সুখাদ্যের লোভ কে-ই বা সামলাতে পারে! ধরা যাক, সামনে সাজানো প্রিয় ফ্লেভারের আইসক্রিম। অমনই জিভ সুড়সুড়। নিমেষে শেষ একটা, দুটো... কিন্তু তার পরই মাথার মধ্যে টিকটিক— উঁহু আর নয়, এ বার থামা প্রয়োজন। কিন্তু এই টিকটিক-টাই যদি কারও মধ্যে না থাকে? যদি কেউ একসঙ্গে গোটা ছ’-সাতটা আইসক্রিম শেষ করে ফেলেন? আর শুধু এক বারই নয়, বারবার এমনটাই করতে থাকেন? তবে বুঝতে হবে, কোথাও একটা গোলমাল আছে। তিনি হয়তো ইটিং ডিজ়অর্ডারের শিকার।
ইটিং ডিজ়অর্ডার মূলত দু’ধরনের— অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা আর বুলিমিয়া নার্ভোসা। আমাদের আজকের আলোচনা এই বুলিমিয়া নিয়েই। এক সময়ে বুলিমিয়া পশ্চিমি দেশগুলোর অসুখ ছিল। শোনা যায়, প্রিন্সেস অফ ওয়েলস ডায়ানা এই রোগে ভুগতেন। কিন্তু এখন ভারতেও দেখা যায় এই ধরনের ইটিং ডিজ়অর্ডার।
বুলিমিয়া কী
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় জানালেন, বুলিমিয়ায় যাঁরা ভোগেন, তাঁরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেকখানি খাবার খেয়ে নেন। সেই খাওয়ার মধ্যে কোথাও যেন আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটাই থাকে না। হয়তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কেউ আইসক্রিমের একটা বড় টাব শেষ করে ফেললেন বা একসঙ্গে তিন-চারটে চকলেট বার খেয়ে নিলেন। এবং সেই খাবার সাধারণ আনাজ বা পুষ্টিকর খাবার নয়, তা সাধারণত উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার হয়। খাওয়ার পরে আসবে এক ধরনের অপরাধবোধ, বেশি খেয়ে ফেলার জন্য। তখন বিভিন্ন উপায়ে তিনি চাইবেন এই অতিরিক্ত খাবার যাতে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে নানা রকম প্রবণতা দেখা যায়— কখনও গলায় আঙুল দিয়ে বমি করা, কখনও ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ খেয়ে নেওয়া যাতে পটির সঙ্গে বাড়তি খাবার বেরিয়ে যায়, কখনও ডাইয়ুরেটিক ওষুধ খেয়ে ইউরিনের সঙ্গে বার করে দেওয়ার চেষ্টা বা মাত্রাতিরিক্ত এক্সারসাইজ় করা। কখনও আবার অনেকটা খেয়ে নেওয়ার পরের দু’দিন তিনি কিছুই খেলেন না, ব্যালান্স করার চেষ্টায়। একে বলা হয়, ‘কমপেনসেটরি বিহেভিয়র’।
রোগের মাত্রা
ধরা যাক, কেউ যদি মাসে এক বার অনেকটা খেয়ে নানা ভাবে কমপেনসেট করার চেষ্টা করেন, তাকে কিন্তু বুলিমিয়া বলা চলে না। ডা. মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, তিন মাস ধরে সপ্তাহে অন্তত এক বার এমন আচরণ করতে থাকলে তবেই তাকে বুলিমিয়ার পর্যায়ে ফেলা হবে। সপ্তাহে এক থেকে তিন বার এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তাকে মাইল্ড বলা হয়, দিনে এক বার পর্যন্ত হলে তাকে মডারেট বলা হয়, আর দিনে একাধিক বার হলে তাকে সিভিয়ার বা এক্সট্রিম বলা হয়।
কাদের হয় বুলিমিয়া?
বুলিমিয়া এবং অ্যানোরেক্সিয়া— দুই-ই মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বিশেষত কমবয়সি ও কলেজপড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা সর্বাধিক। বুলিমিয়ার ক্ষেত্রে ওজনের কিন্তু সে রকম তারতম্য হয় না। ওজন কমতে পারে, না-ও পারে, আবার বাড়তেও পারে। এখানেই অ্যানোরেক্সিয়া ও বুলিমিয়ার তফাত। অ্যানোরেক্সিয়ায় ওজন ভয়ঙ্কর কমে যায়। তাই অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীদের দেখে রোগ সম্বন্ধে অনেকটা আন্দাজ করা যায়। কিন্তু বুলিমিয়া দেখে চট করে বোঝা যায় না। এ ক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে কথা বলে রোগের ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
বুলিমিয়ার সঙ্গে ডিপ্রেশন যুক্ত থাকতে পারে। বুলিমিয়ার কারণেও সেই ডিপ্রেশন আসতে পারে, আবার ডিপ্রেশনের কারণেও বুলিমিয়া হতে পারে। বুলিমিয়া রোগীদের ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে ‘ইমপালসিভ’ আচরণ লক্ষ করা যায়। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, কারও ‘মানি ম্যানেজমেন্ট’ খুব খারাপ হয়, কেউ অতিরিক্ত কেনাকাটা করতে থাকেন, আবার কেউ নিজের ক্ষতি করে বসেন। এইগুলোই ইমপালসিভিটি-র লক্ষণ। তবে সকলের মধ্যেই যে এমন প্রবণতা দেখা যাবে, তাও নয়।
চিকিৎসা
ডা. মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বুলিমিয়ার চিকিৎসায় ওষুধ, কাউন্সেলিং— দুই-ই কার্যকর। রোগের মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। মাত্রা যত বাড়বে, আনুষঙ্গিক উপসর্গগুলিও তত বেশি হবে। স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হবে। শারীরিক নানা অসুবিধেও শুরু হয়। এই রোগের মূল থেরাপি হল— কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি। অর্থাৎ রোগীর চিন্তাভাবনাগুলোকে পরিবর্তন করা। যেমন, রোগীর মনে হচ্ছে ওই খাবারটি খেলে আমি আরাম বোধ করছি, আবার পরক্ষণেই তিনি অপরাধবোধে ভুগছেন বেশি খাওয়ার জন্য। এই চক্রটাকে ভেঙে দেওয়া থেরাপির একটা অংশ।’’ এই আচরণ একটা বিশ্বাস থেকে জন্মায়।
দেখা গিয়েছে, রোগী কোনও পর্যায়ে নিজের ওজন, বডি ইমেজ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেছেন। তিনি আত্মবিশ্বাসের অভাবে বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। কখনও তাঁকে শারীরিক ত্রুটি নিয়ে উত্যক্ত করা হয়েছে। সেটা কথা বলে জেনে নিয়ে সেই মতো চিকিৎসা করা হয়। তবে কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি কার্যকর হতে সময় লাগে। তাই রোগের মাত্রা দ্রুত কমানোর জন্য অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। শুধু ডোজ়টা একটু বেশি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সাধারণত ওষুধের প্রয়োজন তখনই হয়, যখন সাধারণ থেরাপি কাজ করে না।