াইয়ে কী ভাবে যুঝব আমরা তা নিয়ে শঙ্কা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)