LGBTQ

LGBTQ: গৌরবের মধুমাস, আর...

রামধনু গরিমায় সেজে উঠেছে শহর,  কিন্তু সেই উদ্‌যাপনের ফাঁকে কি উঁকি  দেয় না বৈষম্যের খতিয়ান?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২২ ০৬:৩৭
Share:

ঘটনা ১: কফিশপে গিয়েছিল সুচন্দ্রা, পাশের টেবিলে চোখ পড়তেই ভারী মিষ্টি লাগল তার। দুটি নবীন যুবক মুখোমুখি হাত ধরে বসে গলা নামিয়ে গল্প করছে। সে কী আবেগপূর্ণ চাহনি।

Advertisement

ঘটনা ২: চূড়ান্ত অভিমানে ঘরে দরজা দিয়েছেন এক রূপান্তরকামী মানুষ। উদ্দেশ্য, না খেয়ে মৃত্যুবরণ। স্বেচ্ছাসেবী স‌ংগঠন ও কয়েক জন শুভাকাঙ্ক্ষীর চেষ্টায় প্রায় দেড় মাস পরে উদ্ধার করা হল তাঁকে। হাসপাতালে ভর্তি করার পরের দিনই মারা গেলেন। শারীরিক ভাবে নারী হলেও নিজেকে পুরুষ বলে চিহ্নিত করতেন তিনি। বেসরকারি হাসপাতালের মেল ওয়ার্ডে ভর্তি করার পরে স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল তাঁর মুখ।

শব্দটা এখন পরিচিত, ‘প্রাইড’! পরিচিত তার উদ্‌যাপনও। সমগ্র জুন মাস ধরে রামধনু রঙে সেজে উঠেছে বিশ্ব, বাদ পড়েনি কলকাতাও। এই উদ্‌যাপন আসলে সহজ করে বলার যে প্রেম, ভালবাসা ও যৌনতার ইচ্ছে কোনও শর্ত মেনে হয় না। নারী, পুরুষ, রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত— বিভিন্ন লিঙ্গের মানুষ একে অপরের প্রেমে পড়তে পারেন। তাই রামধনু গরিমায় পৃথিবী উত্তাল। কিন্তু সে পথ কি সত্যিই মসৃণ? সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না এলজিবিটিকিউআইএ+ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়র, ইন্টারসেক্স, অ্যাসেক্সুয়াল) সম্প্রদায়ের মানুষদের? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, “নিজে ট্রান্সজেন্ডার ট্রান্সউয়োম্যান বলে আমাদের সমস্যা, বঞ্চনার কথা বলতে পারব। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় আমরা থার্ড জেন্ডার, তাই বিশাল এই আমব্রেলার বিভিন্ন খোপের পুরো ভারটাই আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে!”

Advertisement

কুইয়র ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট মীনাক্ষী সান্যালের মতে, “মূলধারার মধ্যেই তো ছিলাম বরাবর, আমরা তো বহির্জীব নই। এখন এই তথাকথিত মূলধারায় একটু একটু করে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে আমাদের। তবে বৈষম্য ঘুচে যাওয়া এখনও অনেক দূরের ব্যাপার।”

আশ্রয়

জেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট ও রাইটস কর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের মতে, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রাথমিক সমস্যা আশ্রয়হীনতা। রূপান্তরকামী মানুষদের ক্ষেত্রে যে সমস্যা শুরু হয় একেবারে শিশু বয়সে, সমকামী বা উভকামী মানুষদের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা শুরু হয় মূলত যৌবনে পদার্পণ করলে। ২০১৮ সালে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে রূপান্তরকামীদের কমপক্ষে ৯৮ শতাংশ কৈশোরে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয়চ্যুত হয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সারা দেশে রূপান্তরকামীদের আশ্রয়ের জন্য ‘গরিমা’ গৃহ সুবিধা চালু করা হলেও, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, বহু পদক্ষেপ করা বাকি। বাপ্পাদিত্যের কাছ থেকেই জানা গেল, কলকাতায় দু’টি গরিমা গৃহ রয়েছে। ৫০ জন সেখানে বাস করেন। এ ছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হয় ট্রান্সজেন্ডার শংসাপত্র পেতেও।

স্বাস্থ্য

শিশুকাল থেকে চূড়ান্ত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়ে। বৈষম্যের কারণেই শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বাপ্পাদিত্য জানালেন, অতিমারির সময়ে এই মানুষগুলোর মধ্যে হঠাৎ করে এইচআইভি-সহ বহু অসুখের প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে। হাসপাতালগুলি জেন্ডার ইনক্লুসিভ বলে দাবি করলেও, দেখার চোখটা এখনও বাইনারি, অর্থাৎ পুরুষ ও নারী এই দুই লিঙ্গের বাইরে ভাবাটা আয়ত্তে আসেনি। ফলে চিকিৎসার জন্য গেলে বৈষম্যের ভয় থেকে যায়। নিরাপত্তাহীনতা থেকে চিকিৎসা করাতে যান না অনেকেই।

মীনাক্ষীর মতে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ হল কোভিড টিকাকরণ। পুরুষ ও নারী ছাড়া অন্য কোনও অপেক্ষমান সারি না থাকায় অনেক রূপান্তরকামী মানুষই তীব্র বৈষম্যের শিকার হয়ে টিকা না নিয়ে ফিরে এসেছেন। পাশাপাশি তিনি এও জানালেন, লেসবিয়ান ও বাইসেক্সুয়াল মানুষদের আজও ‘চিকিৎসা’র নামে ‘কারেক্টিভ রেপ’, ‘কনভার্শন থেরাপি’-র সম্মুখীন হতে হয়।

