Music Festival

নস্টালজিয়া মাখা আশির দশকের ‘ডিস্কো জ্যাজ়’ ফিরছে কলকাতায়

সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য ডালহৌসি ইনস্টিটিউটে তৈরি হচ্ছে গানের মঞ্চ। পুরনো নস্টালজিয়াকে উস্কে দিতে রূপা আসছেন জ্যাজ় ফেস্ট ২০২৩-এ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৫১
Share:

রূপা বিশ্বাস

সে বহু দিন আগের কথা। মৃদুমন্দ, সুরেলা কণ্ঠ! কখনও গিটারের ঝঙ্কার। সঙ্গে বাজছে সরোদ, ড্রাম, তবলা-সহ আরও কত বাদ্যযন্ত্র। ভেসে আসছে এক মহিলার কণ্ঠস্বর। আর সেই নারীকণ্ঠ যখন হাওয়ার লয়ে কানে ভেসে আসছে, কার সাধ্য সেই ছন্দ-লয়কে আটকে রাখার! মনের অজান্তেই যেন দুলে উঠল মাথা। নেচে উঠল গোটা শরীর! এক দিকে মঞ্চ থাকা সেই মহিলা গাইছেন, ‘চলো নাচবি, চলো আজ’! গানের তালে তালে নাচছে দর্শক। যেন এক অজানা ঘোরে দুলেই চলেছে দেহ-মন।

Advertisement

গায়িকার নাম রূপা বিশ্বাস। সময়টা ১৯৮২ সাল। মুম্বইয়ের হিন্দি ইন্ডাস্ট্রিতে তখন প্রবেশ করে ফেলেছে ডিস্কো গানের জাদু। সেই সময়েই সুদূর কানাডায় রেকর্ড করা রূপা বিশ্বাসের ডিস্কো জ্যাজ় অ্যালবাম ‘আজ শনিবার’ সমাদৃত হয়েছিল শ্রোতামহলে। অ্যালবামটি রেকর্ড করেছিল মেগাফোন কোম্পানি। তার পরে বহু দিন কেটে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে শহরের কত কিছু। সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে সেই গান। হারিয়ে গিয়েছে ‘ডিস্কো জ্যাজ়’। রূপা পার করে ফেলেছেন ৭০টি বসন্ত। তবে আজও যেন সেই গান কানে ভেসে এলে সারা শরীর দুলে ওঠে।

অ্যালবাম রিলিজ়ের প্রায় চার দশক পরে হারিয়ে যাওয়া সেই গান নিয়ে ফের হাজির হতে চলেছেন রূপা, তাঁর নিজের শহরেই। সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য ডালহৌসি ইনস্টিটিউটে তৈরি হচ্ছে গানের মঞ্চ। পুরনো নস্টালজিয়াকে উস্কে দিতে রূপা আসছেন জ্যাজ় ফেস্ট ২০২৩-এ।

Advertisement

পুরনো সেই টেলিফোনে যখন রূপাকে (বর্তমানে তিনি রূপা সেন) ধরা হল, তখন তিনি যেন অষ্টাদশী কন্যা! ফোনের ওপার থেকে তাঁর গলাতেও অদ্ভুত এক উচ্ছ্বাস। যে মৃদু, তীক্ষ্ম কণ্ঠ তাঁর রেকর্ডিংয়ে আমরা শুনেছি, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বলা যায় আনন্দ আর উচ্ছ্বাসভরা গলায় রূপা জানালেন, “এই পারফরম্যান্স নিয়ে আমি অত্যন্ত উৎসাহিত।”

কিন্তু এত দিন পরে মঞ্চে ফিরছেন। নার্ভাস লাগছে না? উত্তরে দুঁদে পারফর্মারের মতোই আত্মবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে রূপা বললেন, “যা হবে, দেখে নেব।”

কী ভাবে তৈরি হল রূপার ‘ডিস্কো জ্যাজ়’? চলুন একটু পিছনের গল্পে ফিরে যাই। ১৯৭৬ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে চলে আসেন রূপা। তখন তাঁর গানের খাতাজুড়ে লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে’র গান। কানে বাজছে এলভিস প্রেসলি, বিট্‌লস। শুরুতে মায়ের কাছেই গান শিখেছিলেন রূপা। ১৯৮১ সালে গান নিয়ে মাস্টার্স শেষ করার পর, ভাইকে দেখতে ছুটিতে কানাডায় যান। সেখানে গিয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ক্যালগরি ইউনিভার্সিটির একটি কনসার্টে উপস্থিত হতে বাধ্য করা হয় তাঁকে। সেখানে তিনি ২৭টি গান, গীত এবং গজল গেয়েছিলেন। ওই কনসার্টেই এসেছিলেন ভাইয়েরই বন্ধু প্রখ্যাত সরোদ বাদক আশিষ খান। কনসার্ট শেষ হলে কোনও মতে তিনি রূপাকে একটি অ্যালবাম রেকর্ড করতে রাজি করান। দু’সপ্তাহের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় ‘ডিস্কো জ্যাজ়’।

“এই জ্যাজ়ফেস্ট-এ আমার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন নতুন প্রজন্মেরই এক গায়ক তৃথা। এর থেকে ভাল আর কী-ই বা হতে পারে।”— ফোনেই জানালেন রূপা। সঙ্গে হাসলেনও।বোঝা গেল, এই স্পটলাইট সানন্দে উপভোগ করছেন। রেকর্ডিংটি প্রকাশের পরে বেশ কয়েকটি জিনিস মিস করেছিলেন রূপা। ‘ক্রেটফলেন’-এর বাংলা সংস্করণ (হিন্দিতেও রয়েছে) ভারতে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বলা যায়, হারিয়ে গিয়েছিল। কারণ এটি ছিল নাজিয়া হাসানের ‘ডিস্কো দিওয়ানে’ এবং ‘আপ য্য়ায়সা কোহি’ (প্রযোজনায় ছিলেন বিড্ডু) একটি গানের অনুলিপি। কানাডা থেকে ফিরে আসার পরেও রূপা নিজের মতো করে রেওয়াজ চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে সিনিয়র আর্টিস্ট হিসাবে যোগ দেন।

আশিষ খানের সঙ্গে রূপা (বাঁ দিকে) এবং তাঁর ব্যান্ড

কিন্তু ‘ডিস্কো জ্যাজ়’ বোধ হয় তাঁর জন্য অন্য কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল। তাঁর কয়েক জন সঙ্গীতপ্রেমী বন্ধু ইউটিউবে একটি ‘বুটলগ ভার্সন’ আপলোড করেন। এবং অ্যালগোরিদ্‌মের কারণে সেই গান বহু মানুষের টাইমলাইনে ভেসে ওঠে। এমনকি তাঁর ছেলেও এই রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে কিচ্ছু জানতেন না। ২০১৪ সালের কোনও এক সময়ে একটি ট্রাঙ্কের বাতিল কয়েকটি জিনিসপত্রের মধ্যে তিনি ওই ক্যাসেটটি খুঁজে পান। মুখোমুখি হন তাঁর মায়ের অতীতের সঙ্গে। যা দেখে রূপা বলেছিলেন— "ও সবের কোনও কাজ নেই। ফেলে দিস।"

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ইউটিউবে ‘আজ শনিবার’-এর প্রায় দু’মিলিয়ন ভিউজ় রয়েছে। আর্কাইভ্যাল রেকর্ড সংস্থা নিউমেরো গ্রুপ এই অ্যালবামটিকে পুনরায় ইস্যু করার পরে এই ডিজিটালের দুনিয়ায় যেন দ্বিতীয় বার প্রাণ ফিরে পেয়েছে অ্যালবামটি। রূপার বয়স বেড়েছে। তিনি এখন ঠাকুরমা। অথচ চুলের সাজ রয়েছে অ্যালবামের সেই কভারের মতোই। যা দেখে নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, “এখন চুল পেকেছে। কয়েকটা সাদা রেখাও দেখা যাচ্ছে বটে!”

বহু দিন ধরেই রূপাকে নতুন করে গান গাওয়ার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করছিলেন সঙ্গীত প্রচারক এবং সঙ্গীত সংরক্ষক বরুণ দেশাই। রূপাকে খুঁজে বার করে, তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে প্রায় দু’বছর সময় লেগেছে বরুণের। অবশেষে ফের প্রকাশ্যে গান গাইতে রাজি হয়েছেন রূপা। এই শুক্রবার অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর শহর কলকাতা সাক্ষী থাকতে চলেছে ‘আজ শনিবার’-এর পুর্নউন্মোচনের। ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠান। দীর্ঘ সময় ধরে নিজের সবটুকু দিয়ে তিন দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের বুনোট বেঁধেছেন বরুণ দেশাই।

রূপা (বিশ্বাস) সেন

আশির দশকের পরে রূপার মঞ্চে উপস্থিতির সংখ্যাটা খুবই কম ছিল। যে কারণে রূপার পাশে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলেন বরুণ। কেমন হয়, যদি রূপার থেকে বয়সে ছোট কোনও মহিলার হাত ধরে সেই গানকেই নতুন করে তুলে ধরা যায়? মাথায় আসে তৃথার কথা। তৃথা নিজেকে সঙ্গীতকর্মী বলতে ভালবাসেন। তিনি নিজের গাওয়া গানগুলিতেও ক্লাসিক্যালকে সমসাময়িক সঙ্গীতের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তৃথা বিশ্বাস করেন, এই বিশ্ব যেন তাঁর মঞ্চ। কিন্তু রূপা কী ভাবে জ্যাজ়ফেস্টে আসার জন্য রাজি হলেন? প্রসঙ্গ তুলে তৃথা বলেন, “রূপাদি কোনও ভাবে তাঁর এবং আমার সঙ্গীতযাত্রার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন। আমি নিজেও কলকাতায় থাকি। এবং রূপাদির মতোই বিদেশ থেকে আসা কিছু রক এবং জ্যাজ় শিল্পীদের সঙ্গে মিলে পারফর্ম করেছি। কারণটা হয়তো এটাই।”

বরুণ দু’জনকে একসঙ্গে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে এই দুই গায়িকার মধ্যে এক অদ্ভুত সংযোগ রয়েছে। যা কলকাতার মধ্যে থেকেও কলকাতার ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরে থাকা এক সঙ্গীত জগত। যে প্রসঙ্গে বরুণ নিজেও বলেন, “দু’জনেই শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত। তৃথা রূপাদিকে আবার মঞ্চে ফিরে আসতে সাহায্য করেছে। যা এখানকার তরুণ প্রজন্মকে ডিস্কো জ্যাজ় সম্পর্কে আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। বলা যায়, এটি পুরনো সেই অ্যালবামটিকে খুঁজে বার করে, তাকে নতুন ভাবে চেনার এক উদযাপন।”

“নিজের শিকড় ছেড়ে কখনওই বার হননি রূপাদি। বরাবর বাংলাতেই গান গেয়েছেন। উচ্চারণেও কোনও পরিবর্তন আনেননি,” জানাচ্ছেন তৃথা। আসলে তৃথা নিজেও এই দর্শনে বিশ্বাসী। সম্প্রতি তাঁর প্যারিসের পারফরম্যান্সের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছিল। ওই ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে তৃথা শাড়ি পরে, বৈদ্যুতিক গিটার বাজিয়ে, বাংলায় গাইছেন ‘দিল্লির হজরত নিজামুদ্দিন দরগা’।

জ্যাজ়ফেস্ট ২০২৩-এ তৃথা কলকাতার প্রতিষ্ঠিত সংগীতশিল্পীদের ব্যান্ডের সঙ্গেই তাঁর নিজের গানের একটি সেট পরিবেশন করবেন। সেই সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে কয়েক জন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তৃথার পুরনো বন্ধু। তাঁদের সেই পারফরম্যান্সের মধ্যেই রূপা মঞ্চে উপস্থিত হবেন ‘আজ শনিবার’ নিয়ে।

এই বছরের গানের উৎসবের শুরুটা তাই একটু অন্য রকম হবে। যেখানে দুই প্রজন্মের দুই গায়িকা মুছে দেবেন সময়ের ব্যবধান। পরিপূর্ণ হবে সেই বৃত্ত। যদিও সময়ের বেড়াজালে হারিয়ে গিয়েছিল ‘আজ শনিবার’। তবুও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কয়েক দশক পরে সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। সেই গানের মাত্রাই আরও নতুন উপভোগ করবে আগামী প্রজন্মরা।

তৃথা বিশ্বাস

তবে প্রশ্ন আসতেই পারে গান হিসাবে এটি ঠিক কেমন? মূল্যায়নের আগে অবশ্যই বুঝতে হবে যে এই গানের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নস্টালজিয়া। জুড়ে রয়েছে অবাধ আত্মীয়তা। আসলে ডিস্কো জ্যাজ়ের অস্তিত্ব, তার মানের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘আজ শনিবার’ এই অ্য়ালবামটিতে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যেমন, রিদম গিটার, বেস লাইন, বার বার ফিরে আসা একটি হুক, একটি সূক্ষ্ম বিট। সর্বোপরি এটি তৈরি হয়েছিল আশির দশকে। যে সময়টায় মুম্বইয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গীত জগতে রাজত্ব করছেন বাপ্পি লাহিড়ী। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই গানে সরোদ ও তবলার অন্তর্ভূক্তি এই অ্য়ালবামের ট্রাম্প কার্ড। সঙ্গে গানের মাঝে মাঝে সিন্থ মোডে থাকা সরোদ এবং গিটারের ইন্টারল্যুড এবং ঝরঝরে ‘বাস’-এর উচ্চারণ ‘আজ শনিবার’কে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।

আসুন, এই শুক্রবার জ্যাজ় ফেস্টে সাক্ষী থাকুন সেই মনমাতানো সুর, তাল, ছন্দ, লয়ের। ফিরে আসুক পুরনো দিনের শনিবারের সন্ধ্যের অনুভূতি।

'আজ শনিবার, আজ শনিবার

এই নাচবি চলো আজ

ঘুরে ফিরে, ছন্দে আনন্দে,

ছন্দে তাই ফেলো পা...'

টিকিট কাটতে ক্লিক করুন পাশের লিঙ্কে: Tickets | Jazzfest 2023

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement