লিভার নিয়ে বেশির ভাগ মানুষের মনে নানা ভুল ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন অ্যাসিডিটিন ডায়ারিয়া বা বদহজম মানেই লিভারের অসুখ। ত্বকের সমস্যার নেপথ্যেও আছে লিভার খারাপ হওয়া। কিন্তু আদৌ তা নয়। জানালেন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট মহেশ কুমার গোয়েঙ্কা।
লিভার নিয়ে আমবাঙালির মনে একটা ভীতি আছে। যে কোনও শারীরিক অসুস্থতার জন্য কথায় কথায় লিভারকে দায়ী করা মধ্যবিত্ত বাঙালির বৈশিষ্ট্য। কোনও কারণে চুল ঝরে যাক অথবা ত্বকে সাদা কালো দাগ পড়ুক কিংবা অ্যাসিডিটি হোক সবাই ভেবে নেন, নিশ্চয়ই লিভার খারাপ হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়।
তবে শুধু আমরাই নয় সভ্যতার শুরু থেকেই শরীরের প্রায় সব রকম সমস্যার জন্যে দায়ী করা হত লিভারকে। কিন্তু অত্যাধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদান আলট্রাসোনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদির সাহায্যে জানা গিয়েছে যে সব ধরনের ত্বকের সমস্যা, চুল ওঠা বা অ্যাসিডিটির সঙ্গে লিভার খারাপ হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।
আরও পড়ুন: হাঁটু-কোমরে ব্যথা নিয়েও চুটিয়ে বেড়ানো সম্ভব, যদি মেনে চলেন এ সব
ভাইরাল হেপাটাইটিস, জন্মগত কোনও ত্রুটি ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য লিভারের অসুখ হতে পারে।
মদ্যপান ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
তা হলে প্রশ্ন ওঠে আমাদের দেশে এতো লিভারের অসুখের রোগী কেন? মদ্যপানের সঙ্গে লিভারের অসুখের সম্পর্ক ওতপ্রোত। ইদানীং মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে মদ্যপানের হিড়িক বেড়েছে। মদ্যপানের পর মাথা ব্যথার হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যথার ওষুধ খেলে লিভারের কাজকর্ম ব্যহত হতে শুরু করে। এ ছাড়া ভাইরাল হেপাটাইটিস, জন্মগত কোনও ত্রুটি ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য লিভারের অসুখ হতে পারে। তবে একটা কথা জেনে আশ্বস্ত হবেন যে লিভার আমাদের শরীরের এমনই এক অত্যাবশ্যক ও শক্তিশালী অংশ যে অল্পবিস্তর সমস্যা হলে তা নিজেই সারিয়ে নিতে পারে।
আরও পড়ুন: হঠাৎই মোটা হয়ে যাচ্ছেন? রাশ টানুন অসুখের সময় এই অভ্যাসের দিকে
গ্যাস-অম্বল মানেই লিভারে চাপ নয়
অনেকে মনে করেন অ্যাসিডিটি আর বদহজম ঘন ঘন হলে লিভার খারাপ হয়ে যায়। আর গ্যাস-অম্বল নিয়ে প্রায় প্রত্যেক বাঙালিই চিন্তিত। জেনে রাখুন, কিছু খাবার আছে যেগুলি হজম হওয়ার সময় শরীরের অভ্যন্তরে কিছু বায়বীয় পদার্থ নির্গত হয়। আর কথা বলার সময় সকলেই কিছুটা বাতাস গিলেও ফেলি। এর থেকেই পাকস্থলিতে কিছুটা বাতাস থেকে যায়। পেটে জমে থাকা এই বায়বীয় পদার্থ কার্বন ডাই অক্সাইড, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের মিশ্রণ।
ত্বকের দাগছোপের সঙ্গে লিভারের সম্পর্ক
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্রণ, ফুসকুড়ি বা দাদ, হাজা চুলকুনি কোনও কিছুর জন্যই লিভার দায়ী নয়। আসল দোষী কিন্তু সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি। এর জন্যই ত্বকে কালো ছোপ পড়ে ও এজিং স্পট হয়। সুতরাং ত্বকের এই সব দাগ ছোপের জন্য লিভার কোনও ভাবেই দায়ী নয়।
ভাইরাল হেপাটাইটিস থেকে সাবধান
লিভারে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই ইত্যাদি ভাইরাসের সংক্রমণ করে। এর ফলে লিভারের প্রদাহ হয়। লিভার ফুলে গেলে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। তবে এটা সাময়িক। কিন্তু যাদের ক্রনিক হেপাটাইটিস আছে তাঁদের লিভার ক্রমশ অকেজো হতে শুরু করে। অবশ্য ইদানীং বেশ কিছু ওষুধের সাহায্যে ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে লিভারকে কর্মক্ষম রাখা সম্ভব। নিয়মিত অপরিমিত মদ্যপান করলেও লিভারের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। এর থেকে লিভারের টিসুতে ফাইব্রোসিস হয়ে স্টিফ হয়ে যায়। এর নাম ‘সিরোসিস অব লিভার’। হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা বা লিভারে ক্যানসার হলেও লিভার ধ্বংস হয়ে যায়। এ ছাড়া কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং কয়েকটি জন্মগত অসুখের কারণেও লিভার সমস্যায় পড়তে পারে। যেমন উইলসন ডিজিজ, বিলিয়ারি অ্যাট্রিশিয়া ইত্যাদির কারণে অনেক শৈশবেই লিভার খারাপ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।
কী কী উপসর্গ দেখলে সাবধান হতে হবে
অল্পবিস্তর লিভারের অসুখের কোনও উপসর্গ থাকে না। আর নিঃশব্দে আসে বলে চট করে টেরও পাওয়া যায় না। লিভারের কাজ ব্যহত হলে এবং অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন কয়েকটি সাধারণ উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন বমিভাব, খিদে কমে যাওয়া, ক্লান্তিভাব ডায়ারিয়া, জন্ডিস, পেট ফুলে ওঠা, ঘুমের অসুবিধা ইত্যাদি। এই ধরণের সমস্যা হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
লিভার নিয়ে বাতিক ভাল নয়। এর জন্যে অনেকেই অকারণে লিভার টনিক খান। লিভার ভাল রাখতে এর কোনও ভুমিকা নেই। তবে অসুখকেও অবহেলা করাও ঠিক নয়। কোনও সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, লিভার টনিক বা ট্যাবলেট কিনে খেয়ে বিপদ বাড়াবেন সুতরাং লিভার নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে নিয়ম মেনে বাঁচুন।