শিক্ষা ও কর্মসংস্থান

বাপ্পাদিত্যের মতে, শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে এখনও নানাবিধ বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে, রূপান্তরকামীদের তো কেউ সচরাচর চাকরি দিতেই চায় না। দিলেও তখন সে সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া ভিন্নধর্মী আচরণের (হেটেরোনর্ম্যাটিভ) নিরিখে বিচার হয়। একই সমস্যা সমকামী বা উভকামী মানুষদের। সমাজের দৃষ্টিতে তাঁরা ‘অন্যরকম’, তাই বৈষম্য থেকে রেহাই পান না তাঁরাও। মানবী জানালেন, “সমস্যা সবচেয়ে বেশি শিক্ষাক্ষেত্রে, ট্রান্সজেন্ডার উচ্চশিক্ষায় এলে বা উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পদে চাকরিতে এলে! বড় সংখ্যক মানুষের মানসিক স্থিতি বা মাইন্ড সেট ট্রান্সজেন্ডার মানেই হিজড়া এবং তারা শুধু বাড়ি বাড়ি আর সিগন্যালে পয়সা চাইবে।” মীনাক্ষী বললেন, অনেক শিশু ছোটবেলাতেই বুঝতে পারে তাকে চিহ্নিত করা লিঙ্গটির সঙ্গে সে খাপ খায় না। সেক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা শুরু হয় স্কুলের পোশাক নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, কোনও ট্রান্সম্যানকে যদি বলা হয় মেয়েদের পোশাক পরতে, তার মন সায় দেবে না। এতে অনীহা আসে স্কুলের প্রতি। ফলে,বিদ্যালয় স্তর থেকে লিঙ্গসাম্যের পাঠ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। লেখাপড়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে জীবনযাপনে।

জীবনযাপন

বাপ্পাদিত্য জানালেন, যাঁরা বিয়ে করতে চান, তাঁদের এখনও সে সুযোগ নেই। আমাদের দেশে এখনও সমস্ত বিয়ে শারীরিক ভাবে পুরুষ ও নারীদের মধ্যেই আইনানুগ। বিবাহ একটি প্রতিষ্ঠান, তার সঙ্গেই জড়িত সন্তান সংক্রান্ত সমস্ত পদক্ষেপ। বিভিন্ন অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রেও বহু অন্তরায় রয়েছে। তিনি এ-ও জানালেন, বর্তমানে ৩৭৭ ধারার পরিমার্জনার পরে সমকামিতা আর অপরাধ নয়। ট্রান্স প্রোটেকশন আইন (২০২০) লাগু হওয়ায় বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া, জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনতায় নিয়োগ করা-সহ ‌একাধিক বিষয় এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনের ফাঁক হল, এখনও পর্যন্ত সবক’টিই জামিনযোগ্য অপরাধ। মীনাক্ষীর মতে, ‘‘শুধু সমকামিতা আর ‘অপরাধ নয়’ বললেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয় না। মানুষগুলোর জন্য নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত নীতি প্রয়োজন। যে সম্পর্কে রাষ্ট্র কোনও আগ্রহ দেখায়নি।’’ সচেতনতা এখনও বড় শহরকেন্দ্রিক।

প্রাইড মান্থ উদ্‌যাপন আশার আলো?

শহর জুড়ে রামধনু গরিমায় মেতে উঠেছেন মানুষ। ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতেও শুরু হয়েছে চরিত্র হিসেবে তাঁদের সহজ প্রকাশ। এ প্রসঙ্গেই বাপ্পাদিত্য বললেন, নিজেদের চিনতে দুই তরফকেই এগিয়ে আসতে হবে। সৌভাগ্যবশত এখন অনেকে এগিয়ে আসছেন। বহু কর্পোরেট সংস্থা তাদের লোগোর রং পরিবর্তন করছে গৌরবের মাসকে সম্মান জানিয়ে। কোথাও গিয়ে পারস্পরিক সম্মান, সহমর্মিতার একটা সেতু তৈরি হচ্ছে। তবে মীনাক্ষীর মতে, “একটু রামধনু রং লাগিয়ে দিলেই হয় না। যদি সত্যি রামধনু উৎসবে শামিল হতে হয়, সংস্থাগুলিকে আমাদের গোষ্ঠীর মানুষকে চাকরির সুযোগ দিতে হবে।”

১৯৬৯ সালে নিউ ইয়র্কের গ্রিনিচে স্টোনওয়াল আন্দোলনে যে লড়াইয়ের জন্ম, তা বিশ্বে ‌একটু একটু করে স্বীকৃতি আদায় করে নিলেও, বহু পথ হাঁটা এখনও বাকি। নিজেকে প্রকাশের অলীক আনন্দ নিয়ে এই হার না মানা লড়াই জারি থাকুক।

শ্রেয়া ঠাকুর

ছবি: অমিত দাস; মডেল: তৃষিতা, মুনমুন, সায়ন্তনী, রোহন, ইমতিয়াজ; মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল; হেয়ার: শক্তি দাস; পোশাক: ওনলি, কোয়েস্ট মল, জ্যাক অ্যান্ড জোনস, সাউথ সিটি, অনুশ্রী মলহোত্র; লোকেশন: ক্লাব ভর্দে ভিস্তা,চক গড়িয়া; ফুড পার্টনার: দ্য ব্রিউহাইভ, সেক্টর ফাইভ, সল্টলেক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